বাঙালি জাতি গত কয়েক হাজার বছর ধরে অনবরত ভুল করেছে এবং সেই ভুলের মাশুল দিয়েছে। আমাদের রক্তশর্করা আমাদের অভিশাপ, আমাদের ভুলের মাশুল। লিখেছেন- ডঃ তমাল দাশগুপ্ত
বঙ্কিমের জীবনীতে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র আক্ষেপ করেছেন, বাঙালি প্রতিভার ঘাতক হল মধুমেহ বা রক্তশর্করা। বাংলা রেনেসাঁসের একাধিক দিকপাল এই রোগেই গত হয়েছেন। বঙ্কিমও তাই।
আমার এতদিন একটা ধারণা ছিল যে বাঙালির রক্তশর্করার পেছনে অন্যতম কারণ হল বাঙালি ঐতিহাসিক ভাবে মিষ্টিপ্রিয়। শুধু মিষ্টিপ্রিয় নয়, মিষ্টি উৎপাদক।
পুণ্ড্র নামটা এসেছে একরকম প্রাচীন আখ থেকে। পুণ্ড্র ইক্ষু।
গৌড় নামটা এসেছে গুড় থেকে। আমাদের পূর্বমানুষরা প্রথম গুড়ের মাস প্রোডাকশন শুরু করেন। প্রাচীন যুগে মধু ছিল মহার্ঘ, দেবভোগ্য ও রাজভোগ্য। সেই মিষ্টি সকলের জুটত না। বিষ্ণুর একটি নাম মাধব, যিনি মধু দেন।
সকলের জন্য সাম্যবাদী মিষ্টি হিসেবে এলো আমাদের গুড়। মধুর অভাবে গুড় দাও, সংস্কৃত প্রবচন তৈরি হয়ে গেল।
যাকগে, বাঙালির সঙ্গে মিষ্টির সম্পর্কের ইতিহাস লিখছি না এখানে আমরা। কিন্তু এই ইতিহাস অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এবং একটা ভ্রান্ত কথা যতই ছড়ানো হোক যে বাঙালিরা পর্তুগিজ প্রভাবে রসগোল্লা বানাতে শিখেছে, আসলে রসগোল্লা খাঁটি বাঙালি জিনিস। হরিপদ ভৌমিক একটি বই লিখেছেন এই বিষয়ে, তাতে মধ্যযুগের নানা নথি থেকে স্পষ্ট প্রমাণ উদ্ধার করেছেন।
এবং এত মিষ্টি খাওয়ার ফলেই সম্ভবত আমাদের রক্তে শর্করা বেশি। মিষ্টি নিয়ে বাণিজ্য আমাদের পূর্বমানুষ যা করার করেছেন, আমরা তাদের তুলনায় প্রায় কিছুই পারিনি কিন্তু তেড়ে মিষ্টি খেয়েছি। বাঙালি এবং রসগোল্লা, মিষ্টি দই, বাকি ভারতের কাছে প্রায় অবিচ্ছেদ্য।
কিন্তু সম্প্রতি একটা পড়কাস্ট দেখলাম। কৃশ অশোক নামে একজন বিখ্যাত ইউটিউবার আছেন। তাঁর লেখা মসালা ল্যাব নামে বইটি বিখ্যাত। তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলছেন, যে জাতি অনেক মন্বন্তরের মধ্য দিয়ে যায়, যে জাতির মধ্যে প্রাচীন স্মৃতি আছে অনাহারের, তাদের মধ্যে রক্তশর্করার প্রবণতা বাড়ে।
এ কথা সত্যি যে মিষ্টি খেলে রক্তশর্করা হোক বা না হোক, কিন্তু স্ট্রেস থেকে সর্বদা রক্তশর্করা হয়। আজ পর্যন্ত ব্যতিক্রম দেখিনি। এবং আমরা আজ যতই বিবর্তিত হই, আজকে আমাদের আধুনিক জীবনের স্ট্রেস যতই সূক্ষ্ম ও জটিল হোক, আমাদের এই জীবদেহ কিন্তু সর্বদা স্ট্রেসকে একটা সিগন্যাল হিসেবে নেয়! অনাহার আসছে, কিংবা মৃত্যু। শরীর যেন রক্তে শর্করা সঞ্চয় করে রাখে, যেন এনার্জির ভাণ্ডার এ যাত্রায় বিপন্ন জীবদেহকে তরিয়ে দেয়।
রক্তশর্করা!
এবং জাতি হিসেবে বাঙালি যত স্ট্রেস নিয়েছে সম্ভবত আর কেউ নেয়নি। অনেকেই ভাববেন ইংরেজ আমলের দুটি মন্বন্তরের কথা, কিন্তু আমি তো ভাবছি হরপ্পা পতন, পাণ্ডু রাজার ঢিবির পতন, চন্দ্রকেতুগড়ের গঙ্গারিডাই সভ্যতার পতন, মাৎস্যন্যায় যুগ। আমি তো ভাবছি বধ্যভূমি মধ্যযুগ, যখন বিপন্ন বাঙালির মধ্যে প্রবাদ চালু হয়েছিল জাতও গেল পেটও ভরল না, তার বিস্তারিত কারণ আর ব্যাখ্যা করছি না, বুদ্ধিমান পাঠক মাত্রেই বুঝবেন।
এবং তারপর গত একশ বছরের হননকাল। ছেচল্লিশের নোয়াখালি, পঞ্চাশ সালের ঢাকা খুলনা বরিশাল। একাত্তর সালে যত মানুষ মরেছে পূর্ব পাকিস্তানে তার নব্বই শতাংশ হিন্দু, গ্যারি বাস বলছেন তাঁর ব্লাড টেলিগ্রাম বইতে।
এবং আজকের বাংলা দেখুন। আমি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না, কিন্তু যে চূড়ান্ত অব্যবস্থা অনাচার অসভ্যতা অসুস্থতা দেখলাম পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি, তাতে সুস্থ মানুষেরও রক্ত শর্করা হয়ে যাবে ও রাজ্যের সরকারি ব্যবস্থার সঙ্গে ডিল করতে হলে।
বাঙালি জাতি গত কয়েক হাজার বছর ধরে অনবরত ভুল করেছে এবং সেই ভুলের মাশুল দিয়েছে। আমাদের রক্তশর্করা আমাদের অভিশাপ, আমাদের ভুলের মাশুল।