Tuesday, May 20, 2025
Homeবাঙালির ইতিহাসরামকৃষ্ণ মিশন: ধর্মীয় পরিচয় ও সম্প্রদায়গত অবস্থান

রামকৃষ্ণ মিশন: ধর্মীয় পরিচয় ও সম্প্রদায়গত অবস্থান

রামকৃষ্ণ মিশন (সংক্ষেপে রাকৃমি) একটি সুপরিচিত ধর্মীয় ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, এটি কোন ধর্মের, কোন সম্প্রদায়ের এবং কোন আদর্শের অনুসারী? বিশেষত, এটি হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত কি না, তা নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা রামকৃষ্ণ মিশনের ধর্মীয় অবস্থান এবং সম্প্রদায়গত পরিচয় বিশ্লেষণ করব। লিখেছেন- রক্তিম মুখার্জী


রামকৃষ্ণ মিশন: হিন্দু না অহিন্দু?

প্রথমেই জানা দরকার, রামকৃষ্ণ মিশন হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত কিনা। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই প্রশ্নটি কেবল সাধারণ মানুষের নয়, বরং স্বয়ং রামকৃষ্ণ মিশনই একসময় নিজেদের অহিন্দু হিসেবে দাবি করেছিল।

১৯৮০ সালে রামকৃষ্ণ মিশন বেআইনিভাবে রহড়া কলেজের এক সন্ন্যাসীকে প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ করেছিল, যদিও তার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ছিল না। এর ফলে কলেজের অধ্যাপকগণ মিলে অধ্যাপক এ.আর. দাশগুপ্তকে টিচার-ইন-চার্জ হিসেবে নিয়োগ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মামলা হয়, এবং রামকৃষ্ণ মিশন আদালতে দাবি করে যে তারা একটি ‘অহিন্দু মাইনরিটি প্রতিষ্ঠান’। তাদের লক্ষ্য ছিল সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেলে তারা নিজেদের পছন্দমতো নিয়োগ প্রক্রিয়া চালাতে পারবে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এই দাবি খারিজ করে এবং রামকৃষ্ণ মিশনকে হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে। ফলে, আইনত তারা হিন্দু ধর্মের অংশ।


রামকৃষ্ণ মিশন কোন সম্প্রদায়ের?

যদি মিশন হিন্দু সংগঠন হয়, তবে তারা হিন্দু ধর্মের কোন সম্প্রদায়ের অন্তর্গত? এক মত অনুযায়ী, তারা শঙ্করাচার্যের দশনামী সম্প্রদায়ের পুরী শাখার অন্তর্গত। কিন্তু এই দাবির ভিত্তি কতটা শক্তিশালী?

১. দশনামী সম্প্রদায়ের যুক্তি ও বাস্তবতা

দশনামী সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে:

  • গুরুপরম্পরার সুস্পষ্ট ঐতিহ্য থাকতে হয়।
  • মঠের নির্দিষ্ট জনসংখ্যা ও আচার-অনুষ্ঠান অনুসরণ করতে হয়।
  • সন্ন্যাস গ্রহণের পর ‘পুরী’, ‘ভারতী’, ‘গিরি’ ইত্যাদি উপাধি থাকতে হয়।
  • নির্দিষ্ট মঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা এবং প্রতিপাদ্য বেদ অনুসরণ করতে হয়।

রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের নামের সাথে কখনোই ‘পুরী’ বা অন্য কোনো দশনামী উপাধি দেখা যায় না। শ্রীরামকৃষ্ণ তোতাপুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও, তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দশনামী সন্ন্যাস গ্রহণ করেননি। তাছাড়া, মিশনের সন্ন্যাসীরা কোনো বিশেষ মঠ বা পরম্পরার সঙ্গে যুক্ত নন। ফলে, তাদের দশনামী সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে গণ্য করা যায় না।

পুরী, গিরি অরণ্য প্রভৃতি সম্প্রদায়ের কোনো সন্ন্যাসীর শিষ্য হলেও সেই সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসী হওয়া যায় না। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু যখন পিতার পিণ্ডদানের জন্য গয়াধাম গিয়েছিলেন তখন তিনি ঈশ্বরপুরীর কাছে দীক্ষিত হয়েছিলেন। এর অনেক আগে নবদ্বীপের অদ্বৈত আচার্য মাধবেন্দ্রপুরীর কাছে দীক্ষিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার জন্য গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বা অদ্বৈত আচার্য কেউই পুরী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হন নি। অদ্বৈত আচার্য আজীবন গৃহী বৈষ্ণব ছিলেন। আর গয়াধাম থেকে ফেরার বেশ কিছুদিন পরে মহাপ্রভু কেশব ভারতীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করে তবেই শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ভারতী নামে পরিচিত হয়েছিলেন। যেহেতু আনুষ্ঠানিক সন্ন্যাস দীক্ষা ভারতী সম্প্রদায়ের কাছে, তাই শ্রীচৈতন্যদেব নিজে ভারতী সম্প্রদায়ভুক্ত। আগে ঈশ্বরপুরীর কাছে দীক্ষা নিলেও সেটা সন্ন্যাস দীক্ষা নয় বলে পুরী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নন। আবার শ্রীচৈতন্যদেবের অনুগামীরা কেউই তাঁর কাছে সন্ন্যাসদীক্ষা নেন নি। তাই তাঁরা নিজেকে ভারতী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী বলে দাবিও করেন নি।

শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর অনুগামীদের সন্ন‍্যাস দীক্ষা দিয়ে যান নি, গেরুয়া প্রদান করেছিলেন শোনা যায় । গেরুয়া প্রদান কিন্তু সন্ন‍্যাস দীক্ষা নয়। আসল সন্ন‍্যাস দীক্ষার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ দেব জীবিত ছিলেন না। আঁটপুরে রাত্রিবেলায় ধুনি জ্বেলে নিজেরা নিজেরা প্রেসমন্ত্র উচ্চারণ করে বিরজা হোম করেছিলেন যেটা সম্পূর্ণ অশাস্ত্রীয়। সন্ন‍্যাস মন্ত্রে দীক্ষিত করার কোন গুরু ছিল না। আজও রামকৃষ্ণ মিশনের মঠে গেলে দশনামী গুরুপরম্পরার কোন ছবি বা লতিকা দেখতে পাওয়া যায় না।


রামকৃষ্ণ মিশন কি তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের?

একটি প্রচলিত মত হলো, রামকৃষ্ণ মিশন তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হতে পারে। কারণ, শ্রীরামকৃষ্ণ যোগেশ্বরী ভৈরবী নামে এক সাধিকার কাছে তন্ত্রসাধনা করেছিলেন বলে প্রচলিত আছে। কিন্তু গবেষক সুনীত দে জানাচ্ছেন, এই ভৈরবীর কোনো ঐতিহাসিক অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। সমকালীন আর কারো লেখায় এত ক্ষমতাশালী একজন তন্ত্রসাধিকার কথা একবারও উল্লিখিত হয় নি। সেক্ষেত্রে রামকৃষ্ণদেবের তান্ত্রিক সাধনার গুরু ছিলেন বলে যে মতটি প্রচলিত আছে সেটাও অনৈতিহাসিক হয়ে যাচ্ছে।

একটা তথ্য শুনেছিলাম যে দক্ষিণেশ্বরে পূজার দায়িত্ব নিয়ে আসার পর দাদা রামকুমারের উদ্যোগে গদাধরের শাক্ত দীক্ষা হয়েছিল। কিন্তু সে দীক্ষা বাঙালির ঘরে ঘরে, যাঁদেরই দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী বা অন্য কোনো রূপে মাতৃসাধনার পারিবারিক রীতি আছে তাঁদের সকলেরই হয়। কাজেই সেই শাক্ত দীক্ষার ভিত্তিতে তান্ত্রিক সন্ন্যাসী সংগঠন নির্মাণ সম্ভব নয়। সে অধিকার তাহলে যুক্তিমতো প্রত্যেক শাক্ত বাঙালির আছে, রামকৃষ্ণদেবের একার নয়।

এছাড়া, শ্রীরামকৃষ্ণ যদি তান্ত্রিক সাধকই হতেন, তাহলে তার অনুসারীদের মধ্যে তান্ত্রিক গুরুবংশ থাকা উচিত ছিল। কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশনের কোনো গুরুপরম্পরা নেই, এবং তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তান্ত্রিক মন্ত্র দীক্ষাও দেয় না। ফলে, তাদের তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বলা যায় না।


ইসলামিক ও খ্রিস্টীয় সাধনার প্রসঙ্গ

শ্রীরামকৃষ্ণ নাকি ইসলাম ধর্মের সাধনাও করেছিলেন। তবে ইসলামিক সাধনার জন্য দীর্ঘ সময় এবং কঠোর নিয়মের প্রয়োজন হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ অল্প সময়ে ইসলামিক সাধনার উচ্চ স্তরে পৌঁছাতে পেরেছিলেন কিনা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। একইভাবে, যীশুখ্রিস্টের আরাধনার কথাও শোনা যায়।

রামকৃষ্ণ মিশন তাদের মঠে যীশুখ্রিস্ট ও হজরত মহম্মদের ছবি রেখে পূজা করে, যা প্রচলিত হিন্দু ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে, এটি একটি অনন্য ধর্মীয় অবস্থান তৈরি করে, যা প্রচলিত হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে মেলে না।

আরও প্রশ্ন ওঠে, ইসলামিক সাধনার পরে কোনো প্রায়শ্চিত্ত বা ঐ সংক্রান্ত নিয়ম পালন না করে তিনি কি করে হিন্দুধর্মের অন্তর্গত হলেন? যদি এখানে সাম্প্রদায়িক উদারতার প্রশ্ন তোলেন, তাহলে বলব, পুরী সম্প্রদায় বা ভৈরবী সাধিকার তান্ত্রিক পরম্পরার দোহাই দিয়ে সে অধিকার তাঁরা ইতিপূর্বেই হারিয়েছেন। যদি ঐ দুই পরম্পরার সাথে কোনো যোগসূত্র স্বীকার করেন তাহলে ইসলামিক সাধনার পর প্রত্যাবর্তনের রীতিও মানতে হবে। আর যদি রীতির বিষয়ে উদার হন, তবে সর্বভারতীয় উপাসক সম্প্রদায়গুলির সাথে এবং হিন্দু ধর্মের সাথে যোগসূত্র দেখানো চলবে না।


উপসংহার: রামকৃষ্ণ মিশনের প্রকৃত অবস্থান

ভারতে বহুদিন ধরে স্বঘোষিত গুরুপরম্পরার অস্তিত্ব আছে। রামকৃষ্ণ মিশন চাইলে নিজেদের সেই হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন। তাহলে মিশনে যীশুখ্রীষ্ট, হজরত মহম্মদের পূজার বিতর্কিত রীতিটি বাঁচাতে পারবেন। নিজেদের মাইনরিটি দেখিয়ে নিজেদের সংগঠনে নিজস্ব স্বজনপোষণ চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু কোর্টের আদেশে তাঁরা হিন্দু সংগঠন হয়ে আছেন, বাঙালির ঘর থেকে রসদ সংগ্রহ করে অস্তিত্ব রক্ষা করছেন। তাই তাঁরাই সিদ্ধান্ত নিন যে তাঁরা আসলে কোন পর্যায়ভুক্ত হচ্ছেন।

 

shoptodina.com
shoptodina.comhttps://shoptodina.com
সপ্তডিঙা। কথাটা শুনলেই মনে আসে বাঙালির সমুদ্রবাণিজ্যের এক গৌরবময় ইতিহাস। গৌড়ের বণিকরা সাতটি বিশাল নৌকার এই সমবায় নিয়ে সিংহল, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, চীন, রোম, গ্রীস, ক্রীট, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করে ফিরে আসতেন স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার নিয়ে। সপ্তডিঙা তাই বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির অভিজ্ঞান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Advertisingspot_img

Popular posts

My favorites