মাতৃকা উপাসনার টিকে থাকার সংগ্রাম
বিজাতীয় শক্তির আগ্রাসন ও অন্তর্ঘাত নিয়ে বহুবার আলোচনা করা হয়েছে। আমরা জানি, মাতৃকা উপাসনা এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে টিকে আছে, কিন্তু শত্রুরা থেমে নেই—তারা নিত্যনতুন কৌশলে আঘাত হানছে।
কালীসাধকদের ত্যাগ ও সাধনা
আজ আমরা কালীসাধকদের কথা বলবো— যাঁরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন মা কালীর সাধনায়। কালীসাধকদের নাম উঠলেই প্রথমেই মনে আসে দুজন মহান সাধকের নাম—রামপ্রসাদ ও কমলাকান্ত। তাঁরা গানের মাধ্যমে মা কালীর মাহাত্ম্য প্রকাশ করেছেন এবং তাঁকে সর্বশক্তিময়ী রূপে দেখেছেন। কমলাকান্ত দ্বিধাহীনভাবে বলেছেন:
“আর কিছু নাই শ্যামা মা তোর কেবল দুটি চরণ রাঙা, শুনি তাও নিয়েছেন ত্রিপুরারি, দেখে হলাম সাহসভাঙা।”
একজন প্রকৃত শাক্ত তিনিই, যিনি মা-কে সর্বোচ্চ শক্তিরূপে কল্পনা করেন।
শাক্তদের অস্তিত্ব সংকট
কিন্তু বাংলার শাক্তরা একপ্রকার বিশ্বমানব, আর আজকের দিনে বিশ্বমানব মাত্রই ঘরের শত্রু। হিন্দু ধর্মের নানা ধারা বিদ্যমান—শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব ইত্যাদি। প্রতিটি ধারার নিজস্বতা আছে, এবং প্রতিটি সম্প্রদায়ই নিজেদের ধর্মের ঐতিহ্য রক্ষা করতে সচেষ্ট। কিন্তু শাক্তদের ক্ষেত্রে আমরা একটি ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। শাক্তদের অনুসরণে বলি দিয়ে কৃষ্ণের পূজা হতে দেখা যায় না, কিন্তু বৈষ্ণবদের অনুসরণে রামকৃষ্ণ মিশন ও অন্যান্য স্থানে বলি তো দূরের কথা, আমিষ ভোগও বন্ধ করা হয়।
শাক্ত ধর্মের বিকৃতি
শাক্ত ধর্মের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অবমাননা হলো সারদাকে ষোড়শী ও সরস্বতীরূপে পূজা করা। শাক্ত ধর্মে দেবী কেবল নারী নন, তিনি কখনো কখনো পুরুষও হন। তিনি আদি এবং অনাদি। মূর্তি কল্পনা তাঁর রূপ বোঝার একটি মাধ্যম মাত্র, কিন্তু উনিশ শতকের এক মানবীর পূজা করা শাক্ত ধর্মের মূল আদর্শের অবমাননা। বৈষ্ণব বা শৈব ধারায় গুরু বা গুরুমায়ের আলাদা স্থান আছে, কিন্তু গুরুকে শিব বা বিষ্ণুর জায়গায় বসিয়ে পূজা করা হয় না।
রামকৃষ্ণ ও শক্তির বিকৃতি
এই প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘কথামৃত’-এর চতুর্থ খণ্ডে তিনি বলেছেন, “যত লোক স্ত্রীলোকের বশ, শিব আর কৃষ্ণ এদের আলাদা কথা। শক্তিকে শিব দাসী করে রেখেছিলেন।” একজন শাক্ত হিসেবে এ ধরনের মন্তব্য শুধু অন্যায় নয়, চরম আপত্তিকর। অথচ, আজ কালীমন্দিরগুলোতে মা কালীর ডাকিনী-যোগিনীর পরিবর্তে রামকৃষ্ণ ও সারদার মূর্তি স্থাপিত হচ্ছে।
শেকড় বিস্মৃত বাঙালির ভবিষ্যৎ
যে জাতি নিজের শেকড় ভুলে যায়, তার পতন অনিবার্য। বাঙালি যতই নিজেকে মহাজাতি বলুক না কেন, শেকড় বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে থাকা অসম্ভব। আমাদের মাতৃকা আরাধনা যেন শেষ পর্যন্ত কেবল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কার্নিভালে পরিণত না হয়, অথবা মদ ও মাংসের মোচ্ছবের সমার্থক না হয়ে দাঁড়ায়।