Wednesday, May 21, 2025
Homeবাঙালির ইতিহাসবাঙালি , বাঙালিত্ব , বাঙালি জাতীয়তাবাদ

বাঙালি , বাঙালিত্ব , বাঙালি জাতীয়তাবাদ

বাঙালির সংজ্ঞা ভাষাবাদী নয়। মধ্যযুগে এদেশের দেশজ সংস্কৃতির ধারক বাহককে বাঙালি বলতেন বিদেশী শাসক, শাসকদের এজেন্ট সুফি–পীরগণ এবং তাদের দ্বারা ধর্মান্তরিত মুসলমানেরা। বাংলার মুসলমান নিজেকে বাঙালি মনে করত না। লিখেছেন- অধ্যাপক তমাল দাশগুপ্ত

বাঙালি কাকে বলে?

বাংলা ভাষায় কথা বললেই বাঙালি।

তাহলে ইংরেজিতে কথা বললেই ইংরেজ?

অর্থাৎ এই সংজ্ঞায় সমস্যা আছে।

অনেক অবাঙালিও বাংলায় কথা বলেনএবং অনেক বাঙালিও বাংলায় কথা বলতে পারেন না। সেক্ষেত্রে কি বলব আমরামাইকেল মধুসূদন দত্ত একবার বাংলায় বক্তব্য রাখতে হবে শুনে পালিয়ে যাচ্ছিলেনতিনি বাংলায় শ্রেষ্ঠতম কবি। ঋষি অরবিন্দ বাংলায় কথা বলতে পারতেন নাতিনি বাঙালির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নেতাদের একজন না হলেওঅগ্নিযুগের কিছুটা সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

ফলে বিষয়টা বেশ জটিল। আমি এখানে বাঙালিত্বের ধারণা আনতে চাই। বাঙালির সাংস্কৃতিক সংজ্ঞা হল বাঙালিত্ব। জলের যেমন একটা ধর্ম আছেবাতাসের ধর্ম আছেমেঘের ধর্ম আছেবাঙালির সেরকম একটা ধর্ম আছে। এখানে নেচার/কালচার বাইনারিকে উল্লঙ্ঘন করা হচ্ছে নাকিক্লদ লেভি স্ট্রস একবার বলেছিলেনএই বাইনারি ধ্রুব নয়অনেকসময় কালচার এবং নেচারের এই বাইনারি ফারাক ভেঙে যায়। উদাহরণ দিয়েছিলেনসব কালচারেই ইনসেস্ট নিষিদ্ধ। অর্থাৎ কালচারটা আর আপেক্ষিক না থেকে নেচারের মত ধ্রুব চেহারা নিচ্ছে।

বাঙালিত্বের কি কোনও ধ্রুব রূপ আছেমাত্র আটশো বছর আগেও তো বঙ্গালি বললে বর্তমান পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা বোঝাত। সুবে বাঙ্গাল পুরো দেশটার নাম না হলে সম্ভবত আমরা নিজেদের বাঙালি বলতাম না। বিধর্মী শাসকরা আমাদের বাংগালি বলা প্রথম শুরু করলেনএজন্যই একটা তত্ত্ব হিসেবে খাড়া করা হয়যে মধ্যযুগে মুসলিম শাসনেই বাঙালি জাতি। কিন্তু এই মধ্যযুগেই চৈতন্য নিজেকে বাঙালি বলতেন নাগৌড়ীয় বলতেনআন্দোলনটিই গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন হিসেবে পরিচিত ছিল। আধুনিক যুগেই রামমোহন গৌড়ীয় ভাষার ব্যকরণ লিখেছেন।

আরও পিছিয়ে যাওয়া যাক। বলির যে পাঁচ ছেলের নামে পূর্বভারতের পাঁচটি জনপদঅঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ পুণ্ড্র সুহ্মমহাভারত যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই এখানে ছিলবোঝাই যায় সেখান থেকেই পূর্ব ভারতের সভ্যতাবাঙালি তারই উত্তরসূরীকিন্তু তারা অবশ্যই নিজেদের বাঙালি বলতেন না। এই যে পাঁচটি পরস্পর সম্পর্কিত ক্ল্যানএদের জেনেটিক স্ট্রাকচাররেশিয়াল স্ট্রাকচার কেমন ছিল আজ বলা খুব কঠিনকিন্তু এরাবা এঁদের উত্তরসূরীরা আজও যে ভাষায় আজও কথা বলেনসেটি আর্যভাষা। এদের বারবার ব্রাত্য আর্য বলা হয়েছেঅসুরভাষী বলা হয়েছেকাজেই বোঝা যায়এরা বৈদিক আর্য ছিলেন না। নৃতাত্বিক বিচারে বাঙালির মধ্যে গোলমুণ্ড ইন্দো অ্যালপাইন আর্যদের রক্ত আছেতাদের ভাষাই যে বাঙালির ভাষাবাঙালির বা এই পূর্বভারতীয় সভ্যতার উচ্চারণপদ্ধতির স্বাতন্ত্র্য আজও সাক্ষ্য দিচ্ছে।

তবে ভাষাসংস্কৃতি এবং রেস – এ দুটির সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল হতে পারে। অহোম জাতির রেস এবং তাদের ভাষা অসমিয়ার সম্পর্ক বেশ জটিল।

পুণ্ড্র নিঃসন্দেহে দ্রাবিড় শব্দ আদিতেদামলিপ্তিও। শিব দ্রাবিড়দেরএবং অ্যালপাইন আর্যদের শক্তি – এ অতি সরল সমীকরণ হলেও এর মধ্যে কিছু সত্য আছে। বাঙালিদের মধ্যে এলিট অংশটি গত চার হাজার বছর ধরেই শক্তি উপাসনা করে আসছে। এর পেছনে ইতিহাসের ইঙ্গিতটি যথেষ্টই তাৎপর্যপূর্ণ

একটা সেন্ট্রিপেটাল ফোর্স নিঃসন্দেহে কাজ করেছেনইলে প্রাচীনযুগে এই জাতিগঠনের প্রক্রিয়া সম্ভব হত না। সেটা গঙ্গারিডাই হতে পারে। আমরা জানি মহাপদ্মনন্দ গঙ্গারিডাই ছিলেনএবং পরে মগধেরও অধিপতি।

সারস্বত ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্কবিচার বাঙালির সঙ্গে সরস্বতী সভ্যতার সম্পর্ক বুঝতে সাহায্য করবে। অতুল সুর সরস্বতী সভ্যতার সঙ্গে বাঙালির সম্পর্কের বিষয়ে প্রচুর কাজ করেছিলেন।

১। সরস্বতী সভ্যতার চিহ্নে সবথেকে বেশি আছে মাছ। সারস্বতদের মিথে মাছ হল সেই খাদ্যযা স্বয়ং সরস্বতী তাঁর পুত্র সারস্বতকে দিয়েছিলেন দুর্ভিক্ষের সময়।

২। সরস্বতী সভ্যতার শীলমোহরের সঙ্গে তন্ত্রসাধনার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা হয়েছে।

৩। সরস্বতী সভ্যতা রাজতান্ত্রিক ছিল না। মিশেল দানিনোর বই দ্য লস্ট রিভারে এ নিয়ে অনেকটা আলোচনা আছে। কোনও বিশাল রাজপ্রাসাদকোনও পিরামিডকোনও রাজতান্ত্রিক জাঁকজমকের আবিষ্কার সেখানে হয়নি। একটি মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছিলঅনেক মিমেতে সেটিকে নরেন্দ্র মোদির মূর্তি বলে ট্রোল করা হয়। সেটিকে অনেকে সেইন্টকিং বলেছেনস্কলারকিংও বলা যেতে পারে। প্রত্নবিদ দিলীপ চক্রবর্তী বলেছিলেনশ্রমণ। সরস্বতী সভ্যতা খুব সম্ভবত গুরুতান্ত্রিক ছিল। জ্ঞান বলা হত গুরুকেতন্ত্রযানেপালযুগে। আমি সিন্ধুসরস্বতী সভ্যতার ওই মূর্তিটিকে জ্ঞান বলতে চাই।

বাঙালি শব্দটা প্রথম এই পুরো পূর্বভারতীয় ভূখণ্ডের অধিবাসীদের সম্পর্ক ব্যবহৃত হতে থাকে মুসলমান আগমনের পরেমধ্যযুগে। ভুসুকুর চর্যায় বঙ্গালি শব্দের উল্লেখকিন্তু ওখানে সাংকেতিক অর্থেসাধনমার্গের একটি বিশেষ অবস্থা বোঝাতে বঙ্গালি শব্দের ব্যবহার। এবং তা বর্তমানে বাঙালি বলতে যা বোঝায়তা নয়।

মুসলমান আগমনের পরে সুবে বাঙ্গালা নামে কে পুরো গৌড়বঙ্গ মিলিয়ে সম্পূর্ণ অঞ্চলটিকেই ডাকা হলসেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। গৌড়ে আর অবশিষ্ট কিছু ছিল না। পুরোটাই evacuate করা হয়েছিল। সেনদের লক্ষণাবতীর সমস্ত ধনরাশিসমস্ত সম্পদ – পুরোটাই পূর্বে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। সুবর্ণগ্রামএইসময় থেকে পূর্বেঅর্থাৎ বঙ্গে যে অঞ্চলটি ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে উঠবেসে নামটি যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী। মধ্যযুগে যে বাঙ্গালা নামক নগরীর কথা জানা যায় বিদেশী পর্যটকদের বিবরণীতে বারবারতার ঐশ্বর্য তো অসাধারণ ছিল।

এজন্যই প্রায় দেড়শো বছর ধরেপোড়ারাজা দ্বিতীয় বল্লালসেনের সময় পর্যন্ত অনবরত পূর্ববঙ্গের ওপরে হামলা চলেছেআক্রমণ চলেছে। সেগুলি ব্যর্থ হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। ১২৮৯ সালেও পূর্ববঙ্গে বহাল তবিয়তে মধুসেন রাজত্ব করছেনতার অকাট্য প্রমাণ আছে। কিংবদন্তীর দ্বিতীয় বল্লালসেনের সঙ্গে যার যুদ্ধ হয়েছিলসেই বাবা আদম বা বায়াদুম্বের ব্যাপারে অকাট্য প্রমাণ আছে।

শেষ পর্যন্ত যখন দখল হল বঙ্গবঙ্গালঅর্থাৎ পূর্ববঙ্গআমাদের সেই জ্বলে যাওয়া সভ্যতাপুড়ে যাওয়া সভ্যতার সঙ্গে এই জাতির বাঙ্গালি নামে পরিচিত হওয়ার একটা যোগ আছে। এ নামে আমরা আমাদের জাতিকে ডাকিনিমধ্যযুগে মুসলমান শাসকই এদেশের লোকেদের বাঙ্গালি বলে ডাকতে শুরু করে। অন্যের দেওয়া নামে পরিচিত হওয়া ইতিহাসে প্রচুর ঘটেছে। ভারতের লোক হিন্দু বলে পরিচিত হয়েছিল ইরানী ভাষায়।

এখানে একটু প্রসঙ্গান্তর। সিলেট ও চট্টগ্রামের ভাষা মান্য বাংলার থেকে খুব আলাদাআমরা জানি। মান্য উড়িয়ামান্য অসমিয়া বরং মান্য বাংলায় কথা বলা মানুষ সহজে বোঝেন। সিলেট এবং চট্টগ্রাম – এ দুটী প্রান্তিক অঞ্চল প্রাচীন এবং মধ্যযুগে দেশজ শাসনে থাকাকালীনএই ঐতিহাসিক সময়টায় সেভাবে গৌড়ের অধীনে ছিল না। ফলে ভাষাটা মান্য বাংলার সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে ইন্টিগ্রেটেড হয়নি। মুসলমান আক্রমণের পরে ইন্টিগ্রেটেড হয়েছে রাজনৈতিকভাবেধর্মীয়ভাবেকিন্তু মান্য বাংলা ভাষার সঙ্গে ইন্টিগ্রেটেড হওয়ার সুযোগ মেলেনিকারণরাজপুরুষরাসরকারসবাই ফার্সি ব্যবহার করেন। এর তুলনায় মৈথিলিঅসমিয়াউড়িয়াভাষী অঞ্চল প্রাচীন কাল থেকেই আমাদেরগৌড়ের শাসনে থেকেছেফলে এ ভাষাগুলি মান্য বাংলার বেশি কাছাকাছি।

এর তাৎপর্য হলমধ্যযুগে তুর্কপাঠানমোগলইরানিআরব মুসলমান শাসনেই বাঙালি জাতির উৎপত্তি – এরকম যে একটা তত্ব বাজারে চালু আছেসেটি সর্বৈব ভুল। জাতিগঠনের কাজ করার জন্য স্বজাতির শাসক থাকা বাঞ্ছনীয়। বরংউপরের উদাহরণ থেকে দেখবেনমধ্যযুগেই বাঙালি সাংস্কৃতিক একীকরণ বাধা পেয়েছে। ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় আকারে দুর্গাপুজো তো শুরুই হল সিরাজকে সরানোর পরে।

বাঙালি শব্দটি এইভাবে চর্যার সময় থেকে ক্রমে বিবর্তিত হয়েছে। চৈতন্য নিজেকে বাঙালি বলতেন নাপুরো আন্দোলনটিই গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন নামে পরিচিত। রামমোহনও নিজেকে বাঙালি বলতেন না। এদের বাদ দিলে তো বাঙালির ইতিহাস লেখা যাবে না। অর্থাৎ গঙ্গারিডাই জাতিকেও বাঙালির মধ্যে ধরতে হবেসেটাই যৌক্তিক। বাঙালির সংজ্ঞা নমিনাল নয়বাঙালির সংজ্ঞা নামমাত্র নয়।

বাঙালির সংজ্ঞা ভাষাবাদীও নয়। উনিশশো কুড়ি সাল নাগাদ যশোরের একদল গ্রামবাসী পুলিসের কাছে এজাহার দিতে গিয়ে বলছেন এ গ্রামে মোটে পাঁচ ঘর বাঙালিবাকি সব মুসলমানআমি অনেকবার সুনীল গাঙ্গুলির “আমি কি বাঙালি” বইটা থেকে উদ্ধৃত করেছি বহুবার। শরৎচন্দ্রে বাঙালি ও মুসলমানের ফুটবলের উল্লেখ আছেসেটা শরতের সাম্প্রদায়িকতা নয়বাঙালি শব্দের ঐতিহাসিক অর্থই বোঝায়। মধ্যযুগে এদেশের দেশজ সংস্কৃতির ধারক বাহককে বাঙালি বলতেন বিদেশী শাসকশাসকদের এজেন্ট সুফিপীরগণ এবং তাদের দ্বারা ধর্মান্তরিত মুসলমানেরা। বাংলার মুসলমান নিজেকে বাঙালি মনে করত না। উনিশশো পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামির উত্থান, আওয়ামি মুসলিম লিগ নামে দলটির জন্মএরপর পশ্চিম পাকিস্তানকে সফলভাবে চ্যালেঞ্জ করার জন্য হিন্দু ভোটের প্রয়োজনে দলের নাম থেকে মুসলিম ছেঁটে ফেলাপশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা বাংলাভাষী মুসলমানের বংগালি বলে চিহ্নিত হওয়াহেয় এবং অপমানিত হওয়া। এবং সেই ভাষা আন্দোলন। ফলে বাঙালির একটা ভাষাবাদী সংজ্ঞা তৈরির পেছনে পাকিস্তানেরবিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানের বড় ভূমিকা আছে।

বাঙালিত্ব

বাঙালিত্ব কিসেটা বুঝতে গেলে সর্বাগ্রে বাঙালিকে একটা fetish এ পরিণত করা বন্ধ করতে হবে। বাঙালিকে ইতিহাসের ফ্রেমে পুনর্স্থাপিত করতে হবেবাঙালি বড় বেশি শেকড়বিচ্ছিন্নভাবে বেঁচে আছে। কালী হলেন আমাদের শক্তি উপাসনার মূর্ত প্রতীক।  ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বাঙালিকে দেখতে হবেসেখানে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ সৃষ্ট কালীপ্রতিমার প্রাচীনত্ব বিবেচ্য নয়গঙ্গারিডাই বা পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে মা কালী ছিলেন কি ছিলেন নাসেটা ধর্তব্য নয়। আগেই বলেছিচৈতন্যও নিজেকে বাঙালি বলতেন না। তাতে কিছু যায় আসে নাওঁকে বাদ দিয়ে বাঙালি হয় না।

তো বাঙালিত্বকে এভাবেই দেখতে হবে। বাঙালিত্ব হল আমাদের চার হাজার বছরের ইতিহাসের নির্যাস। এই ভূখণ্ডে সারস্বতরা এসেছিলেন। সরস্বতী থেকে গঙ্গার দিকে একটা সঞ্চারণ হয়েছিলযাঁরা আপার সরস্বতী বেসিনে থাকতেনতাঁরা বৈদিক ছিলেন। সরস্বতী ও সমুদ্রের মোহনার কাছে যাঁরা থাকতেনতাঁরা কিন্তু শক্তি উপাসক ছিলেন (সবথেকে বেশি মাতৃকামূর্তি পাওয়া গেছে লোথালে), এরাই গঙ্গা ও সাগরের মোহনায় চলে আসেনবাঙালির উৎসে এঁরাই। চন্দ্রকেতুগড় হোক বা পাণ্ডু রাজার ঢিবিমাতৃকামূর্তি আমাদের সভ্যতাকে চিহ্নিত করে। এই ব্রাত্য অ্যালপাইন আর্য সভ্যতার উত্তরাধিকারই বাঙালিত্বএই শক্তি উপাসনার উত্তরাধিকারই বাঙালিত্ব।

এই ভূখণ্ডে সারস্বতরা এসেছিলেনবাঙালির জন্ম হল। কপিল গঙ্গা ও সাগরের মোহনায় সাংখ্য রচনা করেনবাঙালির জন্ম হল।গঙ্গারিডাই সাম্রাজ্যবাঙালির জন্ম হল। মহাপদ্মনন্দসেই গঙ্গারিডাই জাতির লোকনন্দবংশ স্থাপনা করলেনএবং বাঙালির দাপটের জন্ম হল। শ্রীগুপ্তপুণ্ড্র থেকে গিয়ে যখন মগধে গুপ্তবংশ স্থাপন করছেনএই পূর্ব ভারতীয় জাতিটির জন্ম হল। শশাঙ্কযুগপালযুগসেনযুগ এসেছিলতাই বাঙালি। জয়দেব থেকে বড়ু চণ্ডীদাস থেকে শ্রীচৈতন্যতাই বাঙালি। গণেশদনুজমাধবপ্রতাপাদিত্যতাই বাঙালি। এরা কেউ নিজেকে বাঙালি বলেন নিকিন্তু তাতে আটকায় না। আজ যে জাতি Français নামে পরিচিততারা দুহাজার বছর আগে Gaul নামে পরিচিত ছিলেন। ফ্রান্সে এই Emmanuel Macron এর মারাত্মক লিবেরাল যুগেও যদি কেউ বলতে সাহস দেখায় যে গলদের ফরাসি বলা যাবে নাতাকে ইংলিশ চ্যানেলে ছুঁড়ে ফেলতে ওঁরা দ্বিধা করবেন না। কিন্তু বাঙালির দুর্ভাগ্য।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ

আধুনিক যুগের আগে জাতীয়তাবাদ ছিল নাজাতিচেতনা ছিল নাকথাটা বহুল প্রচলিতএবং সর্বাংশে ঠিক নয়। স্টিভেন গ্রসবি বলছেন্‌ বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টেও জাতিত্ব এবং জাতিচেতনা দেখা যাচ্ছে। যাইহোকউপমহাদেশে একটা আশ্চর্য হিস্টোরিওগ্রাফি দেখা যায়আধুনিক শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্বের উত্থানের বহু আগে থেকেই শ্রেণীসংগ্রাম ছিলশ্রেণীচেতনা ছিলএরা সবাই একমত। কিন্তু বঙ্কিম এ জিনিসটা “পশ্চিম থেকে আমদানি” করার আগে জাতীয়তাবাদ ছিল না।

ঈশ্বর গুপ্ত সম্পর্কে বলা হয়তাঁর আগে কেউ সমগ্র দেশের কথা এভাবে ভাবেনিবলেনিসবাই নিজের গ্রামনিজের সমাজ (কাস্ট), নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যেই আবদ্ধ ছিলএবং এ কথাও সম্পূর্ণ ঠিক নয়। কিন্তু ইংরেজ আসার পরে আধুনিক যুগে নিঃসন্দেহে ঈশ্বর গুপ্ত বাঙালি জাতিচেতনার প্রথম কবিতবে যখন সিরাজের পরাজয়ের পরে বাংলা জুড়ে দুর্গাপুজোর প্রচলনের উদ্যোগ হচ্ছেযা ইসলামিক মধ্যযুগে ওই স্কেলে সম্ভব ছিল না (আপনারা কলকাতা বিক্রয়ের দলিল দেখবেনপ্রথম বাক্যটিই হলইসলামের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থেকে আমরাতারপরে সাবর্ণদের নাম এবং বাকি সমস্ত ডিটেইল)

শেষ করব এই বলেযে জাতীয়তাবাদ সর্বদাই একটি কোর্স কারেকশন হিসেবে উঠে আসে। বাঙালিপশ্চিমমুগ্ধ বাঙালিহিন্দু কলেজের বাঙালিইয়ং বেঙ্গলের বাঙালি একটা নির্দিষ্ট পথে চলছিল। বঙ্কিম ছিলেন ইতিহাসের কোর্স কারেকশন। বঙ্কিম যখন বলছেন বাঙালির ইতিহাস চাই নইলে বাঙালি মানুষ হবে নাতখন একটা কোর্স কারেকশন করছেন। এবং বঙ্কিম ব্যক্তিগত উদ্যোগেই কাজ করেছেনকোনও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ছিল না। হরপ্রসাদ যখন কাজ করছেন তখনরাজেন্দ্রলাল মিত্রর এশিয়াটিক সোসাইটি পাশে ছিলপরে ইংরেজ আশ্রিত এশিয়াটিকের বদলে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ স্থাপিত হয়েছিলযদিও হরপ্রসাদ সে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন বৃদ্ধ বয়েসেতার কাজকর্মে হতাশ হয়ে। ঠিকই করেছিলেন। দীনেশ সেনের কাজ স্যার আশুতোষ এবং তাঁর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছত্রছায়ায়। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিকদার্শনিকসাংস্কৃতিক ডিসকোর্স নানা কারণে আগে গড়ে ওঠেনিএবং সপ্তডিঙার আগে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্পষ্ট রূপরেখা দেওয়ার কাজ কেউ করেনি। বাংলাদেশের মুসলমান এবং তাদের পশ্চিমবঙ্গীয় এজেন্টরা যেটা করেছেন বাঙালির নামেসেটাকে ভাষাবাদ বলা উচিতবাঙালি জাতীয়তাবাদ নয়। অল্পখ্যাত আমরা বাঙালি সংগঠন বাঙালি জাতীয়তাবাদী নয়কোনওদিন সেরকম দাবিও করে না। এরা আনন্দমার্গের স্রষ্টা প্রভাতরঞ্জন সরকার প্রদত্ত বিশ্বৈকতাবাদ নামে একটা আদর্শে বিশ্বাসীএবং সে আদর্শটা বস্তুত বিশ্বমানবতাই।

সব মিলিয়েএকটা দীর্ঘ সময়ের ভ্যাকুয়ামএকটা দীর্ঘ যতিচিহ্নের পরে নতুন অধ্যায় শুরু করেছে সপ্তডিঙার বাঙালি জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্স।

shoptodina.com
shoptodina.comhttps://shoptodina.com
সপ্তডিঙা। কথাটা শুনলেই মনে আসে বাঙালির সমুদ্রবাণিজ্যের এক গৌরবময় ইতিহাস। গৌড়ের বণিকরা সাতটি বিশাল নৌকার এই সমবায় নিয়ে সিংহল, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, চীন, রোম, গ্রীস, ক্রীট, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করে ফিরে আসতেন স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার নিয়ে। সপ্তডিঙা তাই বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির অভিজ্ঞান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Advertisingspot_img

Popular posts

My favorites