Wednesday, May 21, 2025
Homeমাৎস্যন্যায়বাঙালির ভূত: ভূতের চেয়েও খানিক বেশি

বাঙালির ভূত: ভূতের চেয়েও খানিক বেশি

বাঙালির শুধু ভূত নেই। ভূতের রাজাও আছে। তিনি বিশেষ বিশেষ মাঠে বিশেষ তিথিতে নির্জন দুপুরে সভায় বসেন। লিখছেন- রক্তিম মুখার্জ্জী 

বাঙালির ভৌতিক জগত এক বিশাল রহস্য। যা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা আজও হয় নি। আমরা ভূতের গল্প শুনতে, হরর মুভি দেখতে ভালোবাসি। অথচ ভৌতিক জগতের বিশ্লেষণে আমাদের ভারী আপত্তি। তখন আমাদের অপরিপক্ক বিজ্ঞানচেতনা জেগে ওঠে। ভূতের গল্পকে গ্রাম্য কুসংস্কারের বাতিল ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হই। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, ভৌতিক জগত আমাদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক মনস্ত্বত্ত্বের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।

বাংলার ভূতেদের বিষয়ে নানা গল্প শুনতে গিয়ে একটি বিষয় উপলব্ধি করেছি। বাঙালির সব ভূত “ভূত” নয়। কথাটা হেঁয়ালির মতো শোনালো বুঝতে পারছি। আসলে সচরাচর ভূত বলতে বোঝানো হয় মৃত ব্যক্তির আত্মা যে কিনা সূক্ষ্ম দেহে তার পরিচিত অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করে। এদেরই আবার শ্রাদ্ধকর্মে ও পুরাণে প্রেতযোনি বলা হয়। কিন্তু বাঙালির সব ভূত ঠিক এই প্রেতযোনি নয়। বরং তাদের দলে মিশে আছে এমন অনেকেই যারা কখনোই জীবিত প্রাণীর দলে পড়ে না। আবার কেউ কেউ মৃত্যু পরবর্তী স্তর থেকে অন্যতর স্তরে পৌঁছে গিয়েছেন।

যেমন ধরুন ব্রহ্মদৈত্য ও গোদানা। প্রথমেই নাম দুটো খেয়াল করুন। একজন দৈত্য, অন্যজন দানা অর্থাত দানব। মানুষ বা প্রাণী মারা গেলে প্রেত হয় একথা “শাস্ত্রে আছে”। কিন্তু মরার পর দৈত্য বা দানব হয় একথা তো নেই! কাজেই এই দুই অলৌকিকের কল্পনাতে চিরাচরিত ভূতপ্রেতের কল্পনার থেকেও বেশি কিছু আছে। বাংলার বেশ কিছু স্থানে ব্রহ্মদৈত্যের মন্দির এবং থান আছে। তারাশঙ্করের হাঁসুলি বাঁকের উপকথায় তিনি “বাবাঠাকুর” রূপে কালরুদ্রের সেবক এবং কাহারপাড়ার রক্ষাকর্তা। ব্রহ্মদৈত্য অহেতুক কাউকে কষ্ট দেন না। বরং তিনি যার সহায়; তাকে অন্য ভূতরাও সমীহ করে। তিনি যেন ভৌতিক জগতের এমন একজন কর্তা; যাঁর নৈতিক শাসনে সেই জগতের শৃঙ্খলা বজায় থাকে। আমরা বলতে পারি ব্রহ্মদৈত্য এমন এক অতীতের স্মৃতি, যাকে মানুষ প্রথমে ভয় পেয়েছে, তারপর সমীহ করেছে, শেষে শ্রদ্ধার আসন রচনা করেছে। ভূত থেকে তিনি উপদেবতা পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন।

গোদানার বিষয়টাও খানিকটা এইরকম। মৃত গোরু বা বাছুরের এই বিশেষ প্রেত সন্ধ্যার সময় সুন্দর একটি গোরুর রূপ ধরে পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায়। পথিক বা অন্যমনস্ক রাখাল তার অনুসরণ করে ছুটে মরে। কখনও সে দেখা দিয়েই অদৃশ্য হয়। সেও কিন্তু নিছক মেছো, নিশি বা ভুলোর মতো ভূত নয়; দানব। একটু বেশি সমীহের আসন।
এই দুই অলৌকিকের পিছনে গো আর ব্রাহ্মণের প্রতি সমীহের বিষয়টি আছে। তবে তা ছাড়াও আছে বাঙালির তান্ত্রিক জগতের এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য।

আমাদের ধর্মভাবনায় মাতৃকার সহচর সহচরীদের মধ্যে ভীষণ চেহারার বেতাল, যক্ষ, দানব, ভৈরব অনেকেই আছেন। এঁরা প্রায় সকলেই মাতৃকার মণ্ডলে পূজা পান। স্বতন্ত্র দেবতারূপেও এঁদের পূজা একসময় বাঙালির মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। বাঙালির অনেক ভূতই বাস্তবে এই উপদেবতাদের পরিবর্তিত রূপ। যেমন বাংলা প্রবাদে গল্পে বারো ভূতের কথা খুব প্রচলিত। কালীপুজোর আগে ভূত চতুর্দশীর রাতে পূজা পান চৌদ্দ ভূত (আরমুই ছারমুই পোড়ামুই অন্তাই দন্তাই খন্তাই বরি ঠরি প্রমুখ)। এই বারোভূত দেবী বনদুর্গার সহচর। চৌদ্দভূত মা কালীর সহচর। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিখ্যাত বারো ভূতের মন্দিরে বিষ্ণুর দশ অবতার বারো ভূতের দলে যোগ দিয়েছেন।

কেন আমাদের ভূত দানবরা আমাদের উপাস্য মাতৃকার বিশেষ সহচর বলে পরিগণিত হন? একটা কারণ অবশ্যই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। পৃথিবীর সর্বত্র মাতৃপূজক প্রাচীন সভ্যতাগুলি লৌহযুগের পর থেকে ক্রমাগত আক্রমণে লুপ্ত। একমাত্র টিকে আছি আমরা। তাই এ যেন বাস্তবের উদ্ধত প্রতিপক্ষকে এক সতর্কতা। এ যেন বলতে চাওয়া: আমাদের মৃত্যুর পরেও বিনাশ নেই। বরং অত্যাচারে, ক্ষুধায় যারা অকালে চলে গেছে, তারা আরো ভীষণ রূপে ফিরে আসবে নিজের ভূখণ্ডের চিরকালীন উপাস্য মায়ের শক্তি হয়ে। তাই তো ব্রিটিশ।অত্যাচারে ক্লিষ্ট বাংলার কবি মুকুন্দ অগ্নিযুগের গান লেখেন:

ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমররঙ্গে
তাথৈ তাথৈ থৈ দ্রিমি দ্রিমি দ্রম দ্রম
ভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে

বাঙালির শুধু ভূত নেই। ভূতের রাজাও আছে। তিনি বিশেষ বিশেষ মাঠে বিশেষ তিথিতে নির্জন দুপুরে সভায় বসেন। এমনকি তিনি যে বর দেওয়ার ক্ষমতাও রাখেন সে তো গুপী বাঘার কাহিনীর সূত্রে সবাই জানি।
ভেবে দেখুন, ভূত বলতে শুধুই মৃত ব্যক্তির আত্মা ভাবলে এই কল্পনার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। ভূতের এই দলবদ্ধ শাসনব্যবস্থার কল্পনা তখনই সম্ভব যদি এঁরা কেবলই dead entity এর বাইরে কোনো এক undead সত্ত্বা হন; যাঁদের কোনো ক্ষয় বা পরিবর্তন নেই। তাঁরা যেন চলমান সময়ের প্রবাহে এক একটি timeless loop এর মতো। অতীতের একটি বিশেষ ক্ষণ বা স্মৃতির সূত্রেই তাঁরা চিরকালের মতো জড়িয়ে গেছেন নিজের ভূখণ্ডের সাথে। আর সময়ের সাথে উন্নীত হয়েছেন নেহাতই অশরীরির থেকেও অনেক বেশি ভয়াল এবং অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য এক উপস্থিতিতে।

shoptodina.com
shoptodina.comhttps://shoptodina.com
সপ্তডিঙা। কথাটা শুনলেই মনে আসে বাঙালির সমুদ্রবাণিজ্যের এক গৌরবময় ইতিহাস। গৌড়ের বণিকরা সাতটি বিশাল নৌকার এই সমবায় নিয়ে সিংহল, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, চীন, রোম, গ্রীস, ক্রীট, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করে ফিরে আসতেন স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার নিয়ে। সপ্তডিঙা তাই বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির অভিজ্ঞান।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Advertisingspot_img

Popular posts

My favorites