Wednesday, May 21, 2025
Homeসপ্তডিঙা পত্রিকাআয়ুর্বেদ ও তন্ত্র

আয়ুর্বেদ ও তন্ত্র

আয়ুর্বেদ আর তন্ত্র পরস্পরকে অতি প্রাচীনকাল থেকেই সমৃদ্ধ করেছে। কারণ এই দুইয়েরই মূল প্রেরণাশক্তি হল জগত ও জীবনের বিষয়ে জ্ঞানার্জনের নিরন্তর আগ্রহ। তন্ত্র সেদিনই জন্ম নিয়েছিল যেদিন বাঙালির জ্ঞানকক্ষের প্রথম প্রদীপ আদিবিদ্বান কপিল বুঝেছিলেন জগত ত্রিবিধ দুঃখময়। রূপদর্শী মনস্বীর প্রজ্ঞায় প্রকৃতির মহাচক্রে নিরন্তর ঘুরে চলা জীবের অনর্থক জীবনসংগ্রাম যে নির্বেদ দুঃখবাদের জন্ম দেয় সেই দুঃখবাদ থেকে উত্তরণের মার্গই তন্ত্র। তন্ত্র বোধহয় এ যাবৎ পৃথিবীতে আলোচিত সাধনমার্গসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা জীবনসম্পৃক্ত। তার বিশাল হৃদয়ে ঐহিক কামনা থেকে পারত্রিক সুখ; জাতীয় সঙ্কট থেকে মোক্ষবাঞ্ছা সবারই স্থান আছে। তন্ত্রের আদিরূপ বেদাতীত। কারণ এখানে সাধক জগতের স্বরূপ বিশ্লেষণ করেন নির্মোহ বস্তুবাদী দৃষ্টিতে। অনুধাবন করেন বিশ্বচরাচরে পরিব্যাপ্ত প্রকৃতিরূপিণীর তাত্ত্বিক প্রকাশ। তার পরে পুনরায় এই জগতের মধ্যেই বিশ্বপ্রসবিনীর গর্ভ থেকে বারংবার সদ্যোজাতের মতো জন্মানোর বলিষ্ঠ আকাঙ্খা ব্যক্ত করেন সমষ্টির কল্যাণে। সেজন্যই বলা যায় যে তন্ত্র কোনো কল্পনাবিলাসীর আকাশকুসুমচয়ন নয়; যা তনুকে ত্রাণ করে সেটাই তন্ত্র। সেজন্য সমষ্টির কল্যাণে দুঃখপীড়িত জাতির একান্ত বাস্তব বেদনার লাঘবেও তার সহৃদয় উপস্থিতি আয়ুর্বেদের ও চিকিত্সাশাস্ত্রের পথে। পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে বিশ্বযোনি মাতৃকার বন্দনায় ; অবলোকিতেশ্বরের মোক্ষসুখ প্রত্যাখানে; বজ্রযানী সিদ্ধাচার্যের সহজপথে বিচরণে; বৈষ্ণব আন্দোলনের সঙ্ঘশক্তি ও শাক্ত পদাবলীর উদার বার্তায় যে ভাব ফুটে উঠেছে ; চরক সুশ্রুত জীবক চক্রপাণির ব্যাধিনিরাময়ের জীবনব্যাপী প্রচেষ্টার মধ্যেও সেই ভাবই ব্যক্ত হয়েছে। তাই অনুমান করা কঠিন নয় যে সাঙ্খ্যপ্রণোদিত তন্ত্রের বস্তুবাদী দৃষ্টিই চিকিত্সা শাস্ত্রের জন্ম দিয়েছিল। কারণ তন্ত্র শুধু কৃষিনির্ভর আদিম কৌমভিত্তিক সমাজের টোটেম পূজা বা রহস্যময়তা নয়; একটি নগরকেন্দ্রিক অথচ কৃষিপ্রধান সমাজের গ্রামীণ দার্ঢ়্য ও নাগরিক বৈদগ্ধের অসামান্য মেলবন্ধন। সুপ্রাচীন কাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত এই দুই শাস্ত্রের পারস্পরিক সমৃদ্ধিকরণের পর্যালোচনাই আয়ুর্তন্ত্রের আলোচ্য বিষয়।

আয়ুর্বেদের উৎসে তন্ত্র

বৈদিক ও বেদপ্রভাবিত শাস্ত্রাদির মধ্যে যে শাস্ত্রগুলিতে চিকিত্সা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে সেগুলি হল: অথর্ববেদ; আয়ুর্বেদ; চরকসংহিতা; সুশ্রুতসংহিতা। এদের মধ্যে অথর্ববেদ সর্বাধিক প্রাচীন। এই অথর্ববেদ এবং আয়ুর্বেদ উভয় গ্রন্থেই বৈদিক দেবতা সোম ঔষধিসমূহের অধিপতি এবং ভেষজবিদ্যার অধিষ্ঠাতা রূপে গণ্য হয়েছেন। গীতায় আছে:

পুষ্ণামি চৌষধি সর্বাঃ সোমো ভূত্বা রসাত্মকঃ। সোমরস সোম প্রভৃতি শব্দ বলবর্ধক পানীয় অমৃত তথা জীবনদায়ী ভেষজের সমার্থক হয়ে উঠেছে বৈদিক সাহিত্যে। বেদ ও পুরাণের অনুষঙ্গে জানা যায় এই সোম বলতে আদিতে বোঝাত পুরাণের অত্রিমুনির পুত্র চন্দ্রকে। চরকসংহিতায় ভেষজশাস্ত্রের মূখ্য উপদেষ্টা সোমকেই আত্রেয় ঋষি বলা হয়েছে। অর্থাত্ অত্রিপুত্র চন্দ্র বা সোম আর বৈদিক সোম বস্তুত একই। পরবর্তীকালে সেই চিকিত্সাশাস্ত্রজ্ঞের সাযুজ্যে সোম শব্দটি আনন্দ তথা আরোগ্যভাবের দ্যোতক হয়ে উঠেছে।

যজুর্বেদ এবং অথর্ব বেদে চিকিৎসা শাস্ত্র সম্বন্ধীয় উক্তিগুলোর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হল ঋগ্বেদের সোমকে কেন্দ্রে বসিয়ে (যেমন ধরুন কোনও পুরুষ দেবতাকে কেন্দ্রে বসিয়ে এবার সেই দেবতার শক্তি হিসেবে কোনও নারীদেবতার কল্পনা – যেটা আর্যাবর্তের সঙ্গে ব্রাত্য অবৈদিক আর্যের সিস্টেমের একটা পরিচিত কম্প্রোমাইজ ফর্মুলা) তার চারধারে নানা ওষধি ভেষজের সমাহারসংক্রান্ত শ্লোক। এখানে সোম হচ্ছে সভারেন, বাকিরা সবাই প্রজা; সোম গুরু, বাকি সব ওষধি তার শিষ্য। গুরুশিষ্য সংবাদের ধাঁচে যজুর্বেদ অথর্ববেদ এবং সংহিতার যুগে বৃক্ষায়ুর্বেদ লেখা হয়েছে, সেখানে সোম কেন্দ্রে আছেন, বাকিরা তার কাছে এসে রিপোর্ট করছে, যে তাদের কার কি ওষধিগুণ, কে কোন রোগ নিরাময় করে, কোন বৃক্ষ কোন গুল্ম কোন অঞ্চলে ভালো ফলে।

পুরাণ অনুযায়ী এই সোম বা চন্দ্রের পিতা সপ্তর্ষিগণের অন্যতম ঋষি অত্রি এবং মাতা তপস্বিনী অনসূয়া। অনসূয়া কর্দম প্রজাপতির কন্যা। কর্দমের পুত্রই সাঙ্খ্যের প্রবক্তা আদিবিদ্বান কপিল। তাঁর সাঙ্খ্যমত আদিতন্ত্রের দ্বারা গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তিনিই প্রকৃতিকেন্দ্রিক জগতের বস্তুবাদী দর্শন বর্ণনা করেছিলেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। পুরাণের সাক্ষ্য অনুযায়ী কপিলের বাসভূমি ছিল নদীমাতৃক পূর্বভারতের সমুদ্রসন্নিকটে। বাংলার গঙ্গাতীরবর্তী বহু তীর্থ এবং গঙ্গাসাগরসঙ্গম কপিলমুনির সাধনভূমি রূপে পরিচিত। তাঁর পিতার কর্দম প্রজাপতি নামটিও সম্ভবত জলকাদাময় প্রাচীন বঙ্গের সাযুজ্যেই প্রাপ্ত। কপিলের ভগিনী হলেন অনসূয়া। কপিল ও অনসূয়ার সম্বন্ধে প্রচলিত কিংবদন্তি দেখে মনে হয় তাঁরা উভয়েই বঙ্গের মাতৃপরায়ণ সভ্যতার ধারা বহন করেছিলেন। এই অনসূয়ার পুত্রই ঔষধীপতি সোম। অথর্ববেদের চতুর্থ সূক্তে আছে:

অম্বয়ো যন্ত্যধ্বভির্জাময়ো অধ্বরীয়তাম্। পৃঞ্চতির্মধুনা পয়ঃ।।

অপো দেবীরূপহ্বয়ে যত্র গাবঃ পিবন্তী নঃ। সিন্ধুভ্যঃ কর্ত্বং হবিঃ।।

অপস্বন্তরমৃতমপ্সু ভেষজম্। অপামুত প্রশন্তিভিরন্বা ভবথো বাজিনো গাবোঃ ভবথ বাজিনীঃ।।

পঞ্চম সূক্তে:

যো ব শিবতমো রসস্তন্য ভাজয়তেহ নঃ। উশিতীরিব মাতরঃ।।

ঈশানা বার্যাণাং ক্ষয়ন্তীশ্চর্ষণীনাম্। অপো যাচামি ভেষজম্।।

এই দুই সূক্তের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল জলমাতৃকার বন্দনা এবং জলাধিষ্ঠাত্রী মাতৃগণের কাছে স্তন্যদুগ্ধের মতো কল্যাণকারী ভেষজের জন্য প্রার্থনা। পুরাণে বর্ণিত অনসূয়া কর্তৃক ত্রিদেবকে শিশুরূপে স্তন্যদানের কিংবদন্তিটি এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। এই অনসূয়া জলমাতৃক বঙ্গের কন্যা এবং তাঁরই পুত্র সোম ঔষধীর উপদেষ্টা। সুতরাং এই সিদ্ধান্ত মোটেও অমূলক নয় যে নদীমাতৃক বঙ্গের যে মনস্বীতার ধারায় কপিল সাঙ্খ্যপ্রবক্তা হয়েছিলেন; সেই মনস্বীতাই চিকিত্সাশাস্ত্রেরও প্রসূতি। অনসূয়া ও তাঁর পুত্র আত্রেয় সোম সেই ধারাই বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বৈদিক সমাজে এবং তারই প্রভাবে রচিত হয়েছে আয়ুর্বেদ।

বেদ এবং আয়ুর্বেদে সাংখ্যের প্রভাব স্পষ্ট দেখি, যখন ত্রিধাতুর উল্লেখ পাই। কোনও বেদেই স্পষ্ট করে ত্রিধাতু সম্পর্কে বলা নেই, কিন্তু ঋক ১/৩/৬ সূক্তে ত্রিধাতুর নামমাত্র উল্লেখ আছে। এর অর্থ সায়ন করেছেনঃ ত্রিধাতু হল বায়ু, পিত্ত, কফ, এবং তারাই সোম, তেজস ও অপ্‌। সায়নভাষ্য নিঃসন্দেহে অনেক পরে লেখা এবং যখন লেখা তখন সাংখ্যকেন্দ্রিক আয়ুর্বেদের প্রভাব স্পষ্ট এসেছে। এইভাবে সংখ্যা দিয়ে গুণ-তত্ত্ব-উপাদান বিচার নিঃসন্দেহে সাংখ্যের অবদান।

খাদ্যাভ্যাস বাণিজ্য ও তন্ত্র

বাঙালির আদিতন্ত্রের যে খণ্ডচিত্র রূপকথার গল্পে ধরা আছে সেখানে বৈদ্য বণিক তান্ত্রিক এই তিনে মিলে একাকার হয়ে গেছে। তৎকালীন গন্ধবণিকেরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে দেশ বিদেশে যেসব পণ্যের বাণিজ্য করতেন তার মধ্যে প্রধান ছিল পুণ্ড্র ইক্ষু, গৌড়ের গুড়, তেজপাতা, পিপ্পলি, মশলাদ্রব্য, গৌড়ের উৎকৃষ্ট আজ্য প্রভৃতি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আজ্য অর্থে ঘৃতও বোঝায় আবার ঔষধিও বোঝায়। বাঙালির রন্ধনশালায় ব্যবহৃত প্রতিটি মশলাদ্রব্যই ( পাঁচফোড়ং, হলুদ, পিপ্পলিজাত গোলমরিচ, তেজপাতা, কর্পূর, এলাচ লবঙ্গ দারুচিনি) ভেষজ গুণসম্পন্ন এবং তন্ত্রে এদের প্রতিটিই কোনো না কোনো সাধনার উপাচার হিসেবে কল্পিত। বাঙালির খাদ্যতালিকায় যে সমস্ত দানাশষ্য আছে তাদের মধ্যে সবথেকে পুষ্টিগুণ ও ভেষজগুণ আছে মাষকলাইয়ের। আর এই মাষকলাইয়ের ডাল বা মাষভক্ত দেবী চামুণ্ডার প্রিয় বলিরূপে তন্ত্রে উল্লিখিত। অদ্যাবধি সমস্ত তান্ত্রিক পূজায় মাষভক্তবলি অপরিহার্য।

তন্ত্র ও আয়ুর্বেদ মিশে আছে বাঙালির রান্নার পদ্ধতিতেও। খাদ্যের সুষ্ঠু পরিপাকের জন্য ডালভাঙার হাতা, শিলনোড়া প্রভৃতি উপকরণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই উপাদানগুলিই আবার তন্ত্রের উপমায় স্বচ্ছন্দে ব্যবহৃত হয়েছে। ছয়টি কাঁটাযুক্ত লোহার যে দণ্ডটি বাঙালির রান্নাঘরে ডাল ভাঙতে ব্যবহৃত হত তাকে ষটচক্রসমন্বিত সুষুম্নার সাথে তুলনা করে মাষভক্তের মধ্যে দেহতত্ত্বের মহাসুখের কল্পনা করে বাউল সাধক গেয়েছেন:

রান্নাঘরে ঢুকলি বৌমা রান্না শিখলি না।

এই গানেসহজিয়া গুহ্যতত্ত্ব আদা হলুদ তেজপাতা মরিচ প্রভৃতি মশলা এবং শিলনোড়ার রূপকে বর্ণিত হয়েছে। বাটনা বাটার শিল ও নোড়ার আকৃতির সাথে অতি প্রাচীন মাতৃপূজক সভ্যতার লিঙ্গ ও যোনির প্রতীক শিলাখণ্ডগুলির যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। এখনও ষষ্ঠীর ব্রতের সময় শিলকেই ষষ্ঠীর প্রতিমূর্তি বলে গণ্য করা হয়। বেশ বোঝা যায় প্রকৃতিপূজক বাঙালির তুচ্ছাতিতুচ্ছ দৈনন্দিন জীবনের উপাদানগুলির সৃজন করা হয়েছিল তন্ত্র ও আয়ুর্বেদের যুগপৎ সংশ্লেষণের মাধ্যমেই।

দুর্গাপূজার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল নবপত্রিকা। এই নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ হল :

বিল্ব অশোক জয়ন্তী কদলী দাড়িম্ব ধান্য হরিদ্রা মানক(মানকচু) কচ্চ(কচু)। এই উদ্ভিদগুলির প্রতিটিই ঔষধীগুণসম্পন্ন। আবার এদের প্রত্যেকটিতেই দেবীর নয় রূপের অধিষ্ঠান কল্পিত হয়েছে। (যথাক্রমে শিবা শোকরহিতা কার্ত্তিকী ব্রহ্মাণী রক্তদন্তিকা মহালক্ষ্মী দুর্গা চামুণ্ডা কালিকা)। আবার জয়ন্তী দাড়িম্ব ও কচু এই উদ্ভিদগুলির প্রণামমন্ত্রে বলা হয়েছে যথাক্রমে নিশুম্ভশুম্ভবধে রক্তবীজবধে এবং মহিষাসুরবধে এরা দেবীকে সাহায্য করেছিল। সম্ভবত অতীতে যুদ্ধকালে ক্ষতনিরাময়ে এই বনৌষধিগুলি প্রযুক্ত হত। আবার এই নবপত্রিকা বাঁধা হয় আর একটি ভেষজ উদ্ভিদ দিয়ে। সেটি হল শ্বেত অপরাজিতার লতা। অর্থাত্ নবপত্রিকার মধ্যে তন্ত্র ও আয়ুর্বেদ নিবিড়ভাবে মিশে রয়েছে।

আবার দুর্গাপূজায় দেবীকে শ্রমোপদনের জন্য দেওয়া হয় মধুপর্ক। এর উপাদান হল:

মধুনা দধি সংযুক্তা ঘৃতেন চ পরিপ্লুতা।

এই বলবর্ধক খাদ্যটিও বাঙালির ভেষজজ্ঞানের পরিচয় দেয়।

বাঙালির আর এক খাদ্যাভ্যাস যা তাকে সারা ভারতে বিশিষ্টতা প্রদান করেছে তা হল মৎস্যভক্ষণ। বাঙালির মৎস্যপ্রীতি এতটাই কিংবদন্তি পর্যায়ের যে এখানে দেশাচারের ভিত্তিতে ইলিশ, খলসে, ভেটকি, মাগুর ও রুইমাছ নিরামিষের পর্যায়ভুক্ত হয়েছে।

ইল্লিশঃ খল্লিশশ্চৈব ভেটকি মদ্গুরমেব চ

রোহিত সর্বমৎসেন্দ্র পঞ্চমৎস্যাঃ নিরামিষাঃ।।

এমনকি এমন বিধানও পাওয়া যায় যে বেগুন সহযোগে রন্ধন করলে সমস্ত মৎস্যই বঙ্গে নিরামিষরূপে গণ্য করা যেতে পারে। মৎস্য এমন এক খাদ্য যা একইসাথে দেহের পুষ্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহের যোগান দেয় অথচ মাংস বা অন্যান্য আমিষ খাদ্যের মতো গুরুপাক নয়। সেইজন্য বৈদ্যগণ মুমূর্ষু রোগীর আরোগ্যের জন্য পথ্যরূপে মৎস্যের ব্যবহার করতেন। নদীসমাকুল বঙ্গের সমুদ্রাশ্রয়ী গৌড়ীয়গণের সমাজের সর্বস্তরে মৎস্যভক্ষণ তাই এত জনপ্রিয়। আবার এই মৎস্যপ্রীতির সাথে জড়িত আছে বাঙালির পূর্বপুরুষদের প্রাচীন বাসভূমি সরস্বতীর মোহনার স্মৃতি। বেদে আমরা সেই মৎস্যভোজী সারস্বত ঋষির সন্ধান পাই যিনি দুর্ভিক্ষের সময় শুধু নদীর মৎস্যভক্ষণ করে জীবিত ছিলেন এবং নিখিল বেদের সম্যক জ্ঞাতা হয়েছিলেন।

আবার তন্ত্রেও এই মৎস্যপ্রেম এক অন্য মাত্রা পেয়েছে। পঞ্চমকারের তৃতীয় মকার হল মৎস্য। গুহ্যতত্ত্বে এর ব্যাখ্যা হল: ঈড়া ও পিঙ্গলাপথে প্রশ্বাস ও নিশ্বাসরূপী দুই মৎস্য নিরন্তর বিচরণ করে। কুম্ভকের দ্বারা এই মৎস্যদ্বয়কে ভক্ষণ করে অর্থাত্ শ্বাসগতি নিরুদ্ধ করে সুষুম্নাপথে যিনি কুলকুণ্ডলিনীর জাগরণ ঘটান তিনিই মৎস্যসাধক।

চর্যাপদের রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ এবং শৈবতন্ত্রের আলের কোম্ভীরা বর্ণ প্রভৃতি পদে সেই মৎস্যসাধনার কথাই বলা হয়েছে। লালনের গানেও আমরা পাই:

ত্রিবেণীর ঐ ত্রিধারে মীনরূপে সাঁই বিরাজ করে।

নিত্যানন্দ অবধূতের বৈষ্ণব ধর্মে সম্মিলিত সহজযানের উদাত্ত কন্ঠ গেয়েছিল;

ভরযুবতীর কোল মাগুর মাছের ঝোল

বল হরিবোল।

নিত্যযৌবনা বসুন্ধরার কোলে বসে মৎস্যসাধনার মাধ্যমে হরিধ্বনির দ্বারা মহাসুখ লাভের কথাই আলোচিত হয়েছে এখানে। আবার যুগনদ্ধ কায়াসাধনায় মৎস্যভক্ত ভক্ষণ করেও যে এই উদার বৈষ্ণব আন্দোলনের প্রতি অনুগত থাকা যায় সেটাও প্রতীকের আড়ালে বলা হয়েছে।

যখন বাঙালি তন্ত্রের পূজায় পোড়া শোলমাছের ভোগ দেয় তখন একইসাথে তন্ত্রের মৎস্যসাধনা; একটি উৎকৃষ্ট খাদ্যাভ্যাস এবং খরার প্রকোপে শুকিয়ে যাওয়া সরস্বতীর প্রবাহের স্মৃতি এই তিনে মিলে তান্ত্রিক বাঙালির চেতনায় একাকার হয়ে যায়।

আমাদের গন্ধবণিকগণ ভেষজ ও মশলাদ্রব্যের বাণিজ্য করতেন। এক তোলা পিপ্পলির মূল্য কবি ভার্জিলের সময়ের রোমে দশ স্বর্ণমুদ্রা ছিল। বাঙালি শুধু নিজেই সুস্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন ছিল তাই নয়; সারা বিশ্বকে এর সুফলও সাধ্যমতো দিয়েছিল। বাঙালির স্বর্ণাভ বর্ণের গুড় অর্ধেক পৃথিবীর জিহ্বায় মধুররসের জোগান দিত। আখের রস থেকে গুড় তৈরির আগে আজও পুণ্ড্রাসুরের পূজা করা হয়। যার থেকে ধারণা করা যায় এই গুড় উৎপাদনের সূত্রপাত হয়েছিল বাঙালির প্রাচীন পাঁচটি জনজাতির অন্যতম পুণ্ড্রজাতির হাত ধরে। সুতরাং বাঙালির সাথে আখ ও গুড়ের সম্পর্ক বহু প্রাচীনকাল থেকেই। চরকসংহিতা থেকে জানা যায় গুড়ের ভেষজ গুণের কথা। সেখানে চিকিত্সার জন্য আগত ব্যক্তির বমন ও বিরেচনের মাধ্যমে দোষমুক্তির জন্য যে প্রথম ঔষধির কথা বলা হয়েছে( গরমজল সহযোগে এটি পান করানো হত) তার নয়টি উপাদানের মধ্যে চতুর্থটিই গুড়। টীকায় বলা আছে পুরোনো গুড় ব্যবহৃত হত (এবং সেক্ষেত্রে গৌড় থেকে বণিকদের নিয়ে আসা গুড় হওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি)।

হরিতকানাং চূর্ণানি সৈন্ধবামলকে গুড়ং।

বচাং বিড়ঙ্গং রজনীং পিপ্পলীম্ বিশ্বভেষজম্।।

আবার গুড়ের অতিরিক্ত ব্যবহারের কুফল হিসেবে ইতিহাসের আকাশে বাঙালির অনেক নক্ষত্রকেই আমরা দেখতে পাই যাঁরা মধুমেহ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। অথচ গুড় খাওয়ার এই অভ্যাস এবং মধুমেহের প্রকোপ সত্ত্বেও যে বাঙালির জাতীয় স্বাস্থ্য মোটের ওপর যথেষ্ট ভালো ছিল সেটা সম্ভবত তান্ত্রিক বাঙালির স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন এবং উৎকৃষ্ট চিকিত্সাব্যবস্থার ফলে। বাঙালির খাদ্যতালিকায় থাকা চৌদ্দশাকের সম্ভবত এই বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কারণ এই চৌদ্দশাক মূলতঃ তিক্তস্বাদের।

ওলং কেমুকবাস্তূকং, সার্ষপং নিম্বং জয়াং।

শালিঞ্চীং হিলমোচিকাঞ্চ পটুকং শেলুকং গুড়ূচীন্তথা।

ভণ্টাকীং সুনিষন্নকং শিবদিনে খাদন্তি যে মানবাঃ,

প্রেতত্বং ন চ যান্তি কার্ত্তিকদিনে কৃষ্ণে চ ভূতে তিথৌ।”

এখনও কালীপূজার সাথে চৌদ্দশাকের এই সংযোগ প্রাচীন তন্ত্র ও চিকিত্সাবিদ্যার সংযোগেরই সাক্ষ্য দেয়। বাঙালির ঘরে ঘরে যে গুড়ের পাশাপাশি নিম ও করলা দিয়ে নানারকম পদের সমান জনপ্রিয়তা এটা সম্ভবত প্রাচীন যুগ থেকেই আয়ত্ত করা একটি অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন পদক্ষেপ।

বাঙালি শর্করা খেয়েছে; তার বিষময় পরিণাম অনুধাবন করেছে; আবার তার প্রতিকারও খুঁজে বের করে সেই বিষয়ে জগতকে জানিয়েছে।

বাঙালির বণিকদের সাথে ভেষজবিদ্যার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বাঙালির বৈদ্যজাতির মধ্যে দত্ত সেন গুপ্ত প্রমুখ বণিক পদবী প্রায়ই দেখা যায়। বাণিজ্য বঙ্গের স্বর্ণযুগের নির্মাণ করেছিল। গৌড়ের লক্ষ্মী সমুদ্রসম্ভবা ছিলেন। আর এই বাণিজ্যের উদ্দীপনা আসত তান্ত্রিক সংস্কৃতির হাত ধরেই। যখন দেখি বাঙালির আদি উপাস্যা দেবী চণ্ডী শ্রীমন্ত সদাগরের রক্ষার্থে সিংহলে আবির্ভূতা হয়েছিলেন; যখন মাৎস্যন্যায়ভীত বাঙালিকে নৌকায়া সঙ্কটে যুদ্ধে পঠনাজ্জয়মাপ্নুয়াৎ এই ভরসায় আদ্যাস্তোত্র রচনা করতে দেখি ; যখন বাঙালির উপাস্যা দেবী দুর্গাকে শঙ্করাচার্য স্তব করেন ত্বমসি গতির্দেবী নিস্তারনৌকা বলে; কিম্বা রামপ্রসাদের গানে শুনি:

বিভু নামে এক রাজার ছেলে

যাত্রা করেছিল শ্রীদুর্গা বলে

আসিবার কালে সমুদ্রের জলে

ডুবেছিল তবু মরণ হল না

তখন বুঝতে পারা যায় বাঙালির অর্থনীতির বলিষ্ঠতম স্তম্ভ বাণিজ্য কিভাবে তন্ত্রের সমর্থন পেয়েছিল। আর এই সুদৃঢ় অর্থনীতি যে জাতিগত স্বাস্থ্যের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তা বলাই বাহুল্য।

সুতরাং তন্ত্র আমাদের একটি স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস দিয়েছে। সেই খাদ্যাভ্যাসের গুরুত্ব সম্বন্ধে যারা সম্যক অবগত ছিলেন সেই বণিক ও বৈদ্যদের তন্ত্র নির্ভরতার ছত্রচ্ছায়ায় রেখেছে। এর ফলে আমাদের জাতিগত রোগপ্রতিরোধক্ষমতা বেড়েছে। ফলে জলকাদাময় মোহনা অঞ্চলের অগণিত রোগের প্রকোপ নিয়েও বাঙালি একটি স্বাস্থ্যবান জাতি। তাই সত্যেন্দ্রনাথ বলেছেন:

মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি

মারীভয়রোধে তন্ত্র

মারীভয়ের নিবারণের ক্ষেত্রেও তন্ত্রের যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তন্ত্রে কিছু বিশেষ মাতৃকাপূজার উল্লেখ পাওয়া যায় যার প্রয়োগ হতো মহামারীর প্রতিরোধে। এদের মধ্যে শীতলা ওলাইচণ্ডী প্রমুখ দেবী বিখ্যাত। বৌদ্ধতন্ত্রে দেবী পর্ণশবরীও এই পর্যায়ভুক্ত। এঁদের উপাসনার কিছু সুনির্দিষ্ট স্থানও ছিল। যেখানে বিশেষ বিশেষ রোগের চিকিত্সা করতেন ঐ দেবীর সাধকেরা। স্থানগুলি প্রায়শই হতো অপেক্ষাকৃত জনবিরল পরিবেশে। কোনো না কোনো বিশেষ বনস্পতির সাযুজ্যে। আয়ুর্বেদের প্রেক্ষিতে এর বিশেষ তাৎপর্যও ছিল। এই লৌকিক দেবীগণের রূপকল্পে যে পরোক্ষভাবে মিশে ছিল স্বাস্থ্যচেতনা তা লক্ষ্য করা যায় যোগিনীতন্ত্রের উচ্চাটনবিধির বর্ণনায়। এই তন্ত্রের মতে উচ্চাটনের জন্য গৌড়ী নাগবল্লভা বা নাগিনী দেবীর উপাসনাই প্রশস্ত।

উচ্চাটনে তথা গৌড়ী মারণে ভৈরবী মতা…

স্তম্ভনোচ্চটানে দেবী প্রশস্তা নাগবল্লভা।।

সম্ভবত গৌড়বঙ্গের সর্পদেবী মনসারই কোনো এক অধুনালুপ্ত সাধনক্রম এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। এরপরেই এই নাগবল্লভা বা নাগিনী দেবীর রূপ বর্ণনায় আমরা পাই এক স্বাস্থ্যবতী রমণীর সমস্ত লক্ষণ।

সমাঙ্গী শূদ্রদেহী চ ন খর্বা নাতিদীর্ঘিকা

দীর্ঘকেশী মধ্যপুষ্টা মৃদুভাষা চ নাগিনী।।

গৌড়ীয় ভাবধারার এই দেবীর সুস্বাস্থ্য সম্ভবত পরোক্ষভাবে তৎকালীন গৌড়ীয় নারীগণের উন্নত স্বাস্থ্যের ও নিরোগ দেহের প্রতিই ইঙ্গিত করেছে।

এই প্রসঙ্গে বশীকরণের দেবী শঙ্খিনী যিনি লৌকিক আদর্শে শাঁখচুন্নি নামে পরিচিত তাঁর কথাও স্মরণীয়। যথা:

দীর্ঘাঙ্গী সা শঙ্খিনী স্যাৎ জগদ্রঞ্জনকারিণী।।

মারীভয়নাশের বিষয়ে আর এক স্বল্পপরিচিত দেবী হলেন মহামারবতী। বৃহৎনন্দিকেশ্বর পুরাণের দেশবাসিনী দেবীগণের মধ্যে উল্লিখিত হয়েছে:

শ্মশানে দেবী মহামারবতী।

লক্ষণীয় বিষয় হলো এই শ্মশান গ্রামের বহির্ভাগে অবস্থিত দাহস্থল নয়। কারণ শ্মশানের নাম বরেন্দ্র রাঢ় কোটিবর্ষ সমতটের সাথে এক পংক্তিতে উচ্চারিত হয়েছে। অতএব অনুমিত হয় গৌড়বঙ্গের কোনো এক সমৃদ্ধ অঞ্চল মহামারীতে শ্মশান হয়ে গিয়েছিল। সেই জনবিরল মৃতদেহসঙ্কুল শ্মশানদেশে বঙ্গবাসী দেবী মহামারবতীর আরাধনা করেছে। এই দেবীর মূর্তি কেমন ছিল জানা যায় না। তবে রূপকল্প যাই হোক তাঁর সাধনার সাথে মারীভয়নাশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তন্ত্রে বস্তুবাদী ভাবনা এতটাই বলিষ্ঠ ছিল যে মারীবিধ্বস্ত শ্মশানে শুধু শ্মশানবৈরাগ্যের স্বপ্ন না দেখে মহামারবতীর সাধকেরা পুনরায় জীবনপ্রবাহের সঞ্চার করেছিলেন। দেবীর মূর্তি সম্বন্ধে পরোক্ষ কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে দেশবাসিনী দেবীগণের মধ্যে উল্লিখিত সমতটের প্রসঙ্গে।

সমতটের নাম দুইবার এসেছে। একবার দেবী বহুশালিনীর সাযুজ্যে। দ্বিতীয়বার দেবী কপালিনীর সাহচর্যে। এই বহুশালিনীর কপালিনীতে রূপান্তর যেমন জনমানসের আধ্যাত্মিক পরিবর্তনের তেমনই সম্ভবত অর্থনৈতিক অবনতির তথা জাতীয় সঙ্কটের আভাস দেয়। বঙ্কিমের ভাষায় দেবী বহুশালিনী হচ্ছেন মা যা ছিলেন। আর কপালিনী- মা যা হইয়াছেন। কপালিনী দেবী নরকপালমালাধারিণী উগ্রা শীর্ণকায়া। দুর্ভিক্ষকবলিত দেশে প্রখর বাস্তববোধে কল্পিত মায়ের এই মূর্তি নিশ্চিতভাবে আগামীদিনে পুনরুত্থানের জন্য বঙ্গবাসীকে নিরন্তর প্রেরণা দিত। সম্ভবত অনুরূপভাবেই চিত্রিত ছিল মহামারবতী দেবীর মূর্তি যার থেকে মহামারীর প্রতিরোধের ভাবনা সঞ্চারিত হত। পরবর্তীকালের আর শ্মশান নামক এই দেশটির নাম পাওয়া যায় না। পরোক্ষ সিদ্ধান্ত করা যায় মহামারবতীর উপাসনা এতটাই ফলপ্রসূ হয়েছিল যে দেশটি আবার তার পূর্বের গৌরবোজ্জ্বল দিন ফিরে পেয়েছিল। জগন্মাতার রূপভেদ দেবী মহামারবতী রাজরাজেশ্বরী হয়েও মহামারীর দূষিত পরিবেশে এসে দাঁড়িয়েছেন সন্তানকে ত্রাণ করতে;এই ভাবনা যে মাতৃপরায়ণ জাতির হৃদয়ে কতোটা উদ্যম ও প্রাণশক্তির স্ফুরণ ঘটাতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এভাবেই সমষ্টিগত চেতনার বিকাশে তথা স্বাস্থ্যভাবনার নবনির্মাণেও আদিকাল থেকে তন্ত্র সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।

জন্মনিয়ন্ত্রণ ও যৌনস্বাস্থ্য

মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক হল পারিবারিক ও যৌন জীবনে নারীর স্বকীয়তা। জনস্বাস্থ্যের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল মা ও শিশুর স্বাস্থ্য। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা নীতির অপপ্রয়োগ থেকে নারীদের ও শিশুদের অপুষ্টি, দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং জনবিস্ফোরণের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। কিন্তু বাঙালির মাতৃতান্ত্রিক সমাজের মূলতঃ দুটি সুফল ছিল। প্রথমতঃ নারীদের সেই স্বাতন্ত্র্য ছিল যাতে পুরুষের দাম্পত্য ধর্ষণ ও অন্যান্য সামাজিক অবদমনের থেকে তাঁরা মুক্ত থাকতে পারতেন। চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত মূর্তিগুলোর মধ্যে এমন মূর্তি পাওয়া গেছে যেখানে পূর্ণবয়স্কা নারীর কোলে শিশুতুল্য আকৃতিবিশিষ্ট তাঁর পূর্ণবয়স্ক সঙ্গী পুরুষ অবস্থিত। এছাড়া যৌনমিলনের যে চিত্রগুলি আছে তার মধ্যে বিপরীত রতির লক্ষণীয় উপস্থিতিও এই বিষয়ের সাক্ষী। এ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যেতেই পারে যে সমাজের চালিকাশক্তি ছিলেন নারীরা। পুরুষেরা তাঁদের ছত্রচ্ছায়ায় নিজ দায়িত্ব পালন করতেন। পরবর্তীকালে জয়দেবের আরাধ্য রাধার কোলে শিশু কৃষ্ণ; চীনাচারে দেবী তারার কোলে শিশু শিব; কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের শ্যামা মায়ের কোলে শ্যামমূর্তি এই সমাজসত্যেরই দ্যোতক। আর মাতৃতান্ত্রিক সমাজে সম্ভবত শিশুরা মাতুলকুলের সম্পত্তি বলে গণ্য হতেন। আজও বাঙালির নান্দীমুখে মাতুলকুলের প্রাধান্য বেশি। তাই বাঙালি পুরুষেরাও বৈদিক আর্যদের মতো প্রজাপতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন নি। একটি কৌতূকপ্রদ তথ্য হল সমস্ত প্রজাপতিদের মধ্যে বঙ্গনিবাসী প্রজাপতি কর্দমের বংশেই জন্মহার সবথেকে নিয়ন্ত্রিত এবং সম্ভবত এটা কোনো কাকতালীয় সংযোগ নয়; তান্ত্রিক সংস্কৃতিরই প্রভাব।

দ্বিতীয়তঃ যৌনজীবনের রাশ নারীর হাতে থাকার ফলে সুষম স্বাস্থ্যসম্পন্ন সমাজের নির্মাণ অনেক সহজসাধ্য হয়েছিল। দাম্পত্য জীবনের স্থিরতার ফলে বাঙালির ভবিষ্যত প্রজন্ম বাল্যকাল থেকেই সবল ছিল এবং সুস্থ সামাজিক ভাবনা এবং balanced personality নিয়ে বড়ো হত। যার পরিণাম ছিল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাঙালির মনস্বীতা ও বলবীর্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারা। আধুনিক চিকিত্সা শাস্ত্রের ভাষায় multiple childbirth, early age of motherhood, perinatal mortality প্রভৃতির সমস্যা বহুলাংশে কম ছিল। বাৎস্যায়নের কামসূত্রেও একথার সমর্থন মেলে।

বাঙালির শিশুরা স্বাস্থ্যবতী মায়ের থেকে সুস্বাস্থ্য পেত; তান্ত্রিক মাতামহী পিতামহীর রূপকথার গল্পে মানসিক পরিণতি পেত; আর উন্নত নগরায়ন ঔষধি ও বাণিজ্যের কর্মমুখর পরিবেশে পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য নিয়ে বড়ো হয়ে উঠত।

নগর পরিকল্পনা

চন্দ্রকেতুগড় অঞ্চলে খ্রিষ্টপূর্ব যুগের গঙ্গারিডাই সভ্যতার যে নগর পরিকল্পনা দেখি, সেখানে কয়েকটি জিনিস প্রথমেই চোখে পড়ে।

আবর্জনা ফেলার আলাদা কুণ্ড। জীবজন্তুর হাড়গোড়, মৃৎপাত্রর ভগ্নাংশ, কাষ্ঠ ভগ্নাংশ।

পানীয় জলের কুয়ো। পোড়ামাটির বলয় একটির পর একটি সাজিয়ে তৈরি, অন্তত দশ বারো হাত গভীর পানীয় জলের গভীর কুয়োর অবশেষ পাওয়া গেছে।

পয়ঃপ্রণালী। মাটির ১৩-১৪ ফিট নিচে পোড়ামাটির নলের পয়ঃপ্রণালী এই নলগুলি পর পর সাজানো থাকত এবং প্রত্যেকটি নলের দৈর্ঘ্য ছিল দুই ফিট সাত ইঞ্চি। এই ভূগর্ভের পয়ঃপ্রণালী মৌর্যপূর্ব যুগের, অর্থাৎ নন্দবংশের সমসাময়িক বলে গবেষকরা অনুমান করেছেন। এছাড়া ওঁদের বাথরুমে ব্যবহার করার পোড়ামাটির গাত্রমার্জনী পাওয়া গেছে।

বাঙালির নগরপরিকল্পনার একটি বড়ো অঙ্গ ছিল দুর্গ। অসংখ্য দুর্গ বা কোটের কারণে পুণ্ড্রের একটি নগরীর নামই ছিল কোটিবর্ষ। দেবীকোটে দেবী মহামায়ার মন্দির ছিল। দুর্গ এলাকায় মন্দির হওয়ার ফলে দেবীর নাম হয়ে গেছিল কোটেশ্বরী। চন্দ্রকেতুগড় বাণগড় থেকে শুরু করে একেবারে প্রতাপাদিত্যের সামনেগড় পর্যন্ত বাঙালির দুর্গ পরম্পরার একটা নিরবচ্ছিন্ন ধারা আছে। বস্তুত এই দুর্গেরও একটা বড়ো ভূমিকা ছিল নগরের স্বাস্থ্য রক্ষায়। কালিকাপুরাণে এই নিয়ে যে বিস্তারিত আলোচনা আছে তা থেকে জানতে পারি: দুর্গ তৈরী হতো উচ্চভূমিতে অর্থাত্ যেখানে প্লাবনের সময়েও নদীর জল ওঠে না। চারপাশে গভীর জলপূর্ণ পরিখা কেটে রাখা হত। দুর্গপ্রাচীরে সূর্যপুত্র বেরণ্ডের দণ্ডধারী মূর্তি থাকত। গড়বেতা চন্দ্রকোণায় এরকম বেরণ্ডমূর্তি পাওয়া গেছে; তারাপদ সাঁতরা জানিয়েছেন। সূর্যকে বহু শাস্ত্রেই রোগহরণকারীর ভূমিকায় দেখতে পাওয়া যায়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে সূর্যের ধন্বন্তরী আদি ষোড়শ শিষ্যকে আয়ুর্বেদের ধারক বলা হয়েছে। সম্ভবত এই সূর্যপুত্র বেরণ্ডের দুর্গপ্রাকারে অবস্থান রোগের প্রবেশরোধকল্পেই করা হয়েছিল। দুর্গের বিবরণী অনেকাংশে একটা isolation zone এর ধারণা দেয়। মহামারী বা দুর্যোগের সময় সমস্ত নগরবাসী দুর্গে আশ্রয় নিত এবং এই পরিখাবেষ্টিত দুর্গের অন্তরালে তাঁরা সুরক্ষিত থাকতেন। নগরের পরিকল্পনা হত অষ্টদল বা ষোড়শদল পদ্মের আকারে। পদ্মকেশরে বা কেন্দ্রস্থলে থাকত দুর্গ বা গড়। তার চারপাশে পদ্মের এক একটি পাপড়িতে থাকত নগরের এক একটি জনবহুল অঞ্চল। দুই পাপড়ির মধ্যবর্তী ব্যবধানে থাকত সরণী। তান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই নগরপরিকল্পনা করা হয়েছিল অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতনভাবে।

নগরীর সরণী এবং পয়োনালিসমূহ এতটাই সুপরিকল্পিতভাবে তৈরী হত যে অতিবর্ষণেও সরণী জলমগ্ন হতো না বা নগরের কোথাও জল জমতো না। কোনো প্রাচীন কবিই বর্ষণমুখর প্রকৃতির চিত্র আঁকতে গিয়ে জলমগ্ন পথের কথা বলেন নি। এই উন্নত পরিকল্পনার ফলে সমস্ত রকমের জলবাহিত এবং মশকঘটিত রোগ থেকে জনগণ সুরক্ষা পেতেন।

রূপকথার বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীজ গল্পে আমরা দেখি: রাক্ষসী রাণীর হাড়মটমট রোগ হয়েছে। রোগের বর্ণনা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার আর্থ্রাইটিসের সাথে মিলে যায়। এই বিষয়ে গল্পের তিনটি বিষয় লক্ষণীয়। এই একই রোগ রাণীর মা রাক্ষসী বুড়িরও ছিল; রাজা তথা নগরবাসীদের কাছে এই রোগ ছিল একেবারেই অপরিচিত; রাক্ষসী রাণীর প্রভাবে রাজা তখন সম্পূর্ণ বশীভূত। সুতরাং গল্পের পরোক্ষ ইঙ্গিত এটাই যে: বঙ্গের রাক্ষসজাতির মধ্যে জলাভূমির মশকবাহিত রোগের যথেষ্ট প্রাদুর্ভাব ছিল। কিন্তু সেই বঙ্গেরই অন্য একটি জাতির ( রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্র কোটালপুত্র প্রমুখ রূপকথার নায়কেরা এই জাতিরই প্রতিনিধি এবং গল্পগুলি থেকে বোঝা যায় এঁরাই অবৈদিক মাতৃপূজক আর্যগণ) উন্নত নগরায়নের ফলে তাঁরা সেই ব্যাধি থেকে মুক্ত ছিলেন। গল্পের রাজার রাজ্যে রাক্ষসীর প্রভাবে যে অরাজকতা তৈরি হয়েছিল তার জন্যই এই হাড়মটমট রোগের প্রকোপ। সুতরাং বোঝাই যায় যে সমাজে রাজ্যে মশকবাহিত রোগের একটি উদাহরণই অরাজকতার নির্দেশক বলে গণ্য হয়েছে সেই সমাজের চিকিত্সাব্যবস্থা কতটা উন্নত ছিল।

নগর ও গ্রামে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুষ্করিণী ও দীর্ঘিকা থাকত। উত্তরবঙ্গে লোহিডাঙ্গরা গ্রাম ছিল কিংবদন্তি ডাকপুরুষ বা ডাকের জন্মভূমি। সেই গ্রামের বিবরণ ডাক নিজেই দিয়েছেন:

লোহিডাঙ্গরা ডাকের গাঁও

তিনিশ ষাট পুখুরীর নাও

সেই গ্রামত উপজিল ডাক

অর্থাত্ ডাকের গ্রামে ৩৬০ টি পুকুর ছিল। এছাড়া গোরক্ষবিজয়ের রমণীরাজ্য এবং মৈনামতীর রাজ্যের বৈশিষ্ট্য ছিল:

কারো পুকুরের জল কেহ নাহি খায়

পরিবার পিছু নিজস্ব পুকুর থাকার দুটি বড়ো সুবিধা ছিল : জলদূষণের হার কম হওয়া এবং জলবাহিত রোগ বিশেষত কলেরা উদরাময় ওলাওঠার সম্ভাবনা কমে যাওয়া। সুতরাং তন্ত্রনির্ভর এই জাতির নগরায়নেও ছিল স্বাস্থ্যভাবনার প্রকাশ।

দেহতত্ত্বে তন্ত্র

তন্ত্রের আদিকাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত অগণিত বিবর্তনের মধ্যে যে বিষয়টি অদ্যাবধি বর্তমান সেটি হল দেহতত্ত্ব। এই তত্ত্বে দেহের নাড়িসমূহের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ সত্যই বিস্মিত করে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী মূলাধারে সুষুম্নাকাণ্ডের ত্রিকোণাকৃতি শেষ প্রান্তে ঈড়া পিঙ্গলা ও সুষুম্নানাড়ি অবস্থিত। সুষুম্নার কেন্দ্রে সার্দ্ধদ্বিপাকে সর্পাকারা কুলকুণ্ডলিনী সুষুপ্তিমগ্ন। সুষুম্নাকাণ্ডে মূলাধারের ঊর্দ্ধে নির্দিষ্ট ব্যবধানে স্বাধিষ্ঠান মণিপুর অনাহত বিশুদ্ধ ও আজ্ঞাচক্র অবস্থিত। প্রতিটি চক্রের আকৃতি পদ্মের সাথে তুলনা করে সেই পদ্মের দলসংখ্যা বর্ণ প্রভৃতি নিয়ে বিশদ আলোচনা তন্ত্রে করা হয়েছে। এমনকি চিত্তের কোন্ গুণাবলি কোন্ চক্রের সক্রিয়তার সাথে সংশ্লিষ্ট তা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। সর্বশেষ চক্র যা মস্তিষ্কে ব্রহ্মরন্ধ্রে অবস্থিত তাকে সহস্রদল কমলের সাথে সাদৃশ্যের কারণে সহস্রার বলা হয়েছে। এই সহস্রারের সোমমণ্ডলের সুধা সাধককে মহাসুখের সন্ধান দেয়।

এই দেহতত্ত্ব বিষয়ের ধারণা প্রাচীন ইউরেশিয়ায় তান্ত্রিকগণের মাধ্যমেই বিস্তৃত হয়েছিল। তন্ত্র ও চিকিত্সাশাস্ত্র সেযুগে কতটা অভিন্ন ছিল তার প্রমাণ গ্রীসের aescelopius এর কাহিনী। গ্রীক পুরাণে আপোলোপুত্র aescelopius এর দণ্ডকে সর্বরোগহর বলে মনে করা হত এবং আধুনিক চিকিত্সা শাস্ত্রের প্রতীক রূপে আমরা ঐ দণ্ডের একটি প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করি। দণ্ডটির গঠন বাস্তবে ত্রিনাড়িবেষ্টিত অজপাহংসের ছত্রতলে অবস্থিত সুষুম্নাকাণ্ডের প্রতীক।

তন্ত্রে ন্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ন্যাসে মুখ অধর ওষ্ঠ ঊর্দ্ধদন্ত অধঃদন্ত উভয়কর্ণ ও উভয়চক্ষু মস্তক গ্রীবা স্কন্ধ থেকে অঙ্গুলিমূল হৃদয় উদর নাভি পৃষ্ঠ শ্রোণি লিঙ্গ গুহ্য উরু জঙ্ঘা পদ পদাঙ্গুলি প্রভৃতি স্থানের জন্য বর্ণমালার পৃথক পৃথক বর্ণ পরিকল্পিত হয়েছে। এই শারীরবৃত্তীয় বিভাগগুলি স্নায়ুতন্ত্রের বিন্যাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আবার হৃদয়াদি মুখ হৃদয়াদি উদর হৃদয়াদি কর হৃদয়াদি পদ প্রভৃতি বিভাজন মুখ্য ধমনিসমূহের অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

দেহের মধ্যেই সহজানন্দের ধারণা; সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্নায়ু নাড়ি ও ধমনীসমূহের শৃঙ্খলাবদ্ধ বর্ণনা, কাল্পনিক দেবমূর্তি অপেক্ষা বাস্তব দেহের মধ্যে পরমতত্ত্বের অন্বেষণের যৌক্তিকতা প্রভৃতি বৈপ্লবিক বস্তুনিষ্ঠ চিন্তা এই দেহতত্ত্বের অমূল্য অবদান। এই তত্ত্বের বিষয়গুলির সত্যতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই বিষয়ে ধারণা তৈরি করতে তন্ত্রাচার্যগণ যে শারীরবিদ্যায় রীতিমতো ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

মনস্তত্ত্ব ও তন্ত্র

তন্ত্রে দেহতত্ত্ব প্রসঙ্গে মনের অপূর্ব বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সবথেকে বৈপ্লবিক ভাবনা হল মন ও চিত্তের পার্থক্য নিরূপণ। চিত্তের মধ্যে রাখা হয়েছে চতুর্বিংশতি তত্ত্বকে। অর্থাত্ reflex ও drive বলতে যেসমস্ত আবেগকে আমরা বুঝি তাদের সমন্বিত রূপই চিত্ত। অন্যদিকে মন হল personality এর বিশেষ রূপ। মন চিত্তের ক্রিয়াশীল সত্ত্বার ধারক। প্রাচীন ভারতের যে কয়টি দর্শনে মনস্তত্ত্ব বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে তাদের মধ্যে সাঙ্খ্যের মত সর্বাধিক যুক্তিসম্মত। সেখানে কোনো কাল্পনিক সিদ্ধান্ত না করে প্রবৃত্তির ভিত্তিরূপে অহংকার(ego) বুদ্ধি(cognition) এবং মন(mind) এই তিনটি স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে।

১ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত নারীর দৈহিক ও মানসিক বিকাশের স্তরবিন্যাস তাঁরা পর্যালোচনা করেছিলেন কুমারী পূজার অন্তর্গত কালপূজার মধ্যে। বয়সের ঊর্দ্ধক্রমে এই ষোলটি স্তরে কুমারীকে ষোলটি দেবীর সাযুজ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁরা হলেন যথাক্রমে:

সন্ধ্যা সরস্বতী ত্রিধামূর্ত্তি কালিকা সুভগা উমা মালিনী কুব্জিকা কালশঙ্করাণী(কালসন্দর্ভা) অপরাজিতা রুদ্রাণী ভৈরবী মহালক্ষ্মী পীঠনায়িকা ক্ষেত্রজ্ঞা চর্চিকা।

সন্ধ্যা সরস্বতী উমা এই নামগুলি শিশুসুলভ সারল্য ও মেধার স্ফুরণের ইঙ্গিত দেয়।

১১ এবং ১২ বছরের সময়ে অর্থাত্ বয়ঃসন্ধির দোলাচলের মুহূর্তে শারীরিক ও মানসিকভাবে যে আকস্মিক আপাত উগ্র পরিবর্তন আসে সম্ভবত তারই দ্যোতক রুদ্রাণী ও ভৈরবী নাম দুটি। আবার তারপর ক্রমান্বয়ে চারটি নাম যৌবনসুলভ পরিণতমনস্কতা ও দৈহিক পরিপূর্ণতারই ইঙ্গিতবাহী। সুতরাং adolescent health এর বিষয়েও তান্ত্রিক জাতির মানুষদের ধারণা ছিল যথেষ্ট স্বচ্ছ।

বৌদ্ধ চিকিত্সা শাস্ত্রে আয়ুর্বেদ ও তন্ত্র

সাংখ্যের কাছে আদি বৌদ্ধধর্মের থেরবাদী দর্শন ভীষণভাবে ঋণী। বেদে অবিশ্বাস, নিরীশ্বরবাদ, মানবজীবন যে দুঃখময়, এবং তা থেকে মুক্তি পেতে নির্বাণ বা মোক্ষের ধারণা – সবই সাংখ্য থেকে নেওয়া। বুদ্ধ জন্মেছিলেন কপিলাবস্তু নগরীতে, যা মহর্ষি কপিলের নামাঙ্কিত, এই নামের অর্থ কপিলের সারপদার্থ, বা সাবস্ট্যান্স অভ কপিল। অশ্বঘোষ তার বুদ্ধচরিতে বিস্তারিত বলছেন বুদ্ধের ওপরে সাংখ্যের প্রভাবের কথা। বুদ্ধের দুই গুরু, অড়ার কালাম ও উদ্রক ছিলেন সাংখ্যমতাবলম্বী। এই সাঙ্খ্যপ্রভাবিত বৌদ্ধধর্মে প্রথম থেকেই চিকিত্সা শাস্ত্র বা তিগিচ্ছা সত্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। কায়গতাস্মৃতি গ্রন্থে শরীরের দ্বাত্রিংশত্ উপাদানের বর্ণনা করা হয়েছে।যথা:

অত্থি ইমস্মিং কায়ে কেশা লোমা নখা দন্তা তচো মংসং নহারু অট্ঠি অট্ঠিমিঞ্জা বক্কং হদয়ং যকনং কিলোমকং পিহকং পফ্ফাসং অণ্ডং অণ্ডগুণনং উদরিয়ং করিসং পিত্তং সেমহং পুবেবা

লোহিতং সেদো মেদো অস্সু বসা খেলং সঙখনিকা লসিকা মুত্তং তি।

এই ৩২ টি উপাদানের তালিকা বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের শারীরতত্ত্ব (anatomy) বিষয়ক জ্ঞানের পরিচায়ক।

অন্ত্র প্রসঙ্গে তক্কটকো গণ্ডোৎপাদক তালহীরক সূচিমুখ পটতন্তুক সূত্রক প্রভৃতি ৩২ প্রকার কৃমির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

অস্থিমজ্জা , বৃক্ক ও মূত্রাশয়, পিত্ত ও যকৃৎ প্রভৃতি বিষয়ে বৌদ্ধগণের যুক্তিপূর্ণ ও পর্যবেক্ষণভিত্তিক জ্ঞান রীতিমতো নিখুঁত এবং সুসংবদ্ধ।

ভ্রূণতত্ত্বেও তাঁদের ধারণা যথেষ্ট স্বচ্ছ ছিল। ভ্রূণের কোন্ অঙ্গ কবে কিভাবে গঠিত হয় এই নিয়ে গিরিমানন্দ সূত্তে বিশদ বিবরণ আছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এখানে উল্লিখিত ৩২ উপাদানের মতোই তন্ত্রে মাতৃকাদেবীকে ৩২ তত্ত্বের সমাহার রূপে দেখা হয়েছে। বৌদ্ধভিক্ষুদের এই শারীরবিদ্যার জ্ঞান হীনযান থেকে সহজযান এবং তারও বিবর্তনের ফলে আধুনিকযুগের বাউল ফকিরদের মধ্যে আজও অব্যাহত। গিরিমানন্দ সূত্তের প্রতিধ্বনি করেই বাউল সাধকেরা গেয়েছেন:

ছয়মাসের এক কন্যা ছিল নয়মাসে তার গর্ভ হল

এগারো মাসে তিনটি সন্তান….

ঘর আছে তার দুয়ার নাই লোক আছে তার বাক্য নাই….

এ থেকে দেহের আভ্যন্তরীণ ক্রিয়া ও রোগ সম্বন্ধে সাঙ্খ্য তন্ত্র ও বৌদ্ধমতের একাত্মতা সুন্দরভাবে উপলব্ধি করা যায়।

ঔদুম্বর

উদুম্বর গোত্রের মধ্যে ডুমুর অশ্বত্থ ও প্লক্ষ (পাকুড়) এই তিন গাছই বাংলায় প্রচুর। এই তিনটি গাছেরই ভেষজ গুণ আছে। কোষ্ঠকাঠিন্যের নিরাময়ে, মেদবাহুল্য বর্জন করতে, দাঁতের চিকিত্সায়, অশ্রুগ্রন্থির রোগ নিরাময়ে, মধুমেহ রোগের চিকিত্সায় ডুমুর ও অশ্বত্থের ব্যবহার করা হয়।অশ্বত্থবৃক্ষ বৃক্ষকুলে সর্বাধিক পরিমাণে বিশুদ্ধ বায়ুর জোগান দেয়। বাঙালির লৌকিক দেবী ষষ্ঠী শীতলা প্রমুখের আসন প্রায়ই কল্পিত হয় গ্রামের অশ্বত্থতলায়। বৈশাখ মাসে অশ্বত্থগাছে জল দেওয়া বাঙালির এক বহুপ্রাচীন সামাজিক রীতি। আবার তন্ত্রেও এই তিন বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। দীর্ঘকাণ্ডযূক্ত ও শীর্ষে ছত্রাকার পত্রবিন্যাসযুক্ত এই তিন বৃক্ষে বাঙালি দেখেছে সুষুম্নানাড়ির ঋজুতা এবং সহস্রারচক্রের বিস্তার। আবার এই তিন গাছেরই ঔদম্বর পুষ্পবিন্যাসের কারণে ফুল দেখা যায় না; ফল দেখা যায়। এই বিশেষত্বটি তন্ত্র ও সহজযানে গুহ্যতত্ত্বের উপমারূপে ব্যবহৃত হয়েছে। বুদ্ধের বোধিলাভের ক্ষেত্র সেই জন্যই বোধিবৃক্ষ নামক অশ্বত্থবৃক্ষের তলদেশ। সিন্ধুসভ্যতায় অশ্বত্থের সিলও এই তন্ত্র তথা স্বাস্থ্যচেতনার সাযুজ্যেই ব্যবহৃত হত। যোগিনীতন্ত্রে এই অশ্বত্থবৃক্ষ হয়ে উঠেছে ভূতবলির অর্থাত্ ক্ষুধার্তকে অন্নদানের উপযুক্ত স্থান।

ততো ভূতবলিম্ দদ্যাৎ সাধকো ধর্ম্মসম্মিতম্।

অশ্বত্থেন মহেশানি তদ্ধর্মকীলকঞ্চরেৎ।।

তন্ত্র ও আয়ুর্বেদের জনহিতকর প্রভাবে উদুম্বরের গুরুত্ব বঙ্গের মানুষের কাছে এতটাই বেশি ছিল যে ষষ্ঠ শতাব্দীর গৌড়াধীপ জয়নাগের সাম্রাজ্যের কজঙ্গল থেকে গৌড় পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডের নাম ছিল ঔদুম্বর। সম্ভবত এই নামের মাধ্যমে প্রকাণ্ডযশা প্রজাপালক জয়নাগের সমস্ত গৌড়বাসীকে এক তান্ত্রিক পরম্পরা ও এক উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রদানের দৃঢ় সংকল্পই ঘোষিত হয়েছে।

শশাঙ্কের সময়কাল

শশাঙ্কের রাজত্বকালে বাঙালির রাজনৈতিক উত্থান ঘটেছিল বহুকাল পরে; শৈবতন্ত্র মহাযানমত আত্মস্থ করে এক বলিষ্ঠ উদার আশ্রয়ের আশ্বাস দিয়েছিল বৃহত্তর গণচেতনায়। সেই সময়কালেও তন্ত্র ও চিকিত্সা শাস্ত্র বঙ্গের সমৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।

গৌড় অঞ্চলের কিংবদন্তি অনুযায়ী শশাঙ্ক কর্ণসুবর্ণের সন্নিকটস্থ শক্তিপুরের সুপ্রাচীন শৈবতীর্থ কপিলেশ্বর থেকে শুরু করে প্রতি পাঁচ ক্রোশ অন্তর একটি করে শৈবক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা বা সংস্কার করেছিলেন। এই শৈবক্ষেত্রগুলি যেমন তন্ত্রের ভিত্তিতে গৌড়ের রাজনৈতিক ঐক্য সুদৃঢ় করার স্তম্ভ ছিল তেমনি স্বাস্থ্যচেতনার দিক থেকেও এর গুরুত্ব ছিল। একইভাবে গৌড়রাষ্ট্রের কর্ণসুবর্ণ সন্নিহিত অঞ্চলে ছিল ৩০টি সঙ্ঘারাম, যে রাজ্যে পথিকগণ গৌড়ের পথে চলতে চলতে পাঁচ ক্রোশ অন্তর শৈবক্ষেত্রগুলিতে একটি করে রাজোদ্যোগে চালিত বিশ্রামস্থল পেতেন; আহত বা অসুস্থ হলে তাৎক্ষণিক চিকিত্সা পেতেন; সেই রাজ্যে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

দ্বিতীয়তঃ শশাঙ্কের সময়ে বঙ্গে শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণগণকে ভূমিদান করা হয়েছিল। এঁরা চিকিত্সা ও জ্যোতিষে পারঙ্গম ছিলেন। কুষ্ঠরোগ দূরীকরণে এঁদের প্রবাদপ্রতিম খ্যাতি ছিল। এঁরা নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে আবহাওয়ার সম্ভাব্য গতিবিধি জানাতে পারতেন এবং এর ফলে কৃষি বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনিশ্চিত ক্ষতির আশঙ্কা কম হত। বৃদ্ধ বয়সে শশাঙ্ক যখন কুষ্ঠরোগাক্রান্ত হন তখন এই শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণগণ তাঁর চিকিত্সা করেছিলেন। রজনীকান্ত চক্রবর্তীর গৌড়ের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায় এই শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণদের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবাসস্থল ছিল পুণ্ড্রবর্দ্ধনের পুণ্ড্রার্ক নামক স্থান। এনারা সূর্যোপাসক ছিলেন এবং শাকদ্বীপ থেকে বঙ্গে এসে অতি দ্রুত বঙ্গের তান্ত্রিক ভাবধারায় ভাবিত হয়ে বস্তুবাদী প্রয়োগভিত্তিক জ্ঞানের জগতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। ডাক ও খনা এই শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণদেরই পরম্পরার দুই মহান উত্তরসূরি।

ডাক ও খনা

তন্ত্রপরায়ণ বঙ্গমনীষার দুই আশ্চর্য স্ফুরণ হলেন ডাক এবং খনা। রহস্যময় এই দুই প্রতিভা তন্ত্রের বস্তুবাদী বিশ্লেষণে আজও প্রাসঙ্গিক।

দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় ডাকের সময়কাল অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে নির্দেশ করেছেন। ডাকের জন্মভূমি লোহিডাঙ্গরা গ্রামে ছিল ৩৬০ পুকুরের সমাবেশ। এত অধিক সংখ্যক পুকুর গ্রামের উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিচায়ক। প্রাচীন বাংলা ও তিব্বতী ভাষায় ডাক শব্দের অর্থ জ্ঞানী। জ্ঞানী সাধক ও সাধিকা ডাক ও ডাকিনী নামে পরিচিত ছিলেন। ডাকের বচনগুলিতে যদিও বজ্রযানী সাধনার কোনো ইঙ্গিত নেই তথাপি তৎকালীন বঙ্গবাসীর চোখে তিনি ছিলেন ব্যবহারিক জ্ঞানের মূর্ত প্রতীক। তাঁর ধর্ম বিষয়ক উপদেশগুলি থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় কঠিন বেদাচারের বিপরীতে নিরীশ্বরবাদী যুক্তিনির্ভর প্রকৃতিভিত্তিক ধর্মই তিনি অনুসরণ করতেন। তাঁর আদি অন্তের তত্ত্ব বুঝে মরণভয় ত্যাগ করে ইষ্টসেবার উপদেশ নিঃসন্দেহে সাঙ্খ্যের ও সহজযানের বৈপ্লবিক ভাবনার সাথে সাযুজ্য বহন করে।

আদি অন্ত ভুঝসি ইষ্ট দেবতা যেহ পূজসি

মরণের যদি ডর বাসসি অসম্ভব কভু না খায়সি

ধর্ম করিতে যে জন জানি পুখুর দিয়া রাখিও পানি

অশ্বত্থ রোপে বড় কর্ম্ম মণ্ডপ দেঅ অশেষ ধর্ম্ম

অন্ন বিন্ন নাহি দান ইহার পর ধর্ম্ম নাহি আন

 

ডাকের জন্মবৃত্তান্তের সঙ্গে জনৈক মিহির নামক জ্যোতির্বিদের নাম জড়িত। দীনেশ সেনের মতে এই মিহির নামটি শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সেক্ষেত্রে আমরা ডাকের মধ্যে চিকিত্সা ও জ্যোতির্বিদ্যার একটি নিরবচ্ছিন্ন পরম্পরা পাই কারণ বঙ্গদেশে এই শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণগণের রোগনিরাময় ও জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল। গৌড়াধীপ শশাঙ্কের কুষ্ঠরোগ নিরাময় করেছিলেন শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণগণ। ডাক সেই চিকিত্সা পরম্পরায় এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো ভাস্বর।

তাঁর জীবনের প্রথম উপদেশটিই ছিল প্রসূতি ও নবজাতকের স্বাস্থ্যবিষয়ক।

জন্মমাত্র বলে ডাক পো এড়িয়া পোআতি রাখ

ধুইয়া পৌচ্ছয়া দিহ কোলে যবে ফুল নামিবেক ভালে

নাড়ি ছেদিআ দিহ জয় ডাক বলে এই হয়

রান্নার বিষয়ে তিনি যে পরামর্শ দিয়েছেন সেখানে বাঙালির ভেষজগুণসম্পন্ন মশলাদ্রব্য আদা হলুদ হিঙ্ মরিচ প্রভৃতির বিশেষ উল্লেখ রয়েছে। জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সুচিন্তিত খাদ্যাভ্যাসের গুরুত্ব সম্বন্ধে তিনি ভালোই অবগত ছিলেন। যথা:

মদ্গুর মৎস্য দাএ কুটিআ হিঙ্গ আদা লবণ দিয়া

তেল হলদি তাহাতে দিব বলে ডাক বেঞ্জন খাব

গৌড়বঙ্গে আশ্বিনের সংক্রান্তি তাঁর নামে ডাক সংক্রান্তি নামে পরিচিত। গর্ভবতী ধানকে পোকার হাত থেকে রক্ষা করতে তাঁর নির্দেশিত বিধান আজও মেনে চলেন বাঙালি কৃষকেরা।

ডাকপুরুষের কিংবদন্তির স্মৃতিকে জিইয়ে রাখতে এখনও রাঢ়-বঙ্গের কোন কোন অঞ্চলের যুবকরা বছরের ঐদিন মাঠে গিয়ে সারারাত কুস্তি, লাঠিখেলা, মশাল জ্বালানো প্রভৃতি ক্রীড়া-কৌতুক করে থাকেন এবং রাতশেষে নদী বা পুকুরে স্নান করে পাত্রভরে ‘ডাক জল’ নিয়ে বাড়িতে আসেন। কৃষক পরিবার নিমপাতা ও তালশাঁস খেয়ে ঐ জল পান করেন। তাদের বিশ্বাস, এটিই হল ডাকপুরুষের আদেশ বা বাণী এবং এতে সারাবছর তাদের শরীরস্বাস্থ্য ভালো থাকবে।

ডাক-সংক্রান্তির দিন অনেক জায়গায় ধান্যক্ষেত্রে লৌকিক দেবী ‘গাড়সে ষষ্ঠী’র পূজা করা হয় এবং ভোরবেলা ‘ধানে ডাক’ দেওয়া হয়। ঐদিন সমস্ত কৃষিকাজ বন্ধ থাকে। উৎসবের তিন-চার দিন আগে থেকে বাছাই করা শুকনো পাটকাঠি আঁটি বেঁধে রাখা হয়। উৎসবের পূর্বরাত্রে মশাল জ্বেলে গ্রামের কৃষকরা ঘুরে বেড়ায় এবং ‘ওহো ওহো’ শব্দ করে আনন্দ প্রকাশ করে। সকালে প্রজ্জ্বলিত মশালের শেষাংশ একত্র করে বৃহৎ অগ্নিকুণ্ড সৃষ্টি করে গা-হাত-পা-মুখ গরম করে। ভোরবেলা অল্পবয়সী ছেলেরা বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে কুলো পিটিয়ে নিম্নোক্ত ছড়া আবৃত্তি করে গোটা গ্রামকে জাগিয়ে তোলে —

“আশ্বিন যায় কার্তিক আসে

মা লক্ষ্মী গর্ভে বসে

আমন ধানের সার বসে।

এপারের পোকামাকড় ওপারেতে যায়

ওপারের শিয়াল কুকুরে ধরে ধরে খায়।

হোঃ হো হো—।”

উৎসবের দিন কৃষকবধূরা ঘরে ঘরে নতুন আউশ ধানের তণ্ডুলের গুড়োর সাথে নারকেল ও গুড় দিয়ে পিঠে তৈরি করে আত্মীয়বর্গের সঙ্গে আনন্দোৎসব পালন করেন।

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম অঞ্চলে কার্তিক মাসের শেষদিনে ‘ডাক সংক্রান্তি’ উদযাপিত হয়। এদিন স্থানীয় অধিবাসীরা ধানগাছের কাছে গিয়ে বলেন— ‘ধান ফুলো, ধান ফুলো—’। বাঁকুড়াতে কার্তিক সংক্রান্তিকে ‘মাথান ষষ্ঠী’ও বলা হয়। মেদিনীপুর অঞ্চলে ঐদিন ধানক্ষেতে শরকাঠি পোঁতার সময় কৃষকরা ছড়া বলেন—

“অন্ সরষে শশার নাড়ি

যারে পোকা ধানকে ছাড়ি

এখানে আছে খুদমালিকা

এখানে আছে ওল

মহাদেবের ধ্যান করে বলরে হরিবোল।”

ডাকের এই অনুষ্ঠানের সাথে লৌকিক দেবতা ষষ্ঠী ও মহাদেবের উল্লেখ পুরুষ প্রকৃতি দ্বৈতবাদে আস্থাবান সেই বাঙালি মনীষীর প্রখর বাস্তববোধ ও স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ক জ্ঞানেরই পরিচায়ক।

ডাকের পরেই নাম আসে খনার। বঙ্গের নারীপ্রতিভার আকাশে এক মহান নক্ষত্র হলেন অটনাচার্যের শিষ্যা খনা। তাঁর গুরু অটনাচার্যের নামই প্রমাণ দেয় তিনি ভ্রমণপ্রিয় ছিলেন এবং তাঁর ভ্রমণলব্ধ সমস্ত ব্যবহারিক ও প্রয়োগভিত্তিক জ্ঞান খনাকে সমৃদ্ধ করেছিল।

আমি অটনাচার্যের বেটি

গণনে গাঁথনে কারে বা আঁটি

খনার জন্ম হয় রাক্ষসের দেশে। বৈদিক সাহিত্যে বঙ্গরাক্ষসৈঃ শব্দের প্রয়োগ এবং চন্দ্রকেতুগড়ে খনা মিহিরের ঢিবির অবস্থান থেকে বোঝা যায় প্রাচীন চন্দ্রকেতুগড়েই ছিল খনা ও তাঁর স্বামী মিহিরের বাসস্থান। এই মিহির নামটিও সম্ভবত শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণদের সাথেই সম্পর্কিত। তাঁর বচনগুলি মূলতঃ জলবায়ু ও কৃষিবিজ্ঞানে অগাধ পাণ্ডিত্যের পরিচায়ক। যথা:

খনা ডেকে বলে যান রোদে ধান ছায়ায় পান।।

দিনে রোদ রাতে জল তাতে বাড়ে ধানের বল।।

কার্ত্তিকের উন জলে খনা বলে দুন ফলে।।

 

যদি বর্ষে আঘনে রাজা যান মাগনে

যদি বর্ষে মাঘের শেষ ধন্য রাজা পুণ্য দেশ ।।

 

শোন বাপু চাষার বেটা বাঁশের ঝাড়ে দিও ধানের চিটা

চিটা দিলে বাঁশের গোড়ে দুই কুড়া ভুঁই বেড়বে ঝাড়ে

 

বাঙালির অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে একান্ত বস্তুবাদী জ্ঞানের এইধরণের গণমুখী প্রয়োগ যে কতটা কার্যকরী ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মহাযান থেকে সহজযানে তন্ত্রের মাধ্যমে যে সাম্যবাদী গণচেতনার জন্ম আমরা দেখতে পাই; খনা ও ডাকের জীবন তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

আয়ুর্বেদ রসায়নবিদ্যা ও তন্ত্র

মগধ ও গৌড়ের প্রাচীন চিকিত্সা শাস্ত্রের যুগানুক্রমিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বুদ্ধের যুগ থেকে শুরু করে সেনযুগ পর্যন্ত বৈদ্য ও ভিষকগণের সাথে তন্ত্রের নিবিড় সংযোগ ছিল।

চরক সম্বন্ধে প্রচলিত কিংবদন্তি অনুযায়ী চরক বলরামের অবতার রূপে পূজিত হতেন। বলা হত শেষনাগ জগতের পীড়াহরণের জন্য সমগ্র বিশ্বে ভেষজবিদ্যার প্রসারার্থে বিচরণ করবেন; তাই চরক নাম ধরে অবতীর্ণ হন। প্রসঙ্গত নাগছত্রধারী মদমত্ত গীতপ্রিয় বলরামের কাল্ট বহু প্রাচীন কাল থেকেই অবৈদিক তন্ত্রধারার দ্বারা গভীরভাবে সম্পৃক্ত এবং পাতঞ্জলির মহাভাষ্যের চরকাঃ সুশ্রুতাঃ প্রভৃতি শব্দ থেকে জানা যায় চরক ও সুশ্রুতের অনুগামী তন্ত্রনিষ্ঠ চিকিত্সকবর্গ দুটি স্বতন্ত্র institution এর ধারক ছিলেন।

চরকসংহিতা চরক রচনা করেছেন আত্রেয় ঋষি ও তাঁর শিষ্য অগ্নিবেশের কথোপকথনের আকারে এবং চমকপ্রদ বিষয় হল এই গ্রন্থটিকে বলা হয়েছে চরকপ্রতিসংস্কৃততন্ত্র। এই গ্রন্থে ত্রিধাতুজনিত রোগাদির শমনে ব্যবহৃত ভেষজের মধ্যে বঙ্গের পিপ্পলি, গুড়, প্লব বা কৈবর্তমস্তকা (একপ্রকার মুথা ঘাস) এবং মাষকলাইয়ের বিশেষ সমাদর লক্ষ্য করা যায়। বাঙালির গুড় শুধুই মধুরস্বাদের খাদ্যমাত্র ছিল না, একটি গুরুত্বপূর্ণ ভেষজও ছিল। এবং তন্ত্রের মধ্বাভাবে গুড়ং দদ্যাৎ সূত্রটিও সম্ভবত পরোক্ষভাবে সেইদিকেই ইঙ্গিত করে। পিপ্পলি চরকের রসায়নে বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে পীড়ানাশ ও বলবৃদ্ধির ঔষধি প্রস্তুতিতে। বর্দ্ধমানপিপ্পলীরসায়ন, আমলকাবলেহ, বিড়ঙ্গাবলেহ প্রমুখ ভেষজে পিপ্পলী অপরিহার্য উপাদান।

আবার চরকসংহিতায় বাজিকরণ(যৌনক্ষমতা বৃদ্ধির উপায়) প্রসঙ্গে সঙ্গী ও সঙ্গিনী নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যে গুণাবলি ব্যক্ত হয়েছে তা থেকে নারীর প্রাধান্যেরই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যথাঃ

যা পাশভূতা সর্বেষামিন্দ্রীয়াণাং পরৈঃ গুণৈঃ…

যস্যা ঋতে শরীরম্ ন ধত্তে শূন্যমিবেন্দ্রিয়ে…

শোকোদ্বেগারতিভয়ৈর্যাং দৃষ্ট্বা নাভিভূয়তে

প্রমুখ শ্লোকে নারীর বিরহকাতর পুরুষের ভাব, পুরুষের ভয়ে ও উদ্বেগে পরিত্রাণকারিণী রূপে নারীর ভাব সম্ভবত মাতৃতান্ত্রিক সমাজের আদি ভাবনা থেকেই উৎসারিত এবং সেক্ষেত্রে প্রকৃতিপ্রধান তন্ত্রের সাথে চরকসংহিতার সংযোগ আরো গভীর বলেই সিদ্ধান্ত করা যায়।

তন্ত্র ও আয়ুর্বেদের সুগভীর সম্পর্কের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন মহাযানী মাধ্যমিক দর্শনের প্রবক্তা আর্য নাগার্জুন। খসর্পণ অবলোকিতেশ্বরের সাধক তথা তারাসাধনার দ্বাবিংশক্রমের প্রবর্তক নাগার্জুন রসায়নশাস্ত্র ও চিকিত্সাশাস্ত্রে ভারতের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের মধ্যে অগ্রগণ্য। চক্রপাণির টীকাগ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি পীড়িত মানুষদের সেবার জন্য নাগার্জুন নিজের চিকিত্সাবিদ্যার অধীত জ্ঞান পাটলিপুত্র সহ মগধ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে শিলাস্তম্ভে খোদিত করে রেখেছিলেন। দশম শতাব্দীর চিকিত্সক বৃন্দ চক্ষুরোগের চিকিত্সার একটি ভেষজ সম্বন্ধে জেনেছিলেন নাগার্জুনের স্তম্ভলিপি থেকে।

নাগার্জুনেন লিখিতা স্তম্ভে পাটলিপুত্রকে।

তাঁর সেই চিকিত্সাবিধি মেনে চলে তৎকালীন যুগের পীড়িত ব্যক্তিরা যেমন আরোগ্যলাভ করতেন, তেমনি বহু পরবর্তীকালের বৈদ্যগণ ঐ শিলালিপি থেকে জ্ঞান আহরণও করতেন। মহাজ্ঞানের জগত থেকে নাগার্জুনের আর্তের কল্যাণে নিয়োজিত হওয়ার এই ঔদার্য তন্ত্রভাবনারই প্রকাশ। কারণ তন্ত্র অত্যন্ত বস্তুবাদী ও জীবনসম্পৃক্ত। জগতকে দুঃখময় জেনে সেই দুঃখ থেকে উত্তরণের নিরন্তর প্রচেষ্টাই তন্ত্রের মূল সুর।

চক্রপাণি ও তাঁর পূর্ববর্তী আচার্য বৃন্দ মগধের বহু স্থানে ভ্রমণ করে নাগার্জুনের সিদ্ধান্তসমূহ সংগ্রহ ও সংকলিত করেছিলেন নিজ গ্রন্থে। নাগার্জুনের রসায়নচর্চার উদ্দেশ্যও ছিল মানুষকে রোগমুক্ত স্বাস্থ্যপূর্ণ জীবনের সন্ধান দেওয়া। চক্রদত্ত টীকায় ঔষধের বলবৃদ্ধির প্রসঙ্গে তাঁর পূর্বসূরি বৃন্দের রচিত বৃন্দরসায়নের একটি ধারণী মন্ত্রের উল্লেখ থেকে জানা যায় তাঁরা উভয়েই তন্ত্রাচারী ছিলেন। সেটি হল: আঁ নমো বিনায়কায় অমৃতম্ রচ রচ মম ফলসিদ্ধি দেহি দেহি রুদ্রবচনম্ স্বাহা।।

রসরত্নাকর গ্রন্থ থেকে জানা যায় নাগার্জুন ধাতব পদার্থের ভেষজ গুণাগুণ নিয়ে সর্বাধিক গবেষণা করেছিলেন এবং তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল পারদ ও অভ্র। পারদের এই নামকরণের কারণই হল আধিব্যধি থেকে পার হওয়ার বা উত্তরণের মার্গ রূপে এই ধাতুটির গুরুত্ব নিরূপণ। চক্রপাণি বৃন্দ প্রমুখ নবম থেকে একাদশ শতাব্দীতে চিকিত্সাশাস্ত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনেন। তাঁরা ঔষধ প্রস্তুতিতে বহুলাংশে ধাতব পদার্থের প্রয়োগ আরম্ভ করেন। বস্তুত অষ্টাঙ্গহৃদয়ের রচয়িতা বাগভটের পর সুদীর্ঘকাল চিকিত্সাশাস্ত্র গতানুগতিক পথে চলছিল। নবম বা দশম শতাব্দীর বৃন্দ ও একাদশ শতাব্দীর চক্রপাণিই আবার আয়ুর্বেদের জগতে নতুন বিপ্লব আনেন এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মতোই সুদক্ষ অতীতচারণের মাধ্যমে নাগার্জুনের প্রায় বিস্মৃত সিদ্ধান্তসমূহের পুনরুদ্ধার করেন।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় ঠিক এই সময়েই তন্ত্রের জগতেও এক বিপ্লব ঘটেছিল। দশম শতাব্দীতে মহীপালের সময়ে নাঢ়া নাঢ়ী সরহ প্রমুখ সিদ্ধাচার্যগণ বজ্রযানের দুরূহ মতের বিপরীতে উদার বৈপ্লবিক সহজযানের প্রবর্তন করেন এবং এর ফলে বাঙালির গণমানসে সুপ্রাচীন তন্ত্রের ধারা আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। মধ্যযুগে গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন যেমন পরবর্তী বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে বাঙালির সংস্কৃতির সমস্তরকম অগ্রগতির পথপ্রদর্শক হয়েছিল; সম্ভবত ঠিক সেই ভাবেই সহজযানী তন্ত্রের উত্থান দশম ও একাদশ শতাব্দীর আয়ুর্বেদের জগতেও নিঃশব্দ বিপ্লবের রূপকার হয়ে উঠেছিল।

চক্রপাণি তাঁর গ্রন্থে অম্ল ও ক্ষার যৌগের উৎপাদন ও প্রয়োগবিধি বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। তাঁর কিছু পরে ত্রয়োদশ শতাব্দীর রসহৃদয় গ্রন্থ থেকে জানা যায় চিকিত্সাক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য ধাতব পদার্থ উৎপাদন তথা প্রয়োগের ১৮টি পদ্ধতি ছিল। আবার ঐ গ্রন্থ থেকেই জানতে পারি পারদকে শিব ও অভ্রকে শক্তিরূপে কল্পনা করা হত এবং দ্বৈতবাদের চিরায়ত আঙ্গিকের দ্বারা জটিল রসায়নশাস্ত্র এই গ্রন্থে অত্যন্ত সরলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। আলবিরুণি দেখেছিলেন এই রসায়নের প্রভাবে বৃদ্ধ শরীরে তারুণ্যের সঞ্চার ঘটে, পক্বকেশ কৃষ্ণকেশে পরিণত হয়, মেধা ও বৌদ্ধিক বিকাশের পথ সরল হয়। আলবিরুণি এই রসায়নকে তাঁদের alchemy এর একটি উন্নত সংস্করণ বলে মনে করেছেন। তাঁর বক্তব্যে কিছু অতিশয়োক্তি থাকলেও মোটামুটি এটা বোঝা যায় যে এই রসায়ন একটি প্রয়োগমূলক শাস্ত্র ছিল এবং এর সাফল্যের পরিমাণও নিতান্ত অপ্রতুল ছিল না। পাতঞ্জলি রসায়নকে মুক্তির অন্যতম মার্গ বলেছেন। অর্থাত্ পীড়ামুক্তির ক্ষেত্রে রসায়নভিত্তিক আয়ুর্বেদের সাফল্য কিংবদন্তি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। রসহৃদয় গ্রন্থে পূর্বকালের রসায়নের আচার্যদের একটি তালিকাও দেওয়া হয়েছে। যথা: মহেশ্বর, কাব্য (শুক্রাচার্য), বালখিল্য, কপিল, ব্যালি, চর্বতি, গোবিন্দনায়ক এবং রাজা সোমেশ্বর। তন্ত্রপ্রণোদিত চিকিত্সাশাস্ত্রের অন্তর্গত রসায়নের আচার্যগণের মধ্যে সাঙ্খ্যকার কপিলের উল্লেখ আদি তন্ত্রমত তথা সাঙ্খ্যের সাথে আয়ুর্বেদের সুগভীর সংযোগেরই প্রমাণ। এছাড়াও শৈবতন্ত্রের রসার্ণবতন্ত্র তথা নাগার্জুনের রসরত্নাকর গ্রন্থও তন্ত্র ও আয়ুর্বেদের অবিচ্ছিন্ন ধারার সাক্ষ্য দেয়।

যন্ত্র ও মণ্ডলের জ্যামিতিক পরিকল্পনা:

তন্ত্রে ব্যবহৃত যন্ত্র ও মণ্ডলসমূহের একটি বিশেষ আকৃতি আছে। কেন্দ্রে বৃত্তাকার বা চতুর্ভুজ ক্ষেত্র; তাকে ঘিরে চারটি দ্বার। তাকে ঘিরে ১৬ এর গুণিতকে বহিঃপ্রকোষ্ঠ; সংখ্যাটা কখনও ৬৪ কখনও ২৫৬। এই যন্ত্র ও মণ্ডল মূলতঃ ইষ্টদেবীর গৃহরূপেই কল্পিত হত। যে জ্যামিতিক পরিমাপের এখানে প্রয়োগ হত তাতে চারটি দ্বার কেন্দ্রস্থ কক্ষের ৩৩% আয়তন অধিকার করত।বহিঃপ্রকোষ্ঠের বিন্যাসও সুনির্দিষ্ট গণনার ওপর ভিত্তি করে হত। সুতরাং আমরা বলতে পারি ইষ্টদেবীর গৃহনির্মাণে প্রাচীন তান্ত্রিকগণের এই স্বাস্থ্যসচেতন দূরদর্শিতা পরোক্ষভাবে তাঁদের নগরায়নের সুষ্ঠু পরিকল্পনার দিকেই ইঙ্গিত করে।

নদীবিজ্ঞানের প্রয়োগ:

প্রাচীন তান্ত্রিক বাঙালির নদীবিজ্ঞানের ধারণাও যথেষ্ট উন্নত ছিল। গঙ্গাবতরণের যে পৌরাণিক বিবরণ আমরা পাই তার থেকে অতিরঞ্জন বাদ দিলে মোটামুটি একটা তথ্য পাওয়া যায়: পাতাল নামে পরিচিত তৎকালীন নিম্নবঙ্গের বদ্বীপ অঞ্চলে গঙ্গার ধারা প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বদ্ধ জলাভূমির কর্দমাক্ত অরণ্যসঙ্কুল ক্ষেত্র অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ হয়ে উঠেছিল। ফলে সেখানে মশকবাহিত রোগের (বিশেষতঃ ম্যালেরিয়া) প্রাদুর্ভাব ছিল। ম্যালেরিয়াকে প্রাচীন আয়ুর্বেদে কপিলজ্বর বলা হয় কারণ এই জ্বরের অন্যতম লক্ষণ পিঙ্গলবর্ণ চক্ষু। সম্ভবত শঙ্খ নামে পরিচিত কপিলমুনির সাথে এই রোগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং তিনি জানতেন নদীপ্রবাহের পুনরুদ্ধার ছাড়া এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের পরিবর্তন সম্ভব নয়। কালকূট তাঁর শাম্ব উপন্যাসে খুবই যুক্তিযুক্ত একটি সিদ্ধান্ত করেছেন: সম্ভবত সগরের ষাট হাজার পুত্র এই কপিলজ্বরেই মারা পড়েছিল। কপিল মুনি এবং ভগীরথের মিলিত প্রচেষ্টায় গঙ্গার সেই প্রাচীন খাতের পুনরুদ্ধার সম্ভবপর হয় এবং গঙ্গার গতিময় ধারার মাধ্যমে সমগ্র বঙ্গের ভূপ্রকৃতি স্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে। লৌকিক ধারণার সাক্ষ্যও এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। খনার বচনে তথা পল্লীগীতির কথায় বারবার গঙ্গাকে ভগার খাত নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এই নাম সেই প্রাচীন নদীবিজ্ঞানীর কীর্তিরই পরিচয় বহন করে। আবার গঙ্গার অপর ধারা পদ্মার সাথেও কপিলের নাম জড়িয়ে আছে। কৃত্তিবাস গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণীতে বলেছেন:

আসিতে সুতির কাছে ভগীরথ পড়ে পাছে

শঙ্খাসুর করিল মোহিত

আগে শঙ্খ বাজাইয়া চলিল গঙ্গারে নিয়া

 

আবার কৃত্তিবাসের রামায়ণের আদিকাণ্ডে পাই:

পদ্মমুনি লয়ে গেল নাম পদ্মাবতী

ভগীরথের সঙ্গেতে চলিল ভাগীরথী।

 

অর্থাৎ ভাগীরথীর মতো পদ্মার ধারাটিও পদ্মমুনি ও শঙ্খাসুরের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করা হয়। প্রসঙ্গত শঙ্খ কপিলের নামান্তর এইরকম একটা মত প্রচলিত আছে এবং শঙ্খের নাম থেকেই সাঙ্খ্যদর্শন নাম হয়েছে এই মতও পাওয়া যায়। গঙ্গাসাগরের কপিল মুনির আশ্রমে আজও কপিলের প্রতীক রূপে শঙ্খ পূজিত হয়। আবার লৌকিক প্রবাদ অনুযায়ী কপিলের জন্মভূমি খুলনার কাছে। সুতরাং এই শঙ্খাসুর ও পদ্মমুনি সম্ভবত কপিলের বা তাঁর শিষ্যপরম্পরার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত।

সুতরাং আমরা দেখতে পাই আয়ুর্বেদের প্রায়োগিক পরিসরে নদীবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্তি প্রাচীন বাঙালির এক অসামান্য কৃতিত্ব ছিল।

মধ্যযুগের বৈদ্যগণ:

মধ্যযুগের বাঙালির চিকিত্সা ব্যবস্থা মূলতঃ ভ্রাম্যমান বৈদ্যগণের মাধ্যমে পরিচালিত হত। কারণটা খুব স্পষ্ট। সেযুগে নালন্দা বিক্রমশীলার মতো মহাবিহার ধ্বংসপ্রাপ্ত; উন্নত শিক্ষানিকেতনের ভবিষ্যত অন্ধকার। বাঙালির প্রধান জ্ঞানপীঠ নবদ্বীপ ও অন্যান্য স্থানেও তখন চতুষ্পাঠী ও টোলের প্রাধান্য। চূড়ান্ত রাজনৈতিক নৈরাজ্য ও অত্যাচারের পরিস্থিতিতে কোনো এক জায়গায় নিশ্চিন্তে বসে জ্ঞানার্জন তখন অসম্ভব। তাই বৈদ্যগণ তখন গ্রামে গ্রামান্তরে পলায়নরত বাঙালির চিকিত্সা করার তাগিদে ভ্রমণবৃত্তি অবলম্বন করেন। এই সময়ের চিকিত্সায় মূলতঃ স্থান পেয়েছিল উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ ভেষজ। সেগুলোর উপকরণ সংগ্রহ করার তাগিদেও বৈদ্যদের ঘুরে বেড়াতে হতো। কারণ তখন আর সেই বণিককুল নেই যাঁরা ভেষজের নিরবচ্ছিন্ন জোগান দিতে পারেন; আর বাঙালির হাতে তখন সেই অর্থসামর্থ্যও নেই যাতে চক্রপাণির মতো ধাতব উপাদান থেকে দুর্মূল্য ঔষধাদি তৈরি করতে পারে।

কবিকঙ্কণ তাঁর চণ্ডীমঙ্গলে বলছেন যে বৈদ্যরা বটিকা প্রস্তুত করতেন, এবং তন্ত্র সম্পর্কে তাঁদের ভালো জ্ঞান ছিল (চার বেদ পড়ে তারপর পঞ্চম বেদ পাঠ করলে বৈদ্য, এরকম etymology আছে বটে। তবে বৈদ্য প্রকৃতই তন্ত্রজ্ঞানী ছিলেন। আগেই বলেছি, আয়ুর্বেদ না হয়ে আয়ুর্তন্ত্র বলা গেলে বেশি ভালো হত)। তাঁদের সঙ্গে নানা পুঁথি থাকত এবং তারা ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা করতেন। রোগ অসাধ্য দেখলে কর্পূর পাঁচন তৈরি করে আনার নাম করে পলায়নও করতেন (সেযুগেও সম্ভবত রোগী মরলে ডাক্তার ধরে ঠ্যাঙানোর সুপ্রথাটি চালু ছিল, কাজেই প্রাণরক্ষার তাগিদে এ কাজটা করতে হত)।পশ্চিমি জগতে গুটি বসন্ত রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হওয়ার অনেক আগে মধ্যযুগের বাঙালির মধ্যে একধরনের টিকা চালু ছিল, বাঙালি শুধু শেতলার পুজো করতো না। শীতকাল শেষ হওয়ার সময় একদল পেশাদার vaccinator তুলোয় ভেজানো একরকম বসন্ত জীবাণু নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন। ওই টিকা দিলেই জ্বর আসতো, এবং চার পাঁচদিন জ্বরের পর রোগী সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যেত।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব ও শাক্ত আন্দোলনের সাথে এই বৈদ্যগণের ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল। মহাপ্রভুর পরিকর শ্রীখণ্ডবাসী মুকুন্দ গৌড়ের রাজবৈদ্য ছিলেন। মহাপ্রভুর আর এক পার্ষদ মুরারি গুপ্তও খ্যাতনামা বৈদ্য ছিলেন। মুরারি তাঁর পদাবলীতে বৈষ্ণবের প্রেমাদর্শের সাথে নিজের চিকিত্সাজ্ঞানের আশ্চর্য সমন্বয় ঘটাতে পেরেছিলেন। নিচের পদটিতে তার প্রমাণ দেখা যায়:

যত সুখে বাড়াইলা তত দুঃখে পোড়াইলা

করিলা কুমুদবন্ধু ভাতি

গুপ্ত কহে একমাসে দ্বিপক্ষ ছাড়িল দেশে

নিদানে আইল কুহূ রাতি

 

(অর্থাৎ রোগের চরমাবস্থায় অমাবস্যা পড়ল। রোগীর প্রাণসংশয় ঘটল। এই উপমা তাঁর বৈদ্যবৃত্তির সুন্দর পরিচয় বহন করে।)

 

অন্যদিকে কুমারহট্টের সেন বৈদ্যবংশের রামপ্রসাদের মাধ্যমেই অষ্টাদশ শতকে শাক্ত আন্দোলনের অপূর্ব অভ্যুত্থান ঘটে।

এটাও তন্ত্রের সাথে বাঙালির আয়ুর্বেদের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের প্রতীক।

উপসংহার:

উপসংহারে বলা যায় আদি আয়ুর্বেদ বঙ্গের প্রকৃতিপূজার ধারা থেকেই উৎসারিত হয়েছিল। পরবর্তীসময়ে আয়ুর্বেদের উন্মেষের সাথে যে সমস্ত ভেষজের জ্ঞান এসেছিল তাদের অধিকাংশই আজও বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের সাথে জড়িত। প্রাচীন বাঙালি চিরকালই স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করে এসেছে। তার খাদ্যাভ্যাস তার বাণিজ্য তার নগরায়ন সর্বত্র চিকিত্সা শাস্ত্রে প্রগাঢ় জ্ঞানের পরিচয় সুস্পষ্ট। লৌকিক দেবীর কাল্টে; মহামারীর প্রতিরোধে; দুর্গাপূজার অনুষঙ্গে; তন্ত্রের যন্ত্র ও মণ্ডলে সেই জ্ঞান তার সাক্ষর রেখেছে। বহু বাঙালি মনীষা তাঁদের জ্ঞানের সামগ্রিক প্রয়োগে এই সভ্যতার কায়াকে পুষ্ট করেছেন এবং এই বিষয়ে কপিল থেকে রামপ্রসাদ পর্যন্ত একটি নিরবচ্ছিন্ন ধারা বিদ্যমান ছিল। আয়ুর্বেদকে বাদ দিয়ে তন্ত্র ও তন্ত্রকে বাদ দিয়ে আয়ুর্বেদ একান্তভাবেই অসম্ভব। বাঙালির তথা ভারতীয় চিকিত্সাশাস্ত্রের সামগ্রিক ধারণার নির্মাণে তাই আয়ুর্তন্ত্রের পুনঃপুনঃ পর্যালোচনা একান্ত আবশ্যক।

shoptodina.com
shoptodina.comhttps://shoptodina.com
সপ্তডিঙা। কথাটা শুনলেই মনে আসে বাঙালির সমুদ্রবাণিজ্যের এক গৌরবময় ইতিহাস। গৌড়ের বণিকরা সাতটি বিশাল নৌকার এই সমবায় নিয়ে সিংহল, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, চীন, রোম, গ্রীস, ক্রীট, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করে ফিরে আসতেন স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার নিয়ে। সপ্তডিঙা তাই বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির অভিজ্ঞান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Advertisingspot_img

Popular posts

My favorites