প্রত্যেক বছর ২৬শে অগাস্ট আসে আর যায়। আমরা মনেও রাখিনা। আসলে জানিও না। কে বা জানাবে! গনেশচন্দ্র এভেনিউতে অবশ্য এই রডা অস্ত্র লুণ্ঠনের একটি স্মারকবেদী তৈরি করা হয়েছে। লিখেছেন- জয়ন্ত মুখার্জি
নিজের রক্তে দেশ মাতৃকার বন্দনা। এমনটাই করে গেছেন ভারতের অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা। আর সেই বিপ্লবীদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিল অবিভক্ত বাংলার দামাল ছেলে এবং মেয়েরা। সেই সময় দেশ মাতৃকা জগজ্জননীর অংশ রূপেই ধরা দিয়েছিলেন তখনকার বাঙালি বিপ্লবীদের কাছে। মায়ের নামে শপথ নিয়ে দেশের কাজে নামতেন তাঁরা।
বাঙালি বিপ্লবীদের সেই শৌর্য ও বীর্য পূর্ণ কর্মকাণ্ডের বিবরণ যা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকা উচিত ছিল ইতিহাসের পাতায়, তা আজ উদাসিন বিস্মৃতির গর্ভে নিমজ্জিত। আজ ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সচেতন মানুষেরা যখন সগর্বে নিজেদের বীর নায়কদের নানান ভাবে স্মরণ করে, তাঁদের নিয়ে লারজার দ্যান লাইফ (অতি রঞ্জিত) চলচিত্র বানায় তখন বাঙালি হিসাবে মরমে মরে যেতে হয়।
অনেক বাঙালীর আবার এই বোধটাই নেই, কারন তারা নিজেদের ধর্ম, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য থেকে এতটাই বিযুক্ত তারা কি হারিয়েছে বা হারাচ্ছে তা জানতেও পারে না। দোষ অবশ্য তাদের দেওয়া যায়না। আমাদের কবি তো বলিয়াই গিয়াছেন, “রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি”। অর্থাৎ কিনা বাঙালীরা মানুষ নয়। তাই তো বাংলার আম জনতা কবির বাণীকে সহৃদয়ে গ্রহন করে প্রাণপণে সর্ব ভারতীয়, সর্ব হিন্দু, এবং বিশ্বমানব হয়ে ওঠার মহান ব্রতে মন দিয়েছে। তাদের মধ্যে কেও শুধু বাঙালীর ভালমন্দ নিয়ে আলোচনা করলে অন্যরা রে রে করে তেড়ে আসবে। অন্য জাতির এই বালাই নেই, কারন তাদের রবীন্দ্রনাথ নেই;- রেখেছ অমুক করে তমুক করনি, বলার জন্য। তাদের মধ্যে যত মত তত পথের ধোঁয়াশাও নেই। নিজেদের নিয়ে গর্ববোধ করা তাদের কাছে অন্যায় নয়।
যাই হোক, ১৯১৪ সালের অবিভক্ত বাংলা। উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে যে স্বদেশ চেতনার উন্মেষ হয়েছিল ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ আন্দলনে পুষ্ট হয়ে তা আরও পরিণত হয়েছে। সমস্ত বাংলা ভরে গেছে গুপ্ত সমিতিতে। বিক্ষিপ্ত ভাবে শুরু হয়েছে সহিংস বৈপ্লবীক কর্মকাণ্ড। যে স্বাধীনতা অস্ত্রের জোরে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে তা অস্ত্রের জোরেই কেড়ে নেওয়ার আয়োজন শুরু হয়েছে। বড় কিছু করার জন্য চাই প্রচুর অস্ত্র, কিন্ত তা কোথায়?
১৯১৪ সালে শুরু হোল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, আর সেই পরিস্থিতি কে কাজে লাগিয়ে বাঙলার যতিন মুখার্জী, রাসবিহারী বসুর মতো বিপ্লবীরা জার্মানি থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে সারা দেশ জুড়ে এক সশস্ত্র অভ্যুথানের পরিকল্পনা করলেন। জার্মানি থেকে অস্ত্র সংগ্রহ ছাড়াও সমস্ত সেনা ছাওনিগুলিতে একযোগে বিদ্রোহের আয়োজন শুরু হয়েছে।এই দ্বিতীয় সিপাই বিদ্রোহ সফল হলে জাতীর জনক গান্ধী নয় বাঘাযতীন হতেন, এমনটা পড়েছিলাম কোথাও। তখনো এক বছর দেরি আছে ভারতে মোহনদাস গান্ধীর আগমনের।
কিছুদিন আগে নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে স্রেফ কৌতূহলের বশে ক্লিক করেছিলাম একটি ভিডিওতে। জার্মান মাউসার পিস্তলের ওপর একটি ডকুমেন্টারি। কৌতুহল এমনি এমনি জাগে নি। এই সেই অস্ত্র যার সঙ্গে জুড়ে আছে বাংলায় বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। যার কথা আজ আমরা বিস্মৃত। ভিডিওটিতে মাউসার পিস্তল কোন কোন বিখ্যাত মানুষ ব্যবহার করেছেন তার একটা বিবরণ দিচ্ছিল। দেখলাম লরেন্স অফ আরাবিয়া, চার্চিল এবং আরও অনেকের সংগে ভারতে কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় যুক্ত রাম প্রসাদ বিস্মিলের নাম নেওয়া হোল। না, বুড়িবালামের তীরে গুলির যুদ্ধে একসঙ্গীর সাথে মৃত্যু বরণ করা (বাকি দুইজনের ফাঁসি হয় আরেকজনের দ্বীপান্তর) বাঘা যতিনের নাম ছিল না। আশ্চর্য হই নি। আত্মবিস্মৃত জাতির এটাই তো প্রাপ্য।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বাইরে থেকে অস্ত্র জোগাড় করার প্ল্যান চলছে। ইউরোপের যুদ্ধে জড়িয়ে পরা ব্যস্ত শত্রুর দুর্বল মুহূর্তে চরম আঘাত হেনে দেশকে স্বাধীন করার এই সুযোগ ছেড়ে দেওয়া যাবেনা। চরকা কেটে দেশ স্বাধীন করার হাস্যকর ও আজগুবি পরিকল্পনা তখনো দেশে আমদানি হয়নি।
ইতিমধ্যে বাঙলার বিপ্লবীদের কাছে এলো এক সুবর্ণ সুযোগ। রডা অ্যান্ড কম্পানি ছিল সেই সময়ের এক বিখ্যাত বন্দুকের দোকান, যার মালিক ব্রিটিশ। বিখ্যাত বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলির সহযোগী কালিদাস মুখার্জি ছিলেন সেই দোকানের কর্মচারী। তাঁদের সাহায্যে সেই দোকানে কর্মরত বিপ্লবী শ্রীশ মিত্রের (হাবু) কাছ থেকে খবর এলো । সেই খবর শুনে সবাই নড়ে চড়ে বসলেন। পঞ্চাশটি মাউসার পিস্তল এবং চল্লিশ হাজার গুলির একটি খেপ আসবে কলকাতার অফিসে। ঠিক হল কাস্টম হাউস থেকে রডা কম্পানির গুদামে মাল নিয়ে যাবার পথে মালটি কব্জায় আনতে হবে।
উদ্যোগ নিলেন আত্মোন্নতি সংঘ ও মুক্তি সঙ্ঘের বিপ্লবীরা। প্রধান উদ্যোগী শ্রিশ পাল। সঙ্গে ছিলেন অনুকূল মুখার্জি, হরিদাস দত্ত, হরিশ শিকদার,বিপিন গাঙ্গুলি, ভুজঙ্গ ধর ও শ্রিশ মিত্র। ১৯১৪এর ২৪শে অগাস্ট বাঙলার বিভিন্ন বিপ্লবী দলগুলিকে নিয়ে একটি মিটিং-এর আয়োজন হল অনুকূল মুখার্জি এবং শ্রিশ পালের আহ্বানে। মিটিংটি হয় লালবাজারের পেছনে ছাতাওলা গলি নামে একটি পাতলা গলির মধ্যে, সম্ভবত একটি ছোটো পার্কে। এই দুজন ছাড়া আর যারা যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হলেন,- হারিদাস দত্ত, খগেন দাস, নরেন ভট্টাচার্য ( পরবর্তী কালের বিখ্যাত কম্যুনিস্ট নেতা এম এন রায় ), নরেন ঘোষচৌধুরি, শ্রিশ মিত্র, বিমান ঘোষ, জগত গুপ্ত, সুরেশ চক্রবর্তি, এবং আশু রায়। মিটিং শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই নরেন ভট্টাচার্য ও নরেন ঘোষচৌধুরী বেরিয়ে যান। এই অসম্ভব পরিকল্পনা তাঁদের কাছে পাগলামি মনে হয়েছিল। তাঁরা সম্মতি দিতে পারেননি ।
অনেক পরে উমা মুখার্জির লেখা- ‘TWO GREAT INDIAN REVOLUTIONARIES’ নামক একটি গবেষণা গ্রন্থে এই ঘটনাটির সন্মন্ধে বলা হয়েছিল- ‘Of all the overt acts committed by the Bengal revolutionaries during world war-1 nothing seems more daring and dramatic than the theft of Rodda’s arms effected on 26th august 1914.’ স্টেটসম্যান সেই সময় যার বর্ণনা দিয়েছিল “The greatest daylight robbery” বলে।
সভায় উপস্থিত বাকি বিপ্লবীরা পরিকল্পনায় তাঁদের সম্মতি জানালে শ্রিশ পাল ১৯১৪ সালের ২৬শে অগাস্ট নির্ধারিত কর্মকাণ্ডের ভার সবাইকে ভাগ করে দেন। বিমান ঘোষ, জগত গুপ্ত, সুরেশ চক্রবর্তী, এবং আশু রায়ের ওপর ভার পড়েছিল ডালহৌসি স্কয়ারে থেকে আইবির লোকেদের ওপর নজর রাখার। সামান্যতম বিপদের আশঙ্কা দেখলেই বাকিরা আশু রায়কে সংকেত দেবে এবং সু গায়ক আশু রায় গানের সুরে তা জানিয়ে দেবে শ্রিশ পাল, হরিদাস দত্ত এবং খগেন দাসকে। অনুকুল মুখার্জি ভার নিলেন জোড়া বলদ সমেত একটি গরুর গাড়ি জোগাড় করে দেবার।
কাস্টম হাউস ছিল লাল দীঘির দক্ষিণ পূর্ব কোণে এখন যেখানে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার বাড়ীটা দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে সাতটি গরুর গাড়ীতে চাপিয়ে মাল পৌঁছান হবে রডা কম্পানির গুদামে। ঠিকানা- ২ ভান্সিটার্ট রো। বিবাদী বাগে যেখানে এখন স্ট্যান্ডার্ড ইনস্যুরান্স এর বাড়িটা দাঁড়িয়ে। ঠিক দুপুর বারোটা নাগাদ গাড়ীগুলো ডালহৌসি স্কয়ারে পৌঁছে কাস্টম হাউসের দিকে যাত্রা শুরু করে। সঙ্গে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় হাবু মিত্র। সেখানে পৌঁছে পরিকল্পনা মত শ্রিশ মিত্র (হাবু) পঞ্চাশটা মাউসার, পিস্তল রাখার কাঠের কেস (এই কেসটাকে পিস্তলের বাঁটের সংগে জুড়ে নিলে রাইফেলের মতো ব্যবহার করা যায়), এবং ৪৬০০০ হাজার গুলির বাক্স তুলে দিলেন শেষের সাত নম্বর গরুর গাড়ীতে। সেই গাড়িতেই গাড়োয়ানের সহকারী হয়ে চেপে বসলেন বিপ্লবী হরিদাস দত্ত। পোশাক আশাকে চুলের ছাঁটে উনি তখন একেবারে পাক্কা হিন্দুস্তানি গাড়োয়ান। সৌজন্যে প্রভুদয়াল হিম্মতসিংকা। মেকআপটা তিনিই দিয়েছিলেন। কলকাতার রক্ষণশীল এবং রাজভক্ত মারওয়াড়ি সমাজের বেশ কিছু পরিবার এই বিপদজনক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন; সম্ভবত সেই প্রথম ও শেষ। জানাজানি হওয়ার পর ঐসব মানুষদের সমাজে একঘরে করা হয়েছিল।
১৯১৪ সালের ২৬শে অগাস্ট। দিনটা ছিল মেঘলা। দু-এক পসলা বৃষ্টিও হয়ে গেছে। কাস্টম হাউস থেকে গরুর গাড়ীর দল বেরোল লাইন দিয়ে। সবচেয়ে পেছনে সপ্তম গাড়ির আসল গাড়োয়ানকে হাবু মিত্র আগেই বলে দিয়েছে এই গাড়ী গুদামে নয় অন্য ঠিকানায় যাবে, আর তাকে রাস্তা দেখাবে তার সহকারী কুলী ‘অতুল‘ অর্থাৎ ছদ্মবেশী হরিদাস দত্ত। আসল গাড়োয়ানের তখন বিচার বিবেচনা করার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে মাদকের নেশায়। তাকে লুকিয়ে মাদক দ্রব্য খাওয়ান হয়েছিল। কার্যত গাড়িটা হরিদাস দত্তই চালিয়ে নিয়ে যান। (সত্যেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা “মলঙ্গার হাবু ও রডা কম্পানির অস্ত্র লুণ্ঠন” বইতে এই বর্ণনাটি আছে। উমা মুখার্জির লেখা উপর্যুক্ত বইটিতে শুধু হরিদাস দত্তের কথাই লেখা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই গাড়ি পরিচালনার ভার হরিদাস দত্তের হাতেই ছিল। গোরুর গাড়ি চালনায় উনি ভালই পারদর্শী ছিলেন)।
গাড়ী চলা শুরু করতেই গাড়ীর দুপাশে নিশব্দে চলতে শুরু করলেন শ্রিশ পাল এবং খগেন দাস। দুজনের কোমরে গোঁজা গুলী ভরা বন্দুক। আগে থেকে ঠিক ছিল, পুলিশের নজরে পড়লে দুজনে গুলি চালাতে শুরু করবেন এবং হরিদাস দত্ত মাউসার পিস্তল ভর্তি কাঠের বাক্স ভেঙ্গে গুলি ভরে সেই পিস্তল গুলো তাঁদের জোগান দেবেন ও নিজেও চালাবেন। একটি শাবল সেই উদ্দেশ্যে গাড়ীতে রাখা হয়েছিল।
ভান্সিটার্ট রোডের গুদামের কাছাকাছি এসে বাকি ছটা গাড়ী ঠিক জায়গায় পৌছেলেও সপ্তম ও শেষ গাড়ীটা সোজা এগিয়ে চলল মিশন রো (আর এন মুখার্জি রোড) বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, ম্যাঙ্গো লেন, ওয়েলিংটন স্ট্রিট হয়ে নিজ গন্তব্য মলঙ্গা লেনের কাছেপিঠে এক দোকানের সংলগ্ন বাতিল লোহা লক্কড়ের গুদামে। দোকানটি ছিল কান্তি মুখার্জির যিনি ছিলেন অনুকূল মুখার্জির বন্ধু ।
সেই সময় এই ঘটনার বিবরণে কাগজে হেডলাইন হয়েছিল দি গ্রেটেস্ট ডে লাইট রবারি বলে। ভাবা যায়! ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীর বুকে শহরের কেন্দ্রস্থল ডালহৌসি স্কয়ারে ভর দুপুরে সবার চোখের সামনে গরুর গাড়ীতে করে এতো গুলো অস্ত্র লুট হোল নিঃশব্দে, কোন রক্তপাত ছাড়াই! টান টান উত্তেজনার অভাব ছিলনা যদিও। তাই ভাবি, ভারতের, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের কোথাও এই ঘটনাটি ঘটলে সেখানকার চলচিত্র পরিচালকদের মধ্যে কেও না কেও একটি মেগা বাজেটের চলচিত্র অবশ্যই এতদিনে তৈরি করে বাজারে ছেড়ে দিত এবং বাঙ্গালিরাই সেটা দেখে ধন্য ধন্য করতো।
সেদিন কোন রক্তপাত না হলেও সেই শক্তিশালী অস্ত্র গুলো অনেক রক্তাক্ত বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সাক্ষী হয়েছিল ভবিষ্যতে। ১৯১৮ সালের সিডিসান রিপোর্ট অনুযায়ী অন্তত ২৭ টা কেসে মাওসার পিস্তল ব্যবহার করা হয়েছিল দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে বাঘা যতিন এবং তাঁর সাথিদের সাথে ঘটা বুড়িবালামের তীরের যুদ্ধেরও উল্লেখ আছে।
অস্ত্র লুটে আত্মোন্নতি ও মুক্তি সংঘের বিপ্লবীরা যুক্ত থাকলেও পিস্তল ও গুলী সব দলগুলোর মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। তার কিছু কিছু বাঙ্গালার বাইরেও যায়। ভগত সিং বৈপ্লবিক কাজের সূত্রে কোলকাতায় এলে তাঁকেও একটি পিস্তল দেওয়া হয়েছিল। লুটের মাল অধিকাংশ পুলিশ উদ্ধার করলেও বাকি পনেরটার মত পিস্তল ব্রিটিশ পুলিশের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। সেই পিস্তলগুলো ভবিষ্যতের অনেক বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সাক্ষী। আগেই বলেছি কাকোরি ট্রেন লুটের ঘটনায় মাউসার পিস্তল ব্যবহার করা হয়েছিল। মহান বিপ্লবী রাসবিহারী বসু দেশ ছাড়ার আগে তাঁর কাছে থাকা একটি পিস্তল কাকোরি কাণ্ডে যুক্ত বিপ্লবী শচিন্দ্রনাথ সান্যালকে দিয়ে যান।
ব্রিটিশ ভারতে এতো বড় অস্ত্র লুটের ঘটনা এতো নির্বিঘ্ন ও সুষ্ঠ ভাবে আর হয়নি। একটাও গুলি চলেনি এবং এই কেসেকেও ফাঁসিতে চড়েনি কিম্বা দ্বীপান্তরেও যায় নি। শুধু রডা কম্পানির মালবাবু শ্রিশ মিত্র ( হাবু ) হারিয়ে গিয়েছিলেন। আসামের রাভা বস্তিতে অজ্ঞাতবাসের সময় উনি এবং ওনার সাথি এক স্থানীয় রাভা যুবক নিখোঁজ হন। ওনাদের কোন খবর পাওয়া যায়নি। বলা হয় সম্ভবত বর্ডার পার করতে গিয়ে চিনা সৈনিকদের গুলিতে মারা পড়েছিলেন। বন্য জন্তুর আক্রমনে মারা যাওয়ার কথাও কেও কেও বলেন। ওনার কোন ছবি আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এমন তো কত বিপ্লবীই হারিয়ে গেছেন যাঁদের অনেকের নাম পর্যন্ত আমরা জানি না।
প্রত্যেক বছর ২৬ অগাস্ট আসে আর যায়। আমরা মনেও রাখিনা। আসলে জানিও না। কেই বা জানাবে! গনেশচন্দ্র এভেনিউতে অবশ্য এই রডা অস্ত্র লুণ্ঠনের একটি স্মারকবেদী তৈরি করা হয়েছে। ‘জাতীয় আর্ত ত্রাণ সমিতি’র পক্ষ থেকে রডা অস্ত্র লুণ্ঠন এর সংগে যুক্ত অনুকুল মুখার্জির ভাইপো গোপাল মুখার্জির (গোপাল পাঁঠা) নিজের উদ্যোগে সেটি তৈরি হয়। বিপিন বিহারি গাঙ্গুলি, অনুকুল মুখার্জি, গিরিন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ও হরিদাস দত্তের চারটি আবক্ষ মূর্তির সংগে মাউসারের যে মডেলটি লুট করা হয়েছিল (সি ৯৬) তারও একটি চিত্র আঁকা রয়েছে তার বাঁট সমেত। আর আঁকা আছে শ্রিশ মিত্র অর্থাৎ হাবুর ছবি যা ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে ; যে ভাবে উনি বাস্তবে গিয়েছিলেন।
২৬শে অগাস্ট খুব কম লোকই আসে সেই স্মৃতিবেদী দর্শনে। গোপাল মুখার্জির এক নাতি ঐ দিনে ফুল মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন নিয়ম করে। ২০২৪এর ২৬ এ অগাস্ট আগত প্রায়। হিসেব মত ঐ ঘটনার ১১০ বছর পূর্ণ হবে সেই দিন।
তথ্যসূত্র- TWO GREAT INDIAN REVOLUTIONARIES – উমা মুখার্জি।
আমিতাভ গুপ্তের ব্লগ ।