Wednesday, December 18, 2024
Homeমাৎস্যন্যায়বাম যেভাবে ফুটকি হল

বাম যেভাবে ফুটকি হল

শিরোনামটা খানিক তুচ্ছ শুনতে, এবং হাসির উদ্রেককারী। বাংলায় বামের বিধি বাম, এখানে বাম শব্দটি দ্বৈত অর্থ বহনকারী, তাই বাম এবং ফুটকি এ দুটি শব্দের দ্ব্যর্থহীন পরিভাষায় যাব আমরা প্রথমে। ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিম ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে বাম (ফরাসী পার্লামেন্টে স্পিকারের বাঁদিকে বসতেন বিরোধী দল, সেই থেকে বাম), তার কথা বলছি না আমরা। বাম বলতে এই প্রবন্ধে বাংলায় সিপিএম নেতৃত্বাধীন সমগ্র বামফ্রন্টকে বোঝানো হচ্ছে। সেই ফ্রন্টে থাকা, এবং ফ্রন্ট বহির্ভূত লিবারেশন, সুসি-সহ সব বাম দলই আজ বাংলায় মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়েছে। চৌত্রিশ বছর রাজত্ব করা বিরাট বাম গোষ্ঠীর জনসমর্থন (চন্দ্র)বিন্দুতে পরিণত হয়েছে, শূন্যবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, এই হল প্রবন্ধ শিরোনামে ফুটকির একটি প্রধান অর্থ।

অন্যদিকে এতদিনের অধিকাংশ বামসমর্থক যারা ধর্মকে খুব খারাপ জিনিস বলে চিনে এসেছিলো, তারাই রাতারাতি একটা ফুটকি জুড়ে বাম থেকে রাম হয়েছে, যার সূচনা অবশ্য নব্বই দশকের লালদুর্গ দমদমে, যখন বিজেপির তপন শিকদার লালদুর্গে জিতে গিয়ে চমক লাগান। সুভাষ চক্রবর্তীর অনুগামী বিক্ষুব্ধ সিপিএম অংশ, শিক্ষিত বাঙালির ব্লাইন্ড স্পট হিসেবে উদ্বাস্তু জনসংখ্যার অবদমিত অবচেতনে মুসলিম বিরোধিতা, এবং গৌণভাবে কংগ্রেস ভেঙে নতুন দল তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির জোট – এগুলি সেই আদিযুগের বাম থেকে রামের কারণ হিসেবে ছিল ভাবা হয়।

বাংলার বাম আন্দোলনের এই ফুটকিপ্রাপ্ত হবার আগের পথটা যতটা নিজে দেখেছি, বুঝেছি আগে সেটা নিয়েই বলা যাক। আমি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রী, সেজন্য ফুটকির দ্ব্যর্থক ব্যবহার এই প্রবন্ধের শিরোনামে রাখলাম। ফুটকি বসে বাম থেকে রাম, এবং চন্দ্রবিন্দু বসে বাম থেকে শূন্য, এ দুইই ফুটকির দ্বারা বোঝানো হচ্ছে। অর্থাৎ উপরেও একরকম ফুটকি ৺ আর নিচেও আরেক রকম ফুটকি বসেছে বামের।

আমার জন্ম নব্বই দশকের প্রথমদিকে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। কিন্তু মোটামুটি জ্ঞান হবার পর থেকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে জেনেছি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। সেসময় বাড়ির পরিবেশে বাম হাওয়া প্রবলভাবে প্রবাহিত হত। সিপিএমের লোকাল কমিটির নেতা নেতৃত্বদের আনাগোনা বাড়িতে লেগেই থাকতো। কারণটা যতটা না রাজনৈতিক তার থেকে অনেক বেশি শিক্ষার সঙ্গে জড়িত। সেসময় রাজনৈতিক নেতারা আজকের মতো হাম বড়ো টাইপের ছিলো না। বাবা বাংলার অধ্যাপক। সেকারণে কোথাও কোন বক্তৃতা দেবার হলে বক্তব্যের খসড়ার ভাষা বাবার থেকে যাচাই করিয়ে নিতো। অবশ্যই এর একটা ভালো দিক ছিলো। আজ মুখ্যমন্ত্রী থেকে পাড়ার চুনো পুঁটি নেতা সবার ভাষাই উপহাসের যোগ্য। সেসময় নেতারা অন্তত বুঝতো জনসমক্ষে মুখ খোলার আগে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয়। এরপরেও বাম আজ শূন্য। তার পেছনে অনেক কারণ। বামের ভাষা, মুখের কথায় বাংলার চিড়ে ভেজে নি, ভিজছে না আর। বামের কাজে কি চিঁড়ে ভিজেছিল?

আজ বাম আমলের কথা এলে চাকরি প্রিয় বাঙালি জাতির এক অংশ বলে ওঠে ‘সে সব সোনার দিন ছিলো। বছর বছর SSC হতো’। কিন্তু সেই বাম আমলেই CSC হত না বছরের পর বছর, সে কথা তারা চেপে যায়। কিন্তু CSC বা SSC কি সত্যিই কি বৃহত্তর বাঙালি জনতার কাছে গুরুত্বপূর্ণ? তাই দিয়ে যদি বাঙালির মন জেতা যেতো তাহলে আজকে বাংলার ক্ষমতায় তৃণমূল থাকতো না। মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে পাঠকগণকে অনুরোধ করবো শহুরে রঙিন চশমা খুলে বৃহত্তর গ্রামবাংলার প্রেক্ষিতে লেখাটি পাঠ করবেন।

মানুষের প্রধান চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান। কিন্তু এরপরেও আরও কিছু অধিকার ও আকাঙ্ক্ষা থাকে যা সাধারণ মানুষ একটা সরকারের থেকে আশা করে। যেমন স্বাস্থ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, ভালো রাস্তাঘাটের অধিকার, পানীয় জলের অধিকার, বাক স্বাধীনতার অধিকার, ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার অধিকার ইত্যাদি। বাম আমলের শেষের দিকে একটা গ্রাম-মফস্বলের মেয়ে হিসাবে দেখেছি প্রায় সবকটি অধিকার থেকেই সাধারণ মানুষ বঞ্চিত। এমনকি খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের সংস্থান-ও কি বাম আমলে ঠিক মতো ছিলো? তাহলে বাংলার মানুষ কেনো আমলাশোল দেখেছিলো?

এ লেখাটা যখন লিখছি তখন তৃণমূলের রেশন দুর্নীতি নিয়ে বাজার গরম হয়ে আছে। খাদ্যমন্ত্রী জেলে আছে। অপরাধী ধরা পড়ুক, তা খুশির বিষয়। ভুলে গেলে চলবে না এত রেশন দুর্নীতির মাঝেও বাংলার মানুষের দ্বিতীয় আমলাশোল দেখার দুর্ভাগ্য হয় নি তৃণমূল জমানায়। সত্যের অনুরোধে এ কথাও অনস্বীকার্য যে বাম জমানায় বাংলার মানুষ দেখেনি আমলাশোলের অনাহারে ভোগা মানুষগুলোর কাছে অপরাধী থাকা কোনো খাদ্যমন্ত্রীকে জেলে যেতে।

বাসস্থানের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া আমার তারকেশ্বরের বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। মাঝেমধ্যেই সপ্তাহ শেষে পাড়ি জমাতাম জঙ্গলমহলের দিকে। প্রকৃতির টানে গেলেও মানুষগুলোর জীবনযাত্রা খুবই দুঃখ দিত। আরামবাগ পেরলেই পাকা বাড়ি দেখা যেত না বললেই চলে। সারি সারি মাটির বাড়ি, মাটির দোতলা, তিনতলা। আমি সেগুলি আর দেখতে পাই না বলে একেবারেই নস্টালজিক হচ্ছি না। কারণ একে এই এলাকা বন্যাপ্রবণ, অন্যদিকে সাপের উৎপাত। তাই পাকা বাড়ি খুব দরকার। সরকার বদলাতেই কি সব মানুষ এক ধাক্কায় ধনী হয়ে গিয়ে পাকা বাড়ি করে ফেললো? উত্তর হলো- ‘না’। সরকার বদলাতেই পাকা বাড়ি করার অনুদানের টাকা পেলো সাধারণ মানুষ। ইন্দিরা গান্ধী আবাস যোজনা ১৯৮৫ সালের স্কিম। যা রাজীব গান্ধী শুরু করেছিলেন। সেই টাকা বন্টন হতো না সাধারণ মানুষের মধ্যে। বারবার ফেরত যেতো। তৃণমূল আমলে এই আবাস যোজনাতেও যথেষ্ট দুর্নীতি হয়েছে কিন্তু তারপরেও সাধারণ মানুষ হোগলা পাতার ছাউনির তলা থেকে বেরিয়ে মাথার উপর ছাদ পেয়েছে। এপ্রসঙ্গে বলা ভালো এখন এটি প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা বলে পরিচিত।

জঙ্গলমহল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। সালটা ২০০৭। জঙ্গলমহল একপ্রকার মাওবাদীদের দখলে। পুলিশ খুন, নেতা খুন নিত্য দিনের ঘটনা। কোনো দিন অবসরে বসে কি কখনো ভেবেছি কেনো এমন হচ্ছে? খুব সামনে থেকে দেখা অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সামান্য জলের জন্য মানুষকে পাড়ি দিতে দেখেছি মাইলের পর মাইল, পিঁপড়ের ডিমকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করতে দেখেছি, একটা ল্যাঙট ছাড়া বস্ত্র বলতে কিছু না থাকা মানুষজন দেখেছি, আর দেখেছি জঙ্গলের ভেতরে থাকা রাজকীয় গেস্ট হাউসে নেতা মন্ত্রীদের রাজকীয় উল্লাস। যেটা বলছিলাম সালটা ২০০৭। আমার বয়স ১৫। এক সাংবাদিক কাকু জঙ্গলমহলের উপর রিপোর্ট তৈরি করবে ঠিক করলো। বাবাকে অনুরোধ করলো সঙ্গে যাওয়ার জন্য। চিরকালই বাবা দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তে আমাকে সঙ্গী করার চেষ্টা করেছে। সপরিবারে সেই কাকুর সঙ্গে যাত্রা জমালাম। গন্তব্য পুরুলিয়া। ভয়ঙ্কর বৈষম্যকে ভীষণ কাছ থেকে দেখেছিলাম। প্রথমদিন আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন কোনো এক মন্ত্রী। নাম মনে নেই। সেই প্রথম রাজকীয় আয়োজন কাকে বলে জেনেছিলাম। কিন্তু পরের দিন সকাল হতেই স্বপ্নের জগত থেকে দুঃস্বপ্নের জগতে পা পড়ল।

ঠিক যেদিন বুঝেছিলাম ঐশ্বর্য কাকে বলে তারপরের দিনই জানা গেল অভাব কাকে বলে। পাশাপাশি জেনে অবাক হয়েছি হেনস্তা কাকে বলে। গ্রামবাসীরা জানিয়েছিলেন, মাওবাদী নেতাদের ধরতে না পারলে গ্রামবাসীদের তুলে নিয়ে যেত পুলিশ। চালাতো অকথ্য অত্যাচার। অত্যাচারের নমুনা কিছুটা নিজেরাও স্বচক্ষে দেখি। নাকা চেকিং-এর নামে রাষ্ট্রের অসভ্যতাকেও সেদিন প্রত্যক্ষের সুযোগ ঘটেছিল।

২০২৩ এর জানুয়ারিতে আবার পা রাখলাম জঙ্গলমহলে। পাড়ায় পাড়ায় জলের কল, পাকা বাড়ি দেখে বেশ আনন্দ জেগেছিলো। বাড়ি ফিরেই আমলাশোলের অবস্থা জানতে গুগল করেছিলাম। সেখানে এখন পিচ ঢালা মসৃণ কালো রাস্তা, পাকা দেওয়ালের প্রাথমিক বিদ্যালয়, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, শিশু উদ্যান, রেশনে চাল, গম, আটার নিয়মিত বিলি ব্যবস্থা, সপ্তাহে তিনিদিন ভ্রাম্যমান চিকিৎসাকেন্দ্রের গাড়ি আসে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তারও থাকেন। আপনিও সার্চ করে দেখতে পারেন মমতা কাদের ভোটে আসলে জিতছেন, কেনো জিতছেন। এটুকু পড়ে একদমই ভাবার প্রয়োজন নেই তৃণমূল আমলে আমলাশোল স্বর্গ হয়ে গেছে। সমস্যা এখনো অনেক আছে।  মানুষ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান পেয়েছে কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা হারিয়েছে। সরকার বিরোধী ব্যক্তির পরিণতি বারবারই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে মমতার সরকারকে। মনুসংহিতায় স্ত্রীকে বশে রাখার ক’টা উপায় বলা আছে। যেমন প্রথমে ভালো বাসতে হবে, উপহার দিতে হবে তাতেও বশে না থাকলে প্রহার করতে হবে। বর্তমান তৃণমূল সরকার বাংলার মানুষকে এভাবেই পাশে রেখেছে।

একটা স্থানের উন্নতি তখনই সম্ভব যখন সেখানের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকে। আমলাশোলের খবরের প্রথম বাক্যটাতেই ছিলো, ‘পিচঢালা মসৃণ কালো রাস্তা’। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যায় ১২ নম্বর রাস্তা। সে রাস্তার অবস্থা আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। এই ১২ নম্বর রাস্তার সমান্তরালে চলে ২৬ নম্বর রাস্তা। সে রাস্তাও গঙ্গালাভ করেছিলো। এখন প্রধান রাস্তাগুলি অনেকটাই ভালো। আগে গ্রামের ভেতরে ভেতরে মোরাম ভরসা। বর্ষাকালে তার অবস্থা কী হত তা সহজেই অনুমেয়। ২০০০ সালে প্রথম শুরু হয় প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে টাকা ব্যবহার হতো না। ফিরে যেত। বামের ভাবটা ছিল এমন যেন বাংলার সব উন্নয়ন হয়ে গেছে।

আজ গ্রামের ভেতরেও প্রায় প্রতিটা রাস্তা পাকা। রাস্তার কোয়ালিটি অতীব জঘন্য, প্রতি ইঞ্চিতে দুর্নীতির সাক্ষ্য, তবু মানুষ তৃণমূলকেই চায় কারণ কাদাময়, পিচ্ছিল মোরামের থেকে যেমনই হোক পাকা রাস্তা অনেক ভালো। রাস্তা প্রসঙ্গে আর একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়।

অনেক হলো দক্ষিণবঙ্গের কথা। সালটা ২০১০। বামের পতন শুরু হয়ে গেছে। আমরা গেছিলাম দক্ষিণবঙ্গ থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা উত্তরবঙ্গ। সব জেলা কভার করতে করতে। সে আরেক অভিজ্ঞতা। কোথাও কোথাও রাস্তা বলে কিছু নেই। মুর্শিদাবাদে রাস্তার উপরেই বাজার, জ্যামে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে। যে দাদা সেই যাত্রায় আমাদের গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেছিলেন সে দাদার মুখে শোনা রাস্তা নাকি এখন ঝকঝকে হয়ে গেছে। হয়তো দাদা যতটা বলে ততটা হয়নি কিন্তু আমরা যারা রাস্তা বলতে নরক দর্শন করেছি তাদের কাছে নিশ্চয় পরিবর্তনটা আমূল হয়ে ধরা দেবে।

উত্তরবঙ্গ হলো, জঙ্গলমহল হলো। সুন্দরবন অঞ্চলই বা বাদ যায় কেনো। আমার জীবনের প্রথম কুড়ি বছরে আমি বাংলাকে চিনেছি। বাংলার এমন কোনো জেলা নেই যার প্রতি কোণায় ঘুরিনি। কেবল পরিব্রাজকের দৃষ্টিতে দেখিনি অনেক সময় দেখার সুযোগ ঘটেছে স্থানীয় মানুষের দৃষ্টিতে। উত্তরবঙ্গ যাত্রার প্রথম দিন ছিলাম মালদায় এক পরিচিতের বাড়িতে, ফেরার পথে দিনাজপুরেও তাই। হোটেলে থাকার সঙ্গে বাড়িতে থাকার মধ্যে ফারাক আছে। ২০২৩ সালে যখন এত হোমস্টে-র রমরমা, তখন আর ফারাকটা আলাদা করে বোঝানোর অপেক্ষা রাখে না। সুন্দরবন যখন গেলাম তখন ২০০৪ সাল। ট্রেনে করে ক্যানিং তারপর লঞ্চ ধরে যাবো রাঙাবেলিয়া। সেখানে এক দাদুর বাড়ি।

কোন সম্পর্কে দাদু সেটা জানানো আলোচনার প্রেক্ষিতেই বলা প্রয়োজন। বাম আমলের আর এক বিষয়ের আলোচনায় এই দাদুর কথা আর একবার আসবে। আমার মামারবাড়ির দাদুরা এক অর্থে বৃহৎ ভূস্বামী, প্রায় জমিদার বলা যায়। প্রতিবছর ধান কাটতে সুন্দরবনের এসব এলাকা থেকে মানুষজন যায় আমার মামারবাড়িতে। এমনি একজনের বাড়িতে আমরা যাচ্ছি। যা জেনেছি তাতে সকলের মুখে আতঙ্ক। তবু যাবো। যা যা জেনেছি আগে জানিয়ে দিই

১) ক্যানিং থেকে লঞ্চে করে যেতে লাগবে চার ঘন্টা এরমধ্যে অবশ্যই সাক্ষাৎ হবে জলদস্যুদের সঙ্গে। যারা টাকা পয়সা লুঠ করবে।

২) অল্প বয়সী মেয়ে দলে না থাকাই ভালো। বরুণ বিশ্বাস যে সমস্যার প্রতিবাদ করেছিলো বাম আমলের শেষের দশকে সেই ধর্ষণ প্রান্তিক এলাকায় মহামারি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

৩) যাদের বাড়ি যাচ্ছি তাদের মাটির বাড়ি। সাপের একটা সমস্যা আছেই। কিন্তু চিকিৎসার জায়গা নেই।

৪) তাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। অন্ধকার হলেই ঘুমিয়ে যেতে হবে। রাতে বাথরুমের যাওয়ার প্রয়োজন হলে ফাঁকা খামারের প্রান্ত ভরসা। কিন্তু বাড়ির সকলকে ডাকতে হবে সঙ্গে লাঠি নিয়ে দাঁড়াবে। বাঘমামা সেই খামারে রাতে ঘোরাঘুরি করে।

৫) কোথাও যাওয়ার জন্য সাইকেল ভ্যান রিক্সাই ভরসা।

তাহলে বুঝতেই পারছেন সেসময় সুন্দরবনের মানুষ কীভাবে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে বেঁচেছিলো বা বলা ভালো মরেছিলো। জলদস্যু আক্রমণ, ধর্ষণ ইত্যাদিকে মানুষ সাধারণ ঘটনা বলে ভাবতে শুরু করেছিলো। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিলো আমাদের লঞ্চ সেই দস্যুর আক্রমণের শিকার হয়নি। কিন্তু সমগ্র যাত্রায় সকল মানুষের মুখে কেবল এক গল্প আর এক আতঙ্ক। সোনার বাম আমলের শাসন ব্যবস্থার এটা একটা সামান্য উদাহরণ মাত্র।

সেই দাদুর মুখেই শুনি আজ তাদের গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে, পাকাবাড়ি হয়েছে, বাথরুমে যাওয়ার দরকার হলে আর বাঘের কথা ভাবতে হয় না। জলদস্যুর কথা ভাবলে নাকি তার মনে হয় সেসব গতজন্মের কথা। সুতরাং বাম আমলের পর মানুষগুলো নবজন্ম পেয়েছে। মজার কথা হলো সেই দাদুর দলবল আর বিশেষ ধান কাটতে আসে না। তবে এটা ভাবার কারণ নেই যে তৃণমূল আমলে অন্নের ব্যবস্থা বাড়িতে থেকেই সম্ভব হচ্ছে। তা যে হচ্ছে না করোমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা সেই সত্যকেই সামনে এনেছে। অগণিত মানুষের অন্ধ্রপ্রদেশে ধান কাটতে যাওয়ার তথ্য জানা গেছে। সুতরাং ওখানে পারিশ্রমিক অনেক বেশি পায় এই কৃষিশ্রমিকরা। বাংলায় যে সস্তায় শ্রম কেনার নির্লজ্জ প্রথা (রাস্তায় সিভিক পুলিশ, কলেজে স্যাক্ট ইত্যাদি) শুরু হয়েছে তাতে মানুষকে আরও বেশি করে পরিযায়ী বানাচ্ছে। যা একটা জাতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

বাম আমলের স্মৃতি এখনো যাদের চোখ থেকে মুছে যায়নি তারা একটুও না ভেবে সহমত হবেন, যে সেসময় গ্রামীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর কথা ছেড়েই দিলাম, সদর হসপিটালগুলোতে ঢোকার চেষ্টা করতে গেলেও বমি হয়ে যেতো। সেই পরিস্থিতি যে বদলেছে তা সকলেই মানবেন। ছোটোবেলায় দেখতাম সাপে কাটা রোগীকে আমাদের গ্রামীন হসপিটাল কোলকাতায় ট্রান্সফার করে দিত অ্যান্টিভেনামের অভাবে। আজ সেই হসপিটাল থেকে একশো শতাংশ সাপে কাটা রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে, যদি হাতুড়ে পদ্ধতির পেছনে সময় নষ্ট না করে তৎক্ষণাৎ হসপিটাল আসতে পারে।

যে হসপিটালে গেলে বেঁচে ফেরার কোনো নিশ্চয়তা ছিলো না আজ সেখানে ভর্তি হতে পারার সুযোগ চায় মানুষ। আমার এক বান্ধবী। যথেষ্ট অর্থবান বাড়ির মেয়ে। সন্তান জন্ম দেবার সময় সরকারি হসপিটালকেই পছন্দ করলো নার্সিং হোমের পরিবর্তে। প্রতিবন্ধকতা এখনো আছে। কিন্তু যে মানুষ কিছুই পেতো না সেই মানুষ কিছু তো পাচ্ছে। রোগ সংক্রমণ এড়াতে, পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দিতে বর্তমান সরকার হসপিটালে লিনেনের ক্ষেত্রে সাতদিনের সাত রঙ নীতি চালু করেছেন। হসপিটালের বেডের চাদর প্রতিদিন বদলানো হচ্ছে কি না তা চাদরের রঙ দেখেই বোঝা যাবে। হয়তো বাস্তবায়ণ সব সময় সম্পূর্ণভাবে সম্ভব হয় না, কিন্তু উদ্যোগটি ভালো। আজ কেন্দ্র সরকার-ও কম দামে ওষুধ মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। কিন্তু এটা যে সম্ভব, তা বাংলার মানুষ জেনেছিলো আগেই। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকারের ন্যায্য মূল্য প্রকল্প থেকে। বর্তমানে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প-ও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বায়বীয় আদর্শবাদের জগত থেকে বেরিয়ে এই বিষয়গুলো নিয়েও যে ভাবতে হয়, তা বোঝেনি বাম সরকার। তাই মানুষ তাদের ছুঁড়ে ফেলেছে।

আজ বাংলার শিক্ষার হাল একেবারেই বেহাল। এর সুত্রপাত বাম আমলেই। বর্তমান সরকার কেবল তার ঐতিহ্য বহন করছে মাত্র। বাম সরকার অবচেতনে হলেও মনে করতো, “যত বেশি জানবে, তত কম মানবে”। একরঙা, একচোখো, অগভীর অশিক্ষা বিপন্ন করেছে বাঙালিকে। এমনিতেই শিক্ষার শুরু হয় নিজেকে জানার মধ্যে দিয়ে। বাম সরকার দায়িত্ব নিয়ে সিলেবাস থেকে বাংলার নিজস্ব বিষয় যেমন শিল্প, বাণিজ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, ইতিহাস, ভূগোলকে তুলে দিয়েছিলো। পাশাপাশি বিশ্বকে জানার রাস্তাটাও বন্ধ করতে চেয়েছিলো প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দিয়ে যা একটা গোটা প্রজন্মের ভিত নড়বড়ে করে দিলো। শিক্ষাকে কফিনে ভরে যেটুকু পেরেক পোঁতা বাকি ছিলো সেটা সম্পূর্ণ করলো বর্তমান তৃণমূল সরকার পাশ ফেল তুলে দিয়ে। একটা অশিক্ষিত জাতির জন্ম হলো। এখানে সর্বভারতীয় শিক্ষানীতির একটা দোহাই দেওয়া যায় বটে, কিন্তু অন্ধভাবে আদর্শ অনুকরণ করলে বাস্তবের মাটি নড়বড়ে হয়ে যায়।

তাঁবেদারি, তোলাবাজি বাংলার আজ প্রধান শিল্প। বাংলাকে বিরোধীশূন্য করে রাখতে এদের ভূমিকাও কম নয়। শিক্ষার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আর একটা বিষয়ে এখানেই আলোকপাত করে নেওয়া প্রয়োজন। তা হলো অতিরিক্ত তোষণনীতি। আজ যে বাংলায় এত রাম হনুমানের দাপাদাপি তার কারণ লুকিয়ে আছে বাম আমলেই। বামেদের কাছে ধর্ম অত্যন্ত খারাপ জিনিস, অথচ বাংলায় মাদ্রাসা শিক্ষার আমদানি বামেরাই করেছিলো। প্রতিটি ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া থাকেই। তসলিমাকে তাড়ানো থেকে শুরু করে ধর্মতলায় গোমাংস খাওয়া কোনোটাই সংখ্যাগুরু বাঙালি পছন্দ করে নি। বামেরা চিরকালই বাংলার হিন্দুর ধর্মীয় আবেগকে হেয় করে এসেছে আর মুসলিমদের ধর্মীয় আবেগকে তোল্লাই দিয়েছে যার ফল ভোগ করছে এখন। এমনকি বিজেপিকে আটকাতে ২০২১ সালে এসে হাত ধরলো আব্বাসের মতো চূড়ান্ত গোঁড়া ইসলামিষ্টের। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বামকে ছুঁড়ে ফেলেছে। মজার ব্যাপার এই সুযোগেই অবদমিত আবেগের মতো প্রাক্তন বামেদের অবদমিত রামভক্তি উথলে উঠছে। কিন্তু বাংলার ঐতিহ্য, বাংলার শেকড়, বাংলা তন্ত্রধর্ম চেনে না তারা কারণ দীর্ঘদিনের বাম-বিশ্বমানবতা। তাই সহজেই ফুটকি লাগিয়ে বাম থেকে রাম হয়ে উঠেছে।

আজ বাঙালির অর্থনৈতিক অবস্থা তলানিতে যে পৌঁছেছে তার পেছনেও বামেদের অবদান অনস্বীকার্য। শিল্পের কথা ছেড়েই দিলাম। তাকে প্রায় চিতায় তুলেই ক্ষমতায় এসেছিলো, বাকিটা ক্ষমতায় আসার পর শেষ করেছে। অস্বীকার করা যায় না, একা বামের দায় নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি দায়ী অনেকাংশে, রণজিৎ রায়ের ধ্বংসের পথে পশ্চিমবঙ্গ দ্রষ্টব্য। তবে কিনা নিজের স্বার্থ পাগলেও বোঝে, কিন্তু বাম বাঙালি কোনও দিন নিজের জাতির স্বার্থ দেখে নি।

বাংলার মেরুদণ্ড কৃষি। সেই কৃষিকেও শেষ করেছে। ভূমি সংস্কারের নামে চাষের জমিকে করেছে খণ্ডিত। এর অসুবিধা নিয়ে একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখা প্রয়োজন। আপাতত এটাই বলার, এই বর্গা নীতি কৃষকের পেটের পাশাপাশি বাংলার অর্থনীতির পেটেও লাথি মেরেছে। বাঙালি কৃষকের মেরুদণ্ড ভাঙার জন্য জমিবন্টন নীতি যথেষ্ট ছিলো। জমিহীন শহরে থাকা মানুষরা বর্গা আন্দোলনকে ক্ষেতমজুরদের স্বার্থরক্ষাকারী মনে করেন, কারণ জমির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই, তারা বৃহৎ চাষীর গুরুত্ব বোঝেন না। আজ বাংলায় কৃষিকে কেন্দ্র করে বৃহৎ কিছু ভাবা সম্ভবই নয় কারণ বড় আকারের জমি কোথাও নেই। একটানা জমি আছে, তা দেখতে বড় হলেও সে জমির মালিক অনেক। আর নানা মুনির নানা মত। আজ বড় বড় ট্রাক্টর নিয়ে পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকরা যখন কথায় কথায় দিল্লি চলো করে তখন খারাপ লাগে এটা ভেবে যে বাংলায় এমন বৃহৎ চাষীর উত্থান আর হয়ত সম্ভব নয়। কারণ আমি যদি ভাবি আমার জমিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে চাষ করবো বাকি চাষিরা রাজি হবে না। আর রাজি না হলে আমার জমিতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি যদি বলি অর্গানিক চাষ করবো তাও সম্ভব নয়। চারপাশের সবার জমির কীট কীটনাশকের কারণে তাড়া খেয়ে আমার জমিতে চলে আসবে। খুচরো কারখানার পাশাপাশি বৃহৎ শিল্পের মতোই বৃহৎ জমির মালিকানাও উন্নতির স্বার্থেই প্রয়োজন। যাক সেকথা।

এবার আসি, ক্রীতদাস বানিয়ে রাখতে চাওয়া কৃষকদের কথায়। সুন্দরবন নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে এক দাদুর কথা লিখেছিলাম। এবার জানা যাক সুদূর সন্দরবনের একটা মানুষ এত আপন হলো কীভাবে। আমার মামার বাড়ির দাদুদের পরিচয় ছিলো কংগ্রেস সমর্থক বলে। ৭৭ সালে সদ্য ক্ষমতায় আসা বামেদের মনে হয়েছিলো এই বাড়ির লোকজন নিশ্চয় বামকে ভোট দেয়নি, তাই সিপিএম পার্টি অফিস থেকে অর্ডার আসে অবরোধের।

কী সেই অবরোধ? দাদুদের জমির কাজে গ্রামের কেউ সাহায্য করতে পারবে না। ফলে দাদু কোনো কৃষি শ্রমিক পায়নি। অথচ চাষের মরসুম। সেসময় ত্রাতার মতো পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো সেই সুন্দরবনের দাদু ও তার দল। কিন্তু তাও কৃষিকাজে লোকবলের অভাব আমার দাদুর পরিবারে অশনি সঙ্কেত হয়ে নেমে আসে, ফলে বাড়ির বাচ্চাদেরও বড়োদের সঙ্গে জমির কাজে লাগতে হতো। আলু বসানোর চাপ কেমন সেটা তারাই জানেন যাদের একটু হলেও কৃষি জমি আছে। সিপিএমের ফতোয়ার ফলে জীবন দিতে হয় আমার ছোটমামাকে। বারো বছর বয়সী অত্যন্ত মেধাবী ছেলেটাকে বুঝতে বাধ্য করা হয়েছিলো সে না চাষের কাজে হাত না লাগালে পরিবারের আয় বন্ধ হবে। সেই ছোটমামা ব্লাড ক্যান্সারে মারা যায়। এমন অসুখের সম্ভাব্য কারণ হিসাবে জানা যায়, সে কীটনাশকের জলে আলুবীজ ধোয়ার কাজ করতো। তারপর যেভাবে হাত পরিষ্কার করতে হয় তা হয়ত ঠিক করে করে নি। এ তো একটা পরিবারের উদাহরণ মাত্র। এমন কত সহস্র পরিবারের দীর্ঘশ্বাস লেগে আছে বাম সরকারের গায়ে। সেই সমস্ত পাপেই দলটা আজ শূন্য।

যতই সাম্যবাদের বুলি আওড়াক বাম দল চূড়ান্তভাবে পুরুষতান্ত্রিক একটা দল। এখন দীপ্সিতা, মীনাক্ষী প্রমুখের নাম সামনে এলেও বামদলগুলোয় ক্ষমতাবান মহিলা দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়। বৃন্দা কারাটের ক্ষমতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। তৃণমূলের প্রধান মুখই একজন মহিলা এবং দলে নারী পুরুষের অনুপাত মন্দের ভালো। এমনকি বিজেপির মতো চরম পুরুষতান্ত্রিক দলের সরকারে অর্থমন্ত্রকের মতো অতবড়ো গুরুত্বপূর্ণ পদে একজন মহিলা। বর্তমানে রাষ্ট্রপতি একজন মহিলা। স্মৃতি ইরানি থেকে লকেট চট্টোপাধ্যায় অনেক নামই পরপর বলা যায়। এমনকি কংগ্রেস দলেও মহিলার গুরুত্ব চোখে পড়ার মতো। কিন্তু বাম জমানার মন্ত্রীসভার একজন মহিলাকেও এই লেখাটা লেখার সময় মনে করতে পারছি না।

মৌলবাদীদের কাছে নারী হলো সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। বামেদের কাছে পুরুষদের বিপ্লবে সহায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় নারী, বা সংসারের সব দায় নিয়ে পুরুষকে মুক্তি দানের যন্ত্র হল নারী। হোলটাইমার পার্টিকর্মী হবে পুরুষ, আর তার বাড়ির মহিলাদের চাকরি পাইয়ে দেবে বাম দলের সরকার। এই বামেদের কাছে পার্টি কর্মী আর পুরুষ সমার্থক। কিন্তু যে সব মহিলাদের চাকরি করার ক্ষমতা ছিলো না, অথচ বাড়ির পুরুষটির ঝাণ্ডা ধরার কাজ ছিলো বাধ্যতামূলক, এদের বড় অংশ বাড়ির হেঁসেলের অন্ধকারে জীবন কাটিয়েছেন বঞ্চিত হয়ে, ওদিকে বাম তখন বিশ্বজোরা বিপ্লবের খোয়াব দেখছিল ও দেখাচ্ছিল।

জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। সেই অর্ধেককে গুরুত্বহীন করে রেখেছিলো, বরের ভোটের সঙ্গে বৌ এর ভোট ফ্রীতে পাবে ধরে নিয়েছিলো বামেরা। বাংলার মেয়েদেরকে ভোটব্যাঙ্কের খাতিরেই হোক বা উন্নতির কারণে হোক মমতা এই জায়গাটাকেই ধরলেন। মেয়েরা ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম পেলো। তার সুফল মমতার ভোটবাক্সে গেছে। আজ বাংলায় কেবল হিন্দু মুসলমানের ভাগাভাগি ভোট হয় না, আজ ভোটে নারী পুরুষের ভাগাভাগিও হয়। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পগুলি বাংলার মেয়েদের মতামত গঠনের ভাষা দিয়েছে। আজ বাড়ির কর্তার সঙ্গে বাড়ির গিন্নির ভোট ফ্রী বলে গিন্নিকে গুরুত্বহীন ভাবার দিন শেষ হয়েছে। বাম আমলের ‘taken for granted’ হয়ে থাকা মহিলারা কোনো কিছুর মূল্যে বামেদের ফিরিয়ে আনতে চাইবে না।

***

লেখাটা শুরু করেছিলাম ২০২৩ সালের দুর্গা পুজোর সময়। নানা কারণে শেষ করা হয়নি। আজ ২০২৪ সালের মার্চে এসে যেদিন লিখতে বসলাম সেদিনই আশ্চর্যজনকভাবে লোকসভা ভোটের দিন ঘোষণা হলো। এই ভোটের দামামায় একেরপর এক রাজ্যে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্পের ঘোষণা হচ্ছে। মহিলা ভোটের গুরুত্ব প্রায় সব দলই আজ বুঝছে। একসময় বাংলার বাম ও বিজেপি এই প্রকল্পের আওতায় আসা মহিলাদের ভিখারির সঙ্গে তুলনা করতে পিছু পা হয় নি। সেই বামেরা যারা কৌটো নেড়ে পার্টি ফান্ড বানায়, সেই বিজেপি যাদের ইলেক্টরাল বন্ডের জোচ্চুরি আজ সকলের সামনে। যদি ধরেও নিই অলীক কল্পনায় বামেরা ক্ষমতায় আসবে। তখন তারা এই প্রকল্পগুলো নিয়ে কী করবে তা তারা এখনো স্পষ্ট করেনি। অন্যদিকে বিজেপি তিনগুণ বাড়িয়ে দেবার ঘোষণা সেরে ফেলেছে। সুতরাং মহিলা ভোট আজও বামেদের কাছে গুরুত্বহীন। ফলে আসন্ন লোকসভা ভোটে বাম ফুটকিই থাকছে তা একপ্রকার নিশ্চিত।

shoptodina.com
shoptodina.comhttps://shoptodina.com
সপ্তডিঙা। কথাটা শুনলেই মনে আসে বাঙালির সমুদ্রবাণিজ্যের এক গৌরবময় ইতিহাস। গৌড়ের বণিকরা সাতটি বিশাল নৌকার এই সমবায় নিয়ে সিংহল, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, চীন, রোম, গ্রীস, ক্রীট, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করে ফিরে আসতেন স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার নিয়ে। সপ্তডিঙা তাই বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির অভিজ্ঞান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Advertisingspot_img

Popular posts

My favorites