Wednesday, December 18, 2024
Homeবাঙালির ইতিহাসবাংলার বুকে প্রাচীনতম অস্তিত্ব যে লিপির, অর্থাৎ মহাস্থানগড় লিপি

বাংলার বুকে প্রাচীনতম অস্তিত্ব যে লিপির, অর্থাৎ মহাস্থানগড় লিপি

১৯৩১ সালে বারু ফকির নামে একজন খুঁজে পায়, এবং জি সি চন্দ্র তখনকার আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের পূর্ব ভারতের ডিরেক্টর এটি কলকাতায় আনেন। এই লিপির পাঠোদ্ধার একাধিক পণ্ডিত করেছেন। সাম্প্রতিকতম লিপি পাঠোদ্ধার করেছেন সুস্মিতা বসু মজুমদার।

কিন্তু এই লিপি নিয়ে আলোচনা পাঠ করতে গিয়ে একটা আশ্চর্য বিষয় লক্ষ করলাম। আগেও অবশ্য এটা চোখে পড়েছে।

★★■■★★

এই লিপি সাক্ষ্য দেয়, আমাদের ভূখণ্ডে একরকম “তরল” উচ্চারণ প্ৰচলিত ছিল যা আমাদের জিভে অতীব সাবলীলভাবে আসতো। সেই উচ্চারণে ল-এর প্রাবল্য ছিল, বাহুল্য ছিল আরও অনেকগুলি নরম ব্যঞ্জনবর্ণর, যেমন ত, থ, দ।

এই উচ্চারণবৈশিষ্ট্যকে হিন্দিতে তোতলা বলে, সেই দেখাদেখি অনেকে বাংলাতেও একই শব্দ প্রয়োগ করে এই “ত্রুটিপূর্ণ” উচ্চারণ বোঝাতে, যেমন তোতলা মহানায়ক দেব। কিন্তু বাংলায় তোতলা অর্থে stammer, হিন্দিতে যাকে হাকলা বলে।

হিন্দির তোতলা আক্ষরিক অর্থেই যারা ত এবং ল শব্দের বেশি প্রয়োগ করেন। এইভাবে যারা কথা বলেন, তাদের জিভের আড় ভাঙেনি, এজন্য তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ করার প্রথা

আশ্চর্য এই যে এইরকম উচ্চারণ শূদ্রকের লেখা সংস্কৃত নাটক মৃচ্ছকটিকে দেখি সংস্থানক বা শকার নামের ভিলেনের মুখে, সে স উচ্চারণ করতে পারে না, শ বলে, সেজন্য তাকে শকার নাম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে শুধু স-এর জায়গায় শ বলে তাই নয়, সে ওই হিন্দি অর্থে তোতলা, অর্থাৎ উচ্চারণে ত ও ল শব্দের প্রাবল্য। সর্বোপরি সে মাগধী উচ্চারণে কথা বলে।

কিছু বুঝতে পারছেন? প্রসেনজিৎকে পোসেনজিত, তৃণমূলকে তিনোমূল, এগুলো প্রাচীন পূর্ব মাগধী ভাষায় সহজাত উচ্চারণ। আমরা শান্তিনিকেতনী, শান্তিপুরী বা বালিগঞ্জী বাংলায় চিবিয়ে চিবিয়ে যে সংস্কৃত বা ইংরেজি ধাঁচে বাংলা বলি, ওটাই কৃত্রিম।

অর্থাৎ রোম না বলে লোম (র>ল)। হসপিটাল না বলে হাসপাতাল (ট>ত)।

অতীত আমাদের মধ্যে এখনও বেঁচে। কিন্তু পার্থক্য এই যে আমরা তাকে তাচ্ছিল্য করি, নিচু ভাবি, ঘৃণা করি, উপহাস করি।

কারণ মাঝখানে এসে গেছে সংস্কৃত। এসে গেছিল ফার্সি। এসে গেছিল ইংরেজি।

আমরা অন্যের সাম্রাজ্যভাষায় অভ্যস্ত হয়েছি, নিজের অতুলকীর্তি পূর্বসূরীর ভাষার উচ্চারণবৈশিষ্ট্যকে ঘৃণা করতে শিখেছি।

এবং গায়ের জোরে সর্বত্র তৎসম বানান চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে সহজে বোঝা যায় না, তথাকথিত শিক্ষিতজন তো আরও বুঝতে পারেন না, যে বাংলা ভাষা সংস্কৃত-অনুসারী নয়, এটি পূর্ব ভারতীয় ব্রাত্য অবৈদিক আর্যভাষা। এ ভাষা সংস্কৃত থেকে আসেনি, এর উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য তার অন্যতম সাক্ষ্য দেয়। এ ভাষার এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল প্রাচীন কালে। সে চেতনা আমাদের নেই বলেই আজও বাংলা ভাষা ধ্রুপদী মর্যাদা পায় নি। সংস্কৃত থেকে ডেরিভেটিভ হলে ধ্রুপদী হওয়ার কথাও নয়।

সংযোজন: আমাদের ব্রাত্য আর্য ভাষা সহ অনেকগুলি আর্যভাষার বৈশিষ্ট্য হল এতে যুক্তাক্ষর কম থাকে। স্প্যানিশ বা ইতালিয়ান বা ফরাসি ভাষা যেমন।

সংস্কৃত বা জার্মান ভাষায় অত্যধিক যুক্তাক্ষর হয়।

মহাস্থানগড় লিপিতে একটিও যুক্তাক্ষর পাবেন না, এক গণ্ডক শব্দে ছাড়া। আমাদের ভাষায় যুক্তাক্ষর বর্জনের প্রবণতা।

★★■■★★

মাত্র সাত লাইনের মহাস্থানগড় লিপিটি আংশিক ভগ্ন। এর কয়েকটি আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য। মৌর্য লিপিতে সর্বত্র দেখা যায় সম্রাট অশোকের উল্লেখ, কিন্তু এটি ব্যতিক্রম। এখানে কোনও সম্রাটের নাম নেই।

এখানে তার বদলে কয়েকজন নাগরিকের নাম আছে।

নগরের নাম “পুদনগল”। সংস্কৃত উচ্চারণে পুণ্ড্রনগর। অতি প্রাচীন নগর, অতি প্রাচীন সভ্যতা।

নগরের শাসনব্যবস্থার পক্ষ থেকে “দুমদিন” এই প্রস্তর লিপিটি উৎকীর্ণ করেছেন “সুলখিতে” (সুরক্ষিত) পুদনগল থেকে। খরা সমস্যা প্রতিরোধে ছবগ্-গীয় (সংবঙ্গীয়/ষড়বর্গীয়) দের নেতা গলদন (বিকল্প পাঠ তলদিন)-কে গণ্ডক মুদ্রা (একরকম তামার পয়সা) এবং ধান্য শস্য জোগাড় করার কথা বলা হয়েছে যা পরে “কোথাগাল” (কোষ্ঠাগার) পূর্ণ করে দিতে হবে খরা সমস্যা কেটে গেলে।

★★■■★★

এই লিপির অসীম গুরুত্ব আছে প্রাচীন ভারতে ত্রাণ ব্যবস্থা, রেশন বা গণবণ্টন ব্যবস্থা এবং সামাজিক পরিস্থিতি বুঝতে। বাংলায় সেযুগেও গণতন্ত্র ছিল সেজন্য সম্রাটের নামে নয়, এমনকি কোনও প্রদেশ শাসকের নামেও নয়। দুজন গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকের নামের উল্লেখ আছে এই লিপিতে। এই লিপির সামাজিক গুরুত্ব সম্পর্কে অনেকেই আলোচনা করেছেন।

কিন্তু এই লিপির বাচিক গুরুত্ব, ভাষিক গুরুত্ব, উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যর গুরুত্ব এবং বাঙালির অ-সংস্কৃত, অবৈদিক, ব্রাত্য আর্য শেকড়ের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত নিয়ে আমার জানা মতে আমিই প্রথম আলোচনা করলাম, এবং #বাঙালিরইতিহাস গ্রূপ তার সাক্ষী থাকল।

© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta

shoptodina.com
shoptodina.comhttps://shoptodina.com
সপ্তডিঙা। কথাটা শুনলেই মনে আসে বাঙালির সমুদ্রবাণিজ্যের এক গৌরবময় ইতিহাস। গৌড়ের বণিকরা সাতটি বিশাল নৌকার এই সমবায় নিয়ে সিংহল, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, চীন, রোম, গ্রীস, ক্রীট, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করে ফিরে আসতেন স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার নিয়ে। সপ্তডিঙা তাই বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির অভিজ্ঞান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Advertisingspot_img

Popular posts

My favorites