Wednesday, December 18, 2024
Homeবাঙালির ইতিহাসপ্রাচীন বাংলার শিল্পবাণিজ্যঃ গঙ্গারিডির কাল

প্রাচীন বাংলার শিল্পবাণিজ্যঃ গঙ্গারিডির কাল

গোটা পৃথিবীর অন্যান্য অংশ শিল্প আর বাণিজ্যে ভালো করে হাঁটতে শেখার আগেই বাঙালিরা শিল্প আর বাণিজ্যে পূর্বে ইন্দোনেশিয়া থেকে পশ্চিমে মিশর, গ্রিস এমনকি মহেঞ্জোদারো অবধি চষে ফেলেছিল, ইতিহাসে তার সাক্ষ্য প্রমাণ আছে। -লিখছেন ডঃ শুভ জোয়ারদার।

শিল্প ও বাণিজ্যের শব্দবন্ধে বাঙালীর প্রসঙ্গ উঠলেই এক লহমায় মাথায় আসে সন্ন্যাসীসম বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কথা। মনে আসে রামদুলাল সরকার বা হাওড়ার আলামোহন দাস, উনিশ শতকের প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর সহ সমকালের সাফল্যস্পর্শী পিয়ারলেস কম্পানি বা শ্রী-লেদার্সের কথা। একটা সময় ব্যবসাবিমুখ বলে বাঙালিদের কিছু বদনাম ছিল। কিন্তু মধ্যযুগে বাঙালি বনিক চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙা মধুকরের কথা তো আর তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায়না! সত্যি কথাটা হল, গোটা পৃথিবীর অন্যান্য অংশ শিল্প আর বাণিজ্যে ভালো করে হাঁটতে শেখার আগেই বাঙালিরা শিল্প আর বাণিজ্যে পূর্বে ইন্দোনেশিয়া থেকে পশ্চিমে মিশর, গ্রিস এমনকি মহেঞ্জোদারো অবধি চষে ফেলেছিল, ইতিহাসে তার সাক্ষ্য প্রমাণ আছে। পৃথিবীর শিল্প-বাণিজ্যের ইতিহাসে নথীকরণের নিরিখে প্রথমেই উঠে আসে দুর্ধর্ষ বেপরোয়া বঙ্গজ আদিবাসীদের নাম। এই নিবন্ধকার ঐতিহাসিক নন, তবে প্রাচীনতম পুতুল নাট্যকলার উৎস ইতিহাস তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে যে সমস্ত দলিল নথী ইত্যাদি হাতে এসেছে, তারই কিছু তথ্যাদি আপনাদের গোচরে আনার চেষ্টা করছি।

বিষয়টি যখন বাঙালিদের নিয়ে, বাংলার ভূখণ্ড নিয়ে কিছু কথা বলতেই হয়। একদা সমকালের দুই বঙ্গ ভূমি, বিহার, ওড়িশা , আসাম প্রশাসনের নথিতে ‘বাংলা’ হিসাবেই চিহ্নিত ছিল। পরবর্তী কালে নানা সময়ে, নানা কারণে টুকরো টুকরো করে সেই বৃহৎ বঙ্গকে ছোট করা হয়েছে। এসব বিভাজন বৌদ্ধযুগের অনেক পরের কথা। আমরা শুরু করতে চাই বহিরাগত যাযাবর বৈদিক আর্যরা এদেশে অভিযান চালাবার আগে থেকেই। ইতিহাস থেকে জানতে পারা যায়, বৈদিক আর্যরা ভারতে দখলদারি চালাবার আগেই ভারতের পূর্বাঞ্চলে তৎকালীন পাটলিপুত্র থেকে গঙ্গা নদীর মোহনা অবধি বিস্তৃত ছিল একটি গণরাজ্য, যা গ্রিক ঐতিহাসিকদের কলমে ‘গঙ্গারিডি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, গঙ্গানদীর অববাহিকার যে অঞ্চলটি মোটামুটি লাল মাটি বা রাঢ়ভূমি বলে খ্যাত, তাকে গ্রিক ঐতিহাসিকরা গঙ্গারিডি বলেছেন। ভূগোলের হিসাবে বাংলা-বিহার-ওড়িষার কিয়দংশসহ ছোটনাগপুরের সমগ্র অরণ্য, টিলা সন্নিহিত মালভূমি অঞ্চলকেই এই ক্ষেত্রসীমার মধ্যে বৃত্তায়িত করা যায়। অঞ্চলটি অবশ্যই বৃহৎবঙ্গের ক্ষেত্রাধিকারের অন্তর্গত। এর অধিবাসীরা মূলত কথ্য বাংলা ভাষায় কথা বলেন। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশ্চন্দ্র মজুমদার, ডঃ সুকুমার সেন, অতুল সুর,  পণ্ডিত দীনেশ্চন্দ্র সেন ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখদের গবেষনাপুষ্ট বিবরণাদি থেকে জানা যায় যে গঙ্গারিডির মানুষরা বৈদিক আর্যদের আগমনের অনেক আগেই এই অঞ্চলে একটি সুসংহত গণরাজ্য বা সিন্ডিকেট শাসন গড়ে তুলেছিল। এটার সূচনা হয়েছিল বৌদ্ধ যুগের আগেই। গোটা রাজ্যটি দুর্ভেদ্য ছিল বহিরাগতদের আক্রমণ থেকে। তাঁদের ছিল হাতি, ঘোড়া, পদাতিক বাহিনী সজ্জিত এক নিপুণ আর বেপরোয়া সেনাবাহিনী। ছিল সুদক্ষ নৌযোদ্ধাদের দল ও সমান্তরাল নাবিক শ্রেণী। ছিল ছোট ছোট পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সামাজিক স্বায়ত্ত্বশাসন। কুটির শিল্প, নৌশিল্প, ধাতুনিষ্কাশন পদ্ধতি, লোকনাট্য, ভেষজবিদ্যা কৌশল আর স্থাপত্য নির্মাণে এঁরা ছিলেন নিপুণ ও প্রকৃত অর্থে পেশাদারী। এই জাতি মাতৃপূজক ছিল। সেনাবাহিনী বিশেষ করে নৌবাহিনীতে মহিলাদের সমান অধিকার ছিল। শিল্পশ্রমিক, কারিগর, পাইক-বরকন্দাজ, কৃষক, সমাজপতি ও বণিকদের আলাদা আলাদা মর্যাদা দেওয়া হতো। প্রতিটি গ্রামসভা নগরাঞ্চলছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। উল্লেখিত ইতিহাসবিদরা মেগাস্থিনিসের বিবরণ ও গ্রিক ভাষায় লিখিত ‘পেরিপ্লাস’ গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত নথীসূত্রে এসব কথা জানিয়েছেন। সম্প্রতি বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে পাওয়া এক শিলালিপি থেকে জানা গেছে যে দুর্ভিক্ষ প্রতিহত করার জন্য ছিল নাগরিকদের শস্যগোলা, যা নিয়ন্ত্রিত হতো স্থানীয় সমবায়ের দ্বারা। যার অর্থ হল আধুনিক পৃথিবীর সমবায় বিজ্ঞানের জনক তথা প্রবর্তক হলেন প্রাগার্য যুগের বাঙালিরা। আমরা সময়টির কথা এখানে আলোচনা করছি সেটি মোটামুটি খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ পঞ্চম থেকে খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতকের কথা। আমাদের বহু আলোচিত ইতিহাসহীনতার কারণে যার কোনও সিস্টেমেটিক ডকুমেন্টেশান নেই। সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো অসংখ্য মিসিং লিঙ্ক। এটা যেমন সত্যি কথা, তার সঙ্গে এটাও মানতে হয় যে ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলংকা সূত্রে পাওয়া বৌদ্ধ পুঁথি, ভাটিকান সিটির মহাফেজখানায় সংরক্ষিত তুলট কাগজের প্রমাণাদি, গ্রিক পর্যটক এবং সাহিত্যাদি থেকে প্রাপ্ত মূল্যবান মন্তব্য সহ সমকালীন গবেষকদের অনুসন্ধান কর্ম থেকে উঠে আসা বিবরণাদি জুড়ে জুড়ে যা পাওয়া যাচ্ছে, সেটাও কম কিছু নয়।

প্রাগার্য অথবা অনার্য ভারতের এই ইতিহাসপূর্ব সুবর্ণযুগ নির্মাণে জাতি হিসাবে একমাত্র বঙ্গজ ক্ষেত্র সীমার মূল অধিবাসীদেরই কৃতিত্ব দেওয়া যায়। বিষয়টি যেহেতু বাঙালীর শিল্প আর বাণিজ্য সম্পর্কিত, তাই এই নিবন্ধে সেই গঙ্গারিডি সভ্যতার ব্যাপক অংশের কেবলমাত্র সম্পর্কিত বিষয়দুটি নিয়েই আমরা একটু আলোকপাত করতে চাই। এই বিষয়ে পণ্ডিত নরোত্তম হালদারের বিস্তৃত গবেষণা আছে।

শিল্প ও বাণিজ্যে বাঙালীর অধিকার কতোটা প্রাচীন?

আর্যরা ভারতে আসার আগেই তাম্র সভ্যতার পত্তন হয়। এখন ঐতিহাসিকরাই বলুন, সারা পৃথিবীতে সেই যুগে তামা সরবরাহ করেছেন কারা, কোথায় ছিল সেই সব তামার খনি? ঐতিহাসিকরা তো বটেই এমনকি ভূতত্ত্ববিদরাও একযোগে বলেন যে আজ থেকে অন্তত দশ হাজার বছর আগেই ছোটনাগপুরের অধিবাসীরা তামা ও লোহা নিষ্কাষণ পদ্ধতিতে পেশাদারী পটুত্ব অর্জন করেছিল। সেই তামা গঙ্গারিডির ভূগোলের মধ্যে অবস্থিত অধুনা পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক বা তৎকালীন তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে পালতোলা জাহাজে গুজরাটের লোথাল হয়ে প্রথমে মিশর,পরে গ্রিসে ও ইয়োরোপে সরবরাহ করা হত। সেই তামা নিশ্চয়ই গোটা পৃথিবীর সভ্য দেশগুলিতে চাহিদানুসারে লাগাতারভাবে বাণিজ্যিক চুক্তি ভিত্তিতে সরবরাহ করতেন সেকালের বাঙালি বণিকেরা। নৌপথে মাসাধিক কাল ধরে তা নিয়ে আসতেন বাঙালি নাবিকেরা। অর্থাৎ বাঙালি নাবিক আর বণিকেরা, সেই গণরাজ্যের বসবাসকারী অধিবাসীরা তাঁদের অপরিসীম দক্ষতা আর পরিশ্রমে এশিয়ার পূর্বপ্রান্ত থেকে একটা সুসংহত বাণিজ্যকর্মের প্রচলন করে ছিলেন। এই বাণিজ্যকর্মের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন ছিলেন গঙ্গারিডি সভ্যতার বাঙালি। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত প্রথম জাতির সম্মান বাঙালিরই প্রাপ্য। বাঙালিদের শিল্পবাণিজ্যে এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়টি ঘটেছিল আর্যরা ভারতে আসার আগেই। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে গঙ্গারিডি সভ্যতা আর মহেঞ্জদাড়ো সভ্যতা প্রায় সমকালীন। কৌতূহলী গবেষকদের মতে মহেঞ্জদাড়ো সভ্যতার প্রেক্ষাপট, তার প্রকৃতি, ভূগোল, সমাজ আর্থসামাজিক পটভূমি গঙ্গারিডি সভ্যতার সমচরিত্রের। দুটিই উপমহাদেশের দুই প্রান্তের নদীমাতৃক বদ্বীপ অঞ্চলের সভ্যতা। যদিও ইতিহাসের নিরিখে এই দুই সভ্যতা সমগুরুত্বের হলেও গ্রীক সাহিত্য আর পর্যটকদের কিছু প্রয়োজনীয় মন্তব্য ছাড়া গঙ্গারিডি আমাদের কাছে বিস্মৃতির আড়ালে নির্বাসিত ছিল। এর পাশাপাশি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বৈদিক আর্য পূর্ববর্তী বাংলা তথা ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে আমরাও খুব একটা কৌতূহল দেখাইনি।

বাঙালীর প্রাচীন শিল্পবাণিজ্য নিয়ে একটু ধারণা।

বাঙলায় শিল্প বলতে আমরা কলা এবং কারিগরি নির্মাণ কর্ম দুই-ই বুঝি। প্রথমটি আর্টস আর দ্বিতীয়টি ইন্ডাস্ট্রির সমার্থক। মজার কথা এই উভয় বিষয়েই সেকালের বাঙালিদের বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। কাঠ মাটি বা ধাতু নির্মিত শৌখিন খেলনা, মনোহারী গৃহসজ্জার উপকরণ, পুতুল, দেবী মূর্তি নির্মাণ, পট অঙ্কনে গঙ্গারিডির কারিগররা ছিলেন অতুলনীয়। ‘বৃহৎ বঙ্গ’-এর লেখক ডঃ দীনেশচন্দ্র সেনের প্রাসঙ্গিক মন্তব্য হলঃ আদি বঙ্গের নিম্নবর্গীয় শিল্প- কারিগর শ্রেণী উচ্চ গুণমানের শিল্পকর্ম তথা পট অঙ্কন, দারু কর্ম, মৃৎ শিল্পকর্ম, ধাতু বা চামড়ার কারুকর্ম, বয়ন বা সূচী শিল্পে, রাজমিস্ত্রির কাজ বা ভাস্কর্যে এতটাই দক্ষ ছিল যে  প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যের প্রাথমিক প্রাসাদ  সৌধ নির্মাণ কর্মে ও তারা প্রায়শই দেশীয় বনিক ও নাবিকের সঙ্গে বিদেশে পাড়ি দিতো। বিশেষ কদর ছিল রাজমিস্ত্রি, তক্ষনশিল্পি আর মস্করি (পটচিত্রী) দের। এর সমর্থন পাওয়া যায় কৌটিল্যের অর্থ শাস্ত্রেও। সেখানে বলা, হয়েছে, ‘গ্রামসভার অর্থ হল এক গুচ্ছ গ্রাম বা কম করে দশটি থেকে বিশটি জনপদের সমবেত ভাবে স্বয়ং সম্পূর্ণ যাপন। প্রতিটি গ্রামসভাতে থাকতো মজুত শস্যগোলা, থাকতো নিত্যদিনের সামাজিক জীবন ধারণের যাবতীয় কারিগরদের বাস। তাদের শিল্প বস্তুর সংরক্ষণ, বিক্রয়, সরবরাহ ও কর্মশালার ব্যবস্থা ছিল। গ্রামসভার মাথাকে ‘প্রধান’ বলা হতো। নির্বাচিত হতেন প্রতিটি গ্রামীণ পরিবারের প্রতিনিধিদের দ্বারা। প্রধানরা রাজ প্রতিনিধিদের কর দিতেন এবং তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতেন, বহির্শত্রুর আক্রমনে সুরক্ষিত হতেন। গ্রামসভাগুলির ওপর ছিল ‘সমাজ’ আর সমাজে সবচেয়ে মান্যতা দেওয়া হতো শিক্ষক বা আচার্যদের। তারপরে ক্রমান্বয়ে শিল্পি, কারিগর ও কৃষকদের স্থান ছিল। গ্রামের ঠিক কেন্দ্রে স্থাপিত হতো সমবেত শস্যগোলা আর নাটমন্দির। হ্যাঁ, নিজ নিজ আঞ্চলিক লোকনাট্যে , গঙ্গারিডির বঙ্গবাসী ভূমিজরা সহজাত ছিল। মেলা উৎসবে নাচগান হতো। গীতবহুল পালাগানের চর্চা ছিল। তাতে সাধারণের অধিকার ছিল। ‘নট’ বলে এক শ্রেণীর পেশা ছিল। পালাগান ( নাট্য ও পুতুল নাচ) শেখানোর জন্য আচার্যরা প্রশাসন থেকে মাসোহারা এবং ‘সিধে’ পেতেন। বিশ্বস্ত আচার্যরা চলমান বিনোদনচর্চার কারনে প্রতিবেশী রাজ্যে গমন করলে প্রয়োজনে প্রশাসনের অনুরোধে দৌত্য কর্ম বা খবরাখবরের আদানপ্রদানও করতেন। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে ভরত মুনি তার নাট্যশাস্ত্র লিখেছিলেন কমবেশি ১৫০০ খৃস্ট পূর্বাব্দে বা আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। আমাদের অভিজাতদের নাট্যচর্চার সূচনা তার আগে। আর লোকনাট্যের অভ্যাস সম্ভবত তারও আগে। সংস্কৃতি গবেষকদের অনুমান সারা পৃথিবীর থিয়েটারের উৎস গ্রীক থিয়েটারের বীজ বপন করেছিলেন গঙ্গারিডির বনিক আর নাবিকেরাই। কারণ নাট্যশাস্ত্র রচনার কাল আর ডঃ অতুল সুরের সিদ্ধান্তে বাঙালি নাবিক বণিকদের তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে লোথাল হয়ে গ্রিস দেশে রণতরী ও বাণিজ্যতরী নিয়ে গ্রিসে পৌঁছাবার কালটিও অত্যন্ত প্রাচীন। ডঃ অতুল সুরের মন্তব্যঃ গ্রীক ঐতিহাসিক ও সাহিত্য ‘পেরিপ্লাস’ থেকে জানা যায় বাজার দখলের জন্য গ্রীক সৈন্যবাহিনী আর গঙ্গারিডির বাঙালি বণিকদের মধ্যে এমন প্রাণঘাতী নৌযুদ্ধ হয়েছিল যে সেই যুদ্ধে গঙ্গারিডির বাঙালি নাবিক বণিকদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা সোনার অক্ষরে লেখা রয়েছে। অনুমান করা যায় যে গ্রীক সভ্যতার উত্থানের কালে মূলত ধাতব যন্ত্রপাতি ও সামাজিক তৈজসপত্র ইত্যাদির চাহিদার কারণে বাঙালিরা ইতিপূর্বেই সেই যবনদেশে হাজির হয়েছিল। উপনিবেশ অর্থে বন্দর সংলগ্ন এলাকায় বাণিজ্যপোত মেরামতি ও বিপণনের উদ্দেশ্যে বসতি স্থাপন করেছিল। দেশীয় উৎপাদন সামগ্রি প্রতিযোগিতাতে পশ্চাৎ অপসরণের কারনেই সম্মুখ সমর। বলা বাহুল্য বাঙ্গালীদের পণ্যের গুণমানের মতো, তাদের নাবিক তথা যোদ্ধারাও যথেষ্ট রণকুশল ছিল। ফলে গঙ্গারিডির বণিকদের ব্যবসা সেই যুদ্ধের পরবর্তীকালে আরও প্রসারিত হয়। গ্রিসের নানান জনপদে বাঙালীরা স্থায়ী বসবাস উপযোগী উপনিবেশ নির্মাণ করে। শুধু গ্রিসেই নয়, তাম্রলিপ্ত থেকে ইউরোপে পৌঁছাবার জন্য দীর্ঘদিনের সমুদ্রযাত্রায় বাঙালিরা পন্য ওঠানামা, রসদ সংগ্রহ এবং অন্যান্য নানা কারণে নানা বন্দর সন্নিহিত এলাকায় উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপনিবেশ ছিল লোথালে। এখানে বাঙালি কারিগরদের অলঙ্কার ও রত্নবস্তুর কারখানাও ছিল। লোথাল বন্দরটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট। এখান থেকে ডানদিকে এবং নদীপথে উত্তর দিকে এগোলেই পাওয়া যেত মহেঞ্জোদারো যাওয়ার পথ। সংবাদসূত্রে জানা গেছে যে এখানে কেন্দ্রীয় সরকার একটি ভারতের প্রাচীন বাণিজ্য ও নৌবিদ্যা সম্পর্কিত মিউজিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা করেছেন। সরকারী পুরাতত্ত্ব বিভাগ সূত্রেও জানানো হয়েছে যে এখানে দেড়-দুহাজার খৃস্টপূর্বাব্দের একটি ব্যস্ত বন্দর এবং জনপদের অবস্থানের কথা প্রমাণ হয়েছে। এই তথ্য থেকেও গঙ্গারিডির বাঙ্গালীদের লোথালে বন্দর ব্যবহারের সমর্থন পাওয়া যায়। কারণ এটা ঠিক যে সেই দেড় হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে অন্য কোনো ভারতীয় জাতির সমুদ্র বিজয়ের কথা আমাদের ইতিহাসে কোথাও নেই। তাই এই সমস্ত তথ্যাদি যাচাই-এর নিরিখে এটা দ্বিধাহীন ভাবেই অনুমেয় যে গঙ্গারিডির বাঙালিরা আর্য অভিযানের আগেই স্বদেশে তো বটেই, এমনকি বিদেশেও সফলভাবে তাদের সুষমাময় শিল্পবস্তু আর পণ্যসামগ্রী ধারাবাহিকভাবে সরবরাহ করতো।

বাণিজ্যের দুই দিক। একটি প্রোডাকশন আর অন্যটি হোল ট্রেডিং বা অপরের জিনিষ বিক্রি করা। বাঙালি সব অর্থেই সওদাগর ছিলেন। গঙ্গারিডির নিজস্ব উৎপাদনগুলি তামা, অন্যান্য ধাতব দ্রব্যাদি, মশলা, রেশম, গুড়, শিল্পদ্রব্যাদি, শৌখিন খেলনা, ভেষজ দ্রব্য, মশলার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সমুদ্রতটবর্তী বন্দরগুলি থেকে শ্যামদেশ, ব্রহ্মদেশ, সুদূর মালয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ গুলিতেও কিছু সামগ্রি সঙ্গে নিয়ে যেত সরবরাহের জন্য। নানা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যগুলিকে সমন্বয় করে জানা যায়- প্রাচীনকালে জলপথে ও স্থলপথে বঙ্গদেশের বণিকরা বিদেশে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর যে আদানপ্রদান চালাত তার একাধিক প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ  মিলেছে। তাম্রলিপ্ত থেকেই পাওয়া গেছে রোমান দেবতা জানুসের মূর্তি। সিংভূমে পাওয়া গেছে রোমান সুবর্ণ মুদ্রার এক মজুত ভাণ্ডার। ঐতিহাসিকরা মনে করেন গঙ্গারিডির বিখ্যাত গঙ্গে বন্দরটি ছিল এখনকার চন্দ্রকেতুগড়ে। এই গঙ্গে সহ তাম্রলিপ্ত, কৌশাম্বী ও মথুরা ছিল রোমের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রধান পথ। আর আগেই বলা হয়েছে যে এই বাণিজ্য পথটি শুধু পশ্চিমে নয়, পূর্বদিকের দেশগুলির সঙ্গেও যুক্ত ছিল। নিয়মিত সরবরাহ  করা হতো পোড়ামাটির মৃৎপাত্র, নানান ধাতব তার ইত্যাদি। গ্রিকরা পূর্বদেশের সরবরাহকৃত উৎকৃষ্ট সুরা, মধু, মাছ, বাদাম, ফল, জলপাই তেল ইত্যাদি সংরক্ষণ করতো উচ্চগলা যুক্ত একধরনের জালা ( আম্ফোরা)-তে। এগুলির বিস্তর চাহিদা ছিল। নিত্যব্যবহার্য এসব জিনিস ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের মূল্যবান রত্নরাজি, রেশম আর কার্পাস ও নিয়মিত যোগান দেওয়া হতো। শুধু রপ্তানি নয়, আমদানিও করা হতো নিয়মিত পশ্চিম দেশগুলি থেকে। সকলেরই জানা যে ভারতে ঘোড়া পাওয়া যেত না। মধ্য এশিয়া থেকে বিপুল সংখ্যার যুদ্ধোপযোগী অশ্ব প্রাচীন ভারতবর্ষে আমদানি করা হতো। ইবনবতুতার মন্তব্য অনুসারে জানা যায় যে সেই যুগে বাংলা থেকে নৌবাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে চাল বা খাদ্যশস্য মালদ্বীপে নিয়মিত সরবরাহ করা হত। রপ্তানি হতো আখ বা ইক্ষু। তৎকালীন রোমের বিত্তবান বা অভিজাত শ্রেণীর কাছে বিপুল চাহিদা ছিল তেজপাতা আর সুগন্ধি তেলের। যার প্রমাণ মেলে গ্রীক ভাষায় লিখিত ‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থে। বাঙলার উৎপাদিত পণ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ‘মসলিন’ কাপড়। পান এবং গুয়া বা সুপারির চাহিদাও বড় একটা কম ছিল না। তাছাড়া নারিকেল, লবন, গন্ডারের খড়্গ ও অন্যান্য বনজ সম্পদও রপ্তানি করা হতো।

সেকালের মূল্যনির্ণয় বা দাম নির্ধারণের পদ্ধতি

সেকালে এই বিপুল পণ্য সম্পদ কেনাবেচাতে মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমটি কেমন ছিল? ভিন্ন রাষ্ট্রের দেশগুলির মধ্যে মূল্য বিষয়ে সমসিদ্ধান্তে আসার যুক্তিগুলোই বা কী? সেটা জানা গেলেই বোঝা যাবে প্রাচীনকালে বাঙালীর ব্যবসা বাণিজ্যে উন্নতির পরিমাণটি। প্রাথমিকভাবে বোঝা যায় নানা সময়কালে প্রচলিত নানাবিধ মুদ্রাগুলিকে বিচার করলে। গ্রীক ঐতিহাসিকগণ যে গঙ্গারিডির কথা বলেছেন সেটি দৃশ্যত গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চল থেকে উত্তরে ছোটনাগপুরের মালভূমি অবধি বিস্তৃত হলেও বৃহৎবঙ্গ কিন্তু আড়ে-বহরে আরও বড় ছিল। রাঢ় ছাড়াও পুণ্ড্র, পুণ্ড্রবর্ধন, সমতত, হরিকেল, বরেন্দ্র- এগুলিও বঙ্গভূমির ক্ষেত্রসীমার মধ্যেই ছিল। যার মধ্যে একমাত্র গঙ্গারিডাইরা প্রচণ্ড পরিশ্রমী হওয়ার কারণে, অরণ্য টিলা অধ্যুষিত প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার কারণে, যুদ্ধ, নৌ-নির্মাণ ও নৌ-চালনায় ব্যুৎপত্তি থাকার কারণে বিশ/ তিরিশ হাজার নটিক্যাল মাইল দূরবর্তী যবন দেশগুলিতে পালতোলা জাহাজে পাড়ি দেওয়ার দুঃসাহস দেখানোর মতোই বেপরোয়া ছিল। আগেই বলেছি নিজেদের মধ্যে তো বটেই, সামাজিক বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কারণে এবং মূলত প্রশাসনিক নিরাপত্তার কারণেই এই সমস্ত অঞ্চল ও প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে সংকেত চিহ্ন বিনিময়ের মাধ্যমে একটা নিরবচ্ছিন্ন বোঝাপড়ার ‘সিন্ডিকেট রাজ’ প্রতিষ্ঠিত ছিল। যার ফলে গঙ্গারিডির মুদ্রা শুধু প্রতিবেশী নয়, বিদেশের বিপণনেও সমভাবে গ্রাহ্য হতো। গুপ্তযুগে বাংলা যখন গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ছিল তখন বাঙলায় সুবর্ণ মুদ্রার আধিক্য দেখা যায়। এছাড়া রূপো আর তামার মুদ্রা-তো ছিলই। গুপ্তকালে স্বর্ণমুদ্রা ও রৌপ্যমুদ্রার মুল্যের অনুপাত ছিল ১ঃ১৬। সেকালেও মুদ্রাস্ফীতি ছিল। যা পরবর্তীকালে নেমে এসে দাঁড়ায় একটি স্বর্ণমুদ্রার মান আটটি রৌপ্যমুদ্রার সমান। কপর্দক বা কড়িই ছিল সেকালে পণ্য লেনদেনের একমাত্র সাধারণ মানুষের মাধ্যম। একটি সোনার মোহরের বিনিময়ে মিলতো ২০ হাজার ৪৮০ টি কড়ি। কড়ি নকল করা অসম্ভব বলে রাজার বদল হলেও কড়ির ব্যবহার ও মূল্যমান অপরিবর্তিত থাকতো। এই সমস্ত কড়ি সংগ্রহ করা হতো স্থানীয় সমুদ্র উপকূলবর্তী সমাজ থেকেই। পালযুগে রৌপ্যমুদ্রাকে দ্রম্য বলা হতো। এই দ্রম্যই কথ্য ভাষায় ‘দাম’ হয়েছে। চলতো বিনিময় প্রথা। গুণমান ও ইউনিট পিছু মূল্য অনুমান করে রপ্তানি করা দেশের পণ্যের সঙ্গে সরবরাহকৃত পণ্যের বিনিময় চলতো। মূল পণ্য সরবরাহের প্রক্রিয়াটি জলপথে হতো। সেকালের বাণিজ্যযানগুলি যে আসলে তিন/চার তলা পালতোলা বিশাল আকারের জাহাজ ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গভীর সমুদ্রে হালকা জাহাজ ঢেউয়ের দোলায় বিপদগ্রস্ত হতে পারে বলে বণিকরা দেশী পণ্যের সম্ভার বন্দরে খালি করে, বিদেশী পণ্যসামগ্রী ফিরতি যাত্রা পথে জাহাজের খোলে ভর্তি করতেন। এভাবেও কিছু বিনিময় চলতো। প্রাচীন দলিল দস্তাবেজ থেকে জানা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলদস্যু, রোগ মহামারী  ইত্যাদি কারনে বণিকরা ক্ষতিগ্রস্থ হলে রাষ্ট্রের পক্ষে ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য এবং অন্যান্য নিরাপত্তা পরিষেবা প্রদানের জন্য মাসুল ধার্য করার নিয়মিত প্রথা ছিল। অর্থাৎ প্রাচীন বঙ্গে শিল্পী, কারিগর, বণিকদের জন্য যে একধরনের বীমা অথবা ইন্সিওরেন্স প্রচলন ছিল, সেটা বলা যায়। অর্থাৎ সেকালের নিরিখে বাঙালীর বাণিজ্য ব্যবস্থা যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ছিল।

চারুশিল্পে ও কারুশিল্পে প্রাচীন বাঙালীরা।

আগেই বলেছি প্রাচীন বঙ্গদেশ প্রাগার্যযুগে শিল্প সংস্কৃতি, লোকনাট্য আর নানাবিধ চারুকারু নির্মাণ কৌশলে অত্যন্ত দক্ষ আর পটু ছিল। গ্রামসভাগুলির প্রশাসনিক ব্যবস্থাটাই ছিল স্বয়ং সম্পূর্ণ। চাষবাস, শস্যসংরক্ষন, কামার- কুমোর- সূত্রধার- কারিগরিবিদ আর আঞ্চলিক বিনোদনে তাদের যাপনটি বেশ সুশৃঙ্খল ছিল। অনেক সময় এক গ্রামসভার আচার্যরা, অন্য অঞ্চলে আমন্ত্রিত হতেন অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য। ডঃ দীনেশ্চন্দ্র সেনের ‘বৃহৎবঙ্গ’ সূত্রে জানতে পারি প্রাচীন বাঙলার নট আর মস্করীরা নানাবিধ কারুশিল্প আর পোতলাবাজিতে এতটাই দক্ষ ছিল যে খৃস্টপূর্ব যুগ থেকে ইউরোপের নবজাগরণ সময়সীমা অবধি এই বঙ্গীয় শিল্পী ও কারিগরদের শ্যাম, মালয়, কম্বোজ, সিঙ্ঘল এমনকি মিশর ও গ্রীসের স্থাপত্যকর্ম, চিত্রকর্ম, লোকনাট্য এবং পোতলাবাজিতে বিস্তর নামডাক ছিল। তারা প্রায়শই সপ্তগ্রাম, গঙ্গে, তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে বাণিজ্যের জন্য যাত্রা করা পোতগুলিতে জায়গা করে নিতেন। আধুনিক শিল্প গবেষকগণ মনে করেন সারা পৃথিবীর প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের পরবর্তীকালের নন্দনকর্মগুলিতে, বিশেষ করে চিত্র-স্থাপত্য- মঞ্চকর্ম- পুতুলনাট্য কলায় গঙ্গারিডির বাঙ্গালীদের প্রত্যক্ষ অবদান আছে।

একটা কথা মাথায় রাখা দরকার যে গঙ্গারিডি ও গ্রীক রোমান সভ্যতাগুলি কমবেশি প্রায় সমকালীন। আর এর প্রত্যেকটিতে গঙ্গারিডির বাঙ্গালীদের সুদক্ষ বাণিজ্যিক এবং নান্দনিক ও তাত্ত্বিক সাফল্যের স্বাক্ষর আছে। অতঃপর কিছু কৌতূহল উদ্দীপক প্রশ্নের উত্থাপন করে এবং এই বিষয়ে আরও বিস্তৃত  গবেষণার দাবী জানিয়ে এই নিবন্ধের ইতি টানবো। একথা ঠিক যে নৌপথে ইউরোপে হাজির হওয়ার অনেক আগেই গঙ্গারিডির নাবিকেরা ও বণিকেরা সুমের দেশ বা মিশরে পৌঁছেছিল। শুধু পৌছনোই নয় সেই দেশের শিল্প আর বাণিজ্যে তারা বেশ কিছুটা সামাজিক নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিল। এই প্রসঙ্গে বলা দরকার শুধু শিল্প-বাণিজ্যই নয়, বাঙালি নাবিক ও বণিকদের সঙ্গে সেই সকল দেশগুলিতে আরও অনেক কিছু মূল্যবান সম্পদ বহন করেছিল। যার সঙ্গে হয়তো সরাসরি শিল্প বা বাণিজ্যের সাথে কোন সম্পর্কই নেই। এর মধ্যে একটি গণিতের বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের অন্যটি ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কিত। আধুনিক গণিতবিদরা বলেন, প্রাচীন গণিতে প্রথমে ‘শূন্য’ ধারণার অস্তিত্ব ছিল না। শূন্যের ধারণা ভারত থেকেই বিশ্বে, অন্যত্র প্রসারিত হয়। আর ভারতে তখন গঙ্গারিডির বাঙালিরাই বহির্জগতের সাথে সবথেকে বেশি সংযুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ কেবলমাত্র শিল্প বাণিজ্যই নয়, গণিত ও বিজ্ঞান ভাবনাতেও যে  বাঙালীরা সেকালে যারপরনাই অগ্রণী ছিল, সেটা প্রমাণিত।

পরের বিষয়টি হোল ধর্মবোধ সম্পর্কিত বা সমাজে নারীর প্রতি মর্যাদা দানের। গঙ্গারিডির বঙ্গবাসীরা ছিলেন মাতৃকা উপাসক। সারা পৃথিবীতে নারীকে সম্মান দানের বিষয়ে বাঙালীরা যে অগ্রগণ্য ছিল, সেটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। মিশরে পিরামিড নির্মাণে, তার প্রযুক্তিতে, পিরামিডের অভ্যন্তরের চিত্রবিচিত্র নকশা, ফুলকারি আর মমির বহিরঙ্গ চিত্রণে বাঙালি শিল্পী কারিগরদের অবদান বড় কম ছিলোনা। বাঙলার অনার্য লেখচিত্র শৈলী আর পিরামিডের মধ্যেকার চিত্রগুলি একটু অনুধাবন করলেই বোঝা যায় যে সসেকালেরপ্রাচীন সভ্যতাগুলিতে আমাদের লেখচিত্রন শৈলী কিভাবে ঢুকে পড়েছে। আজও বাঙলার বহু জেলায় মিশরীয় পদবীর লোকজন বিদ্যমান। রাঢ়বঙ্গের অন্তর্গত বর্ধমান- বীরভূম সংলগ্ন নতুনগ্রামের কাঠপুতুলের কথা সবারই জানা। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় নতুনগ্রামের সমতল পীঠের দিক থেকে এগিয়ে আসা ( ত্রিভুজের ভঙ্গিতে) কাঠপুতুলের গঠন শৈলী, বর্ণ, অঙ্কনপদ্ধতি ইত্যাদি হুবহু মিশরের মমিদের অনুকরনে করা। এখন মিশরীয়রা বঙ্গজ শিল্পীদের এই নির্মাণপদ্ধতি শিখিয়েছেন, না বঙ্গজ শিল্পীরাই মিশরে গিয়ে সেদেশের মমি নির্মাণে হাত লাগিয়েছেন, সেটা অনুমান করতে খুব একটা কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বোঝাই যায়, সেই কালে সারা পৃথিবীকে স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে, চিত্রাঙ্কনে আর ফলিত বিনোদনে আমোদিত করেছেন যারা, সেই পেশাদারী পটুত্বের কারিগরগণই মিশরীয় মমি নির্মাণের পর, দেশে ফিরে নতুন কিছু করার তাগিদেই এই অভিনব কাঠপুতুলগুলির সৃষ্টি করেছেন। একটি প্রবাদে বলা হয়ঃ শিল্প সততই সচল এবং পরিবর্তনশীল। মিশরের মমি এবং বর্ধমানের কাঠপুতুলকে গবেষকের আতস কাঁচের তলায় আনলে, এই কথারই সত্যতা প্রমাণিত হয়। এর বিপরীত উদাহরণও আছে। মিশরীয় মমি যদি বর্ধমানের কাঠপুতুলের মিনি সংস্করন হয়, তাহলে দক্ষিন ২৪ পরগণার ‘বারা’ মূর্তির শিরস্ত্রাণ অথবা মুকুট অবশ্যই ভ্যাটিকান সিটির পোপের মুকুটকে প্রভাবিত করেছে। খ্রিষ্টান ধর্মগুরু পবিত্র পোপের মাথার ভূষণ হোল একটি বিশেষ আকৃতির টুপি। এই টুপিটিকে একটু খেয়াল করে দেখলে মনে হবে একটি বৃত্ত থেকে কেটে নেওয়া শালপাতার মতো। বিচিত্র বিষয় হোল দক্ষিন ২৪ পরগনা জেলার প্রায় সকল প্রান্তিক মানুষরা তাদের গৃহের বাহিরে ঠিক প্রবেশপথের সামনে একজোড়া নারীপুরুষের কারুমূর্তি রাখেন। এটা একটা প্রথা যা অতি প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা প্রাক আর্য কালীন নিয়ম। এতাদৃশ ‘বোঙাবুঙি’ প্রতিষ্ঠার কথা শোনা যায় শালটিলা জঙ্গলের অধিবাসী আদিবাসীদের যাপন বিশ্বাসের মধ্যে। আদিবাসীদের কাছে ‘বোঙা’ শব্দের অর্থ পবিত্র। অনেক গবেষক মনে করেন বোঙা থেকেই ‘ বঙ্গ’ নামের উৎপত্তি। সে যাই হোক আদিবাসীদের বোঙা, দক্ষিন বঙ্গের বারা আর সুদূর রোমে খ্রিষ্টানদের শীর্ষপুরুষ পোপের টুপির আকৃতি সমান হয় কোন যুক্তিতে? বঙ্গের শিল্পী কলাকর্মীরা প্রাচীন রোমের শিল্পকর্মে স্থাপত্যে ভাস্কর্যের নিয়ন্ত্রক হয়েছিল। পরবর্তীতে খ্রিষ্টের জন্ম এবং তারও পরে পোপের ধর্মীয় আবির্ভাব। এক্ষেত্রে পবিত্র পোপের টুপির ডিজাইনটি কি পবিত্র বোঙা বা বারা মূর্তির কথা ভেবে নির্মিত হয়েছিল? এর উত্তর নিশ্চয় একদিন পাওয়া যাবে। তবে গঙ্গারিডির বাঙালি শিল্পী কারিগরদের নিজস্ব মোটিফগুলি, তাদের পদ্ম, লতাপাতা, লৌকিক ব্রত- আলপনার নিজস্ব নকশাগুলি আজও গ্রীক, ইতালি, রোম এবং মিশরের পিরামিডের প্রকোষ্ঠগুলিতে  মন দিয়ে খুঁজলে পাওয়া যাবে। পরিশেষে ছন্দের যাদুকর কবি সত্যেন দত্ত অনুসরণে বলি-

‘বাঙালীর ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়

সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্যের পরিচয়।

স্থপতি মোদের স্থাপনা করেছে ‘বরবুদরের’ ভিত্তি

শ্যাম কম্বোজে ওঙ্কার ধাম মোদেরি প্রাচীন কীর্তি।

ধেয়ানের ধনে মূর্তি গড়েছে আমাদের ভাস্কর

বীতপাল আর ধীমান যাদের নাম অবিনশ্বর।

আমাদেরই কোন সুপটু পটুয়া লীলায়িত তুলিকায়

আমাদের পট অক্ষয় করে রেখেছে অজন্তায়!

 

 

তথ্য ঋণ-

অনার্য গরিমা, প্রশান্ত প্রামাণিক, জ্ঞানবিচিত্রা

বাঙালীর সংস্কৃতি , ডঃ অতুল সুর

প্রাগৈতিহাসিক বাংলা, পরেশ্চন্দ্র দাসগুপ্ত,অনিমা প্রকাশনী

বঙ্গদেশের পুতুল নাট্যকলা, রুটস, ডঃ শুভ জোয়ারদার

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, রাধাগোবিন্দ বসাক।

shoptodina.com
shoptodina.comhttps://shoptodina.com
সপ্তডিঙা। কথাটা শুনলেই মনে আসে বাঙালির সমুদ্রবাণিজ্যের এক গৌরবময় ইতিহাস। গৌড়ের বণিকরা সাতটি বিশাল নৌকার এই সমবায় নিয়ে সিংহল, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, চীন, রোম, গ্রীস, ক্রীট, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করে ফিরে আসতেন স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার নিয়ে। সপ্তডিঙা তাই বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির অভিজ্ঞান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Advertisingspot_img

Popular posts

My favorites