Thursday, December 19, 2024
Homeবাঙালির ইতিহাসগঙ্গারিডাই সপ্তমিথ

গঙ্গারিডাই সপ্তমিথ

এই লেখায় গঙ্গারিডাই নিয়ে বহুল প্রচলিত সাতখানা ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করব।

প্রথম মিথ

নামটা আসলে গঙ্গাহৃদি/গঙ্গাঋদ্ধি (গঙ্গারাষ্ট্র বা গঙ্গারাঢ়ও হতে পারে), এটাকে ইংরেজ/পর্টুগিজ/গ্রীক-ল্যাটিন সোর্সে বিকৃত উচ্চারণে গঙ্গারিডাই বলে।

প্রথমত, গঙ্গারিডাইদের সঙ্গে মধ্যযুগের কোনও সম্পর্ক নেই। পর্টুগিজ ও ইংরেজ আগমনের বহু আগেকার কথা। ঠিক করে বলতে গেলে খ্রিষ্টপূর্ব যুগে, আলেকজান্ডারের ভারত আগমনের আগেই গঙ্গারিডাই জাতির প্রবল উত্থান ঘটে গেছে। অন্তত চব্বিশশো বছর আগেকার কথা হচ্ছে।

গ্রীক লেখায় Gangaridai , Gangaridae হল ল্যাটিন। ইংরেজ আমলের শিক্ষিত বাঙালি মাত্রেই জানতেন যে গঙ্গার মোহনার কাছাকাছি গঙ্গারিডাই নামক এক প্রবল পরাক্রান্ত জাতির কথা বারবার বলে গেছেন গ্রীক ও রোমান লেখকরা। যেহেতু ভারতীয় কোনও উৎসে কিছু বলা নেই, কাজেই এ শব্দের বঙ্গীয়করণ কিভাবে হবে, সে নিয়ে প্রথম পথনির্দেশ করেন বঙ্কিম। তিনি তাঁর একটা প্রবন্ধে গঙ্গারাষ্ট্র নামটা ব্যবহার করেছেন। বিংশ শতকে সত্যেন দত্ত ছড়ার জাদুকর ছিলেন, তিনি গঙ্গাহৃদি লিখেছিলেন তাঁর একটা সুখপাঠ্য কবিতায়। গঙ্গাঋদ্ধি আরও পরের শব্দ, প্রথম কে কয়েন করেন জানি না, তবে ঋদ্ধি/ঋদ্ধ কথাটা আশি নব্বই দশক থেকে বাঙালির মধ্যে বহুল প্রচলন হয়েছে, তার আগে ছিল না, অনুমান করি এই সময়েই গঙ্গাঋদ্ধি। এই সময়েই বাংলাদেশ থেকে একটা বই বেরিয়েছে, গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ, মোঃ হাবিবুর রহমান লিখেছেন। বাংলা উইকিপেডিয়ায় গঙ্গাঋদ্ধি নামেই প্রবন্ধ আছে দেখছি যেটা গঙ্গারিডাই বিষয়ক। এছাড়া বঙ্কিম গঙ্গারাষ্ট্র থেকে গঙ্গারাঢ় অনুমান করেছেন।

আমার জানা মতে, প্রথম এই কথা ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন, এবং তারপরে ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতি চট্টোপাধ্যায় এর প্রতিধ্বনি করেন, যে গ্রীক আর ল্যাটিন না জানা থাকায় এই জাতির ভারতীয় নামটা কি ছিল, সেটা অনুমানে নানা বিভ্রান্তি ঘটছে। নামটা গঙ্গাহৃদি গঙ্গাঋদ্ধি গঙ্গারাষ্ট্র গঙ্গারাঢ় – এসব হতেই পারে না। কারণ কি?

কারণ গ্রীক ভাষায় গঙ্গারিডাই একটা বহুবচন শব্দ, সেটাই ল্যাটিন ভাষায় গঙ্গারিডি, এবং এটা গঙ্গারিড শব্দের বহুবচন। গঙ্গারিড হল একবচন। গঙ্গারিড মানে কি? গঙ্গারিড হচ্ছে গঙ্গার জাতীয় ব্যক্তি। গঙ্গার জাতীয় ব্যক্তি=গঙ্গারিড (Gangarid)। গঙ্গার জাতীয় ব্যক্তিগণ=গঙ্গারিডাই (Gangaridai)।

ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন যে পশ্চিম পাঞ্জাবে যখন আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী এসে উপস্থিত হয়, তখন তারা পূর্ব ভারতে গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত এই প্রবল পরাক্রান্ত জাতির নামটা ঠিক এভাবেই শুনেছিল।

গঙ্গার।

প্রসঙ্গত, জাতির নামে এভাবে বহুবচন ব্যবহার করার ঐতিহ্য সংস্কৃত ও দ্রাবিড় ভাষাগুলোতেও আছে। বঙ্গাঃ, পুণ্ড্রাঃ – বেশিরভাগ সময় এইভাবেই এই জাতিগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বহুবচন বোঝাতে সংস্কৃতে এই যে -আঃ যুক্ত হচ্ছে, এই জিনিসটাই দ্রাবিড ভাষায় হয়ে যায় -আর। ডি এম কে দলের পুরো নাম, দ্রাবিডার মুন্নেত্রা কাজাগম। দ্রাবিডার মানে দ্রাবিড়ের বহুবচন, দ্রাবিড় জাতীয় ব্যক্তিগণ।

এই দ্রাবিড় ভাষার -আর খুব সম্ভবত বাংলায় হয়ে যায় -আল, এবং সেক্ষেত্রে জাতির নাম ছিল গঙ্গাল। পরবর্তী কালে বঙ্গাল নামের উত্থান থেকেও বোঝা যায় যে এই ব্যুৎপত্তি সম্ভবপর। আবুল ফজল একটা কথা বলেছিলেন যে আল কাটা হত, তাই বঙ্গ যুক্ত আল, কিন্তু সেটার কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। কিন্তু বহুবচনে জাতির নাম দেওয়ার প্রথা পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে প্রাচীনকাল থেকেই।

যাঁরা গঙ্গাঋদ্ধি গঙ্গাহৃদি ইত্যাদি করেছেন, তারা ভাষাতত্ত্ব জানেন না, এবং গ্রীক/ল্যাটিন ভাষায় গঙ্গারিডাই/গঙ্গারিডি যে মৌলিক শব্দ নয়, বহুবচন মাত্র, এবং মূল শব্দটি গঙ্গার, সেটাও জানেন না। গঙ্গারিডাই মানে গঙ্গার জাতীয় ব্যক্তিগণ, সেটা গঙ্গাঋদ্ধি/গঙ্গাহৃদি সমর্থকরা আজও জানেন না। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত আর সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা না জানাটা দোষের নয়, বিশেষত যখন বাঙালির ইতিহাস জানানোর কোনও প্রয়াস বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেই, বা সরকারি স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও তাপোত্তাপ নেই। কিন্তু এই বিষয়ে যাঁরা লেখালেখি করছেন, তাঁরা নিজেরা যদি না জানেন, তবে নিজেদের বিভ্রান্তি আরও অনেকের মধ্যে এঁরা ছড়িয়ে দেবেন। সেটাই হয়েছে বিপদ। একে তো ইতিহাসবিস্মৃত জাতি, তার ওপরে এইসব বিভ্রান্তি।

আরও বিপদ এই যে গঙ্গারিডাই সম্পর্কে কিছুই জানায় না কোনও ভারতীয় সোর্স। সম্পূর্ণ সেন্সর্ড। কোনও শাস্ত্র বেদ পুরাণ স্মৃতি – কোথাও কিচ্ছু পাবেন না। আপনাকে জানতে হবে গ্রীক ও ল্যাটিন সোর্স থেকে, এবং জানতে হবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে। কিন্তু সমস্যা হল উৎখনন ঠিকভাবে হয়নি, এবং প্রচুর প্রত্নদ্রব্য বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সরকারি উদাসীনতা, বাঙালির বিশ্বমানবিক ইতিহাসবিস্মৃতি, ইতিহাস-বিকৃতি – এগুলো সমস্যার আরেক দিক। গবেষণা খুব কম, ভেস্টেড ইন্টারেস্ট প্রচুর।

দ্বিতীয় মিথ

মাথার খোঁপায় দশটি কাঁটার বদলে দশটি আয়ুধ – এই মর্মে যে মূর্তিটি উত্তরে বাণগড়, মধ্যে মঙ্গলকোট, পশ্চিমে তাম্রলিপ্ত ও পূর্বে চন্দ্রকেতুগড় মিলিয়ে সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে পাওয়া গেছে, ওটি পঞ্চচূড়া অপ্সরা বা যক্ষী। বাঙালি জাতির উপাস্য মাতৃকামূর্তি নয়।

ভুল। এই মূর্তিটির নানা ছবি এর আগে দিয়েছি। ইনি ছাড়াও অন্য মাতৃকা মূর্তি পাওয়া গেছে চন্দ্রকেতুগড়ে, সে ছবিও দিয়েছি। এই মূর্তির নাম কি ছিল জানা যায় না, আগেই বলেছি গঙ্গারিডাই সম্পর্কে ভারতীয় সোর্স নীরব। কিছু ইতিহাসবিদ সমুদ্র মন্থনে উঠে আসা একজন অপ্সরা, নাম পঞ্চচূড়া, সেই নামেই নামাঙ্কিত করতে চেয়েছেন এই মূর্তিকে। কেন পঞ্চচূড়া হবে, বোঝা যায় না। পাঁচটা তো নয়, মোট দশটা আয়ুধ আছে। কখনও কখনও দ্বাদশ আয়ুধও দেখছি, দুদিকে ছটা করে। তাছাড়া এই মূর্তির সঙ্গে চারজন সহচর, মাথার দুধারে চুলের কাঁটার বদলে দশটা আয়ুধ, মূর্তির অপরূপ ঐশ্বর্য (ঈশ্বরের ভাব অর্থে) এগুলো দেখে যে বাঙালির মনে হবে ইনি নেহাতই একজন যক্ষী, তাঁর ইতিহাসজ্ঞান ছেড়ে দিলাম, তাঁর বাঙালি হওয়াটাই আশ্চর্য, জন্মের গোড়ায় কোনও বৃহৎ গলদ আছে। বস্তুত কেউ বিশ্বমানব কিনা, সেটার পরীক্ষায় এ প্রশ্নটা স্বচ্ছন্দে রাখা যায়। ওই মূর্তি দেখে অপ্সরা মনে হচ্ছে? যক্ষী মনে হচ্ছে? কনগ্র্যাটস, আপনি প্রকৃত বিশ্বমানব।

আপনি ডাইমেনশন দেখুন। লার্জার দ্যান লাইফ। আপনি দেখুন তিনি একক মাতৃকা হয়ে বিরাজ করছেন, বাকিরা ক্ষুদ্র ও সন্তানতুল্য। আপনি দেখুন যে পাণ্ডু রাজার ঢিবি থেকে আজ পর্যন্ত চার সহস্র বছর ধরে বাঙালি মাতৃকা উপাসক। আপনি দেখুন সেই প্রাচীন খ্রিষ্টপূর্ব কালে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে এঁর মূর্তি। মাতৃকা উপাসনা-কল্পনা দিয়েই বাঙালির কাল্পনিক সম্প্রদায় (বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন) বা বৃহৎ সম্প্রদায় (ইউভাল হারারি) গড়ে উঠেছিল সেই প্রাচীন যুগে আমি অনেকবার বলেছি, সেটাও যদি প্রাণে ধরে একটু স্মরণ করেন। এবার তারপরও যদি আপনার মনে হয় ইনি বৈদিক-পৌরাণিক আর্যদের রাজসভায় নৃত্য করবেন বলে অপ্সরারূপে সমুদ্র মন্থনে উঠে এসেছেন, অথবা ধনসম্পত্তি যক্ষের ধনের মত আগলাবেন বলেই এঁর আবির্ভাব, তবে আপনি অবশ্যই বিশ্বমানব বা মাছিমারা কেরানি, সম্ভবত দুটোই (কার্টসি তিতাস দিন্দা)। আবারও অভিনন্দন জানাই।

তৃতীয় মিথ

গঙ্গারিডাই একটি অবাঙালি জাতি ছিল, মগধে এর কেন্দ্র।

না, মগধে ছিল প্রাচ্য বা Prasii এর কেন্দ্র। গঙ্গারিডাই বিভিন্ন সময়ে মগধ জয় করেছে, Curtius এর বক্তব্য দেখলে অনুমান করা যায়, মহাপদ্মনন্দ গঙ্গারিডাই জাতীয় ছিলেন, মগধ জয় করে নন্দসাম্রাজ্য স্থাপন করেন। পরে গঙ্গারিডাই ও কলিঙ্গ একত্রিত হয়েছিল, এরকম উল্লেখও পাওয়া যায়, প্লিনি দ্য এল্ডার দ্রষ্টব্য। সেক্ষেত্রে অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধ সম্ভবত গঙ্গারিডাই জাতির সঙ্গেই হয়েছিল।
কিন্তু গঙ্গারিডাই জাতির রাজধানী ছিল গঙ্গে। সেটা আজকের দেগঙ্গার চন্দ্রকেতুগড় অঞ্চলে ছিল বলেই মনে করা হয়। গ্রীক ল্যাটিন সমস্ত বর্ণনাতেই দেখি গঙ্গার মোহনার কাছে এই জাতি। মগধ হওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। তবে বাঙালি যুগে যুগে বৃহৎ বঙ্গে উপনিবেশ স্থাপন করেছে, শশাঙ্ক পাল সেন সমস্ত যুগেই মগধ ও কলিঙ্গ আমাদের উপনিবেশ।

চতুর্থ মিথ

চতুর্থ মিথটা ঠিক মিথ নয়, এটা একটা সেন্সরশিপ। একশ্রেণীর ইতিহাস বইতে বা ইতিহাস আলোচনার শিবিরে গঙ্গারিডাই নামটাকেই সম্পূর্ণ সেন্সর করে চন্দ্রকেতুগড় থেকে প্রাপ্ত সমস্ত প্রত্ন নিদর্শনকে শুঙ্গ বলে চালানো হয়। এককালে গঙ্গারিডাইকে এদেরই বৈদিক-ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক-পৌরাণিক পূর্বপুরুষরা ভারতীয় শাস্ত্র ও স্মৃতিতে সম্পূর্ণ সেন্সর করেছিলেন। সুযোগ্য উত্তরপুরুষের মত এরা আজ সেই কুকর্মের যথাযথ উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন। চন্দ্রকেতুগড় প্রত্নখনন প্রমাণ করে যে সেটা নন্দযুগ থেকে, এবং তারও আগে থেকে আছে। আর যেগুলোকে হোলসেল শুঙ্গ বলে চালানো হয় সেগুলোর সিংহভাগই শুঙ্গযুগের আগে বা পরে।

চন্দ্রকেতুগড় মানে গঙ্গারিডাই। এই প্রত্নঅঞ্চলকে রাখালদাস প্রথম আবিষ্কার করেন। রমেশচন্দ্র গঙ্গারিডাই নিয়ে লিখে গেছেন। ইতিহাসবিদ মহলে সুপরিচিত যে এটিই গঙ্গারিডাই। কিন্তু একশ্রেণীর বিশ্বমানব ও একশ্রেণী হিন্দুত্ববাদীর অবৈধ অশুভ আঁতাত আজ গঙ্গারিডাই নামটা সম্পূর্ণ মুছে দিয়ে চন্দ্রকেতুগড় মানেই শুঙ্গ বলে চালাতে চাইছে। শুঙ্গযুগের শাসন-পট্টোলী কি কি আবিষ্কৃত হল চন্দ্রকেতুগড়ে, বলুন তো? একটাও না। তীব্র ব্রাহ্মণ্যবাদী-পুরুষতান্ত্রিক-বৈদিক-পৌরাণিক শুঙ্গযুগের শাসনের কি কি প্রমাণ পাওয়া গেল বলুন তো আজ পর্যন্ত চন্দ্রকেতুগড়ে? কিচ্ছু পাওয়া যায়নি।

এবার আমি উত্তরপ্রদেশে গিয়ে ৫৯৩ থেকে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত যত প্রত্ননিদর্শন পাওয়া গেছে, সেগুলোকে সব শশাঙ্কযুগ বলে চালাতে পারব তো? দেবেন তো আপনারা, যারা ইতিহাসের নামে ভণ্ডামির বেসাতি খুলে বসেছেন?

পঞ্চম মিথ

গ্রীক-ল্যাটিন গঙ্গারিডাই-এর সঙ্গে চন্দ্রকেতুগড় সহ অন্যান্য প্রত্নস্থানের প্রত্ননিদর্শনের কোনও সরাসরি সংযোগের পাথুরে প্রমাণ নেই। পুরোটাই অনুমান।

এটা ঠিক মিথ নয়, তারও বাড়া। এটা হল ভাবের ঘরে চুরি। তবে এই পুকুরচুরি বিশ্বমানবদেরই উপযুক্ত কর্ম। যে সময় আলেকজাণ্ডারের সমসাময়িক গ্রীক লেখকরা বলছেন এই প্রবল পরাক্রান্ত জাতির কথা, আর তাদের অসামান্য সামরিক শক্তির কথা, যে জায়গায় এই জাতির অবস্থিতি নির্দেশ করছেন, চন্দ্রকেতুগড় ঠিক সেই সময়কালে এবং সেই স্থানাঙ্কে। রোমান ইতিহাসবিদ Quintus Curtius Rufus বলছেন গঙ্গারিডাই সেনাবাহিনীতে ৩০০০ হাতি ছিল, ২০০০০ অশ্ব ছিল, ২০০০০০ পদাতিক আর দুহাজার অশ্বচালিত রথ। এর মধ্যে হস্তিবাহিনীই সবথেকে ভীতিজনক ছিল। ভার্জিল বলছেন যে তিনি নিরেট সোনা আর হাতির দাঁতে গঙ্গারিডাই জাতির বীরত্বের কথা লিখে রাখবেন। অসংখ্য গ্রীক ও রোমান সোর্স থেকে জানা যাচ্ছে গঙ্গারিডাই নামে গঙ্গার মোহনা-অঞ্চলে বসবাসকারী এই জাতির কথা। তাদের সঙ্গে নিয়মিত গ্রীক ও রোমান জগতের বাণিজ্য হচ্ছে, সাংস্কৃতিক বিনিময় হচ্ছে।

যে সময়টার কথা, সেই সময়নির্ণয়ে গঙ্গার মোহনার কাছে আপনি চন্দ্রকেতুগড় থেকে এই অবিশ্বাস্য প্রত্ননিদর্শনগুলো পাচ্ছেন, অনুরূপ নিদর্শন তিলপি থেকে পাওয়া যাচ্ছে (দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা), তাম্রলিপ্ত থেকে পাচ্ছি (মেদিনীপুর)। আর উত্তরে বর্ধমানের মঙ্গলকোট এবং দিনাজপুরে বাণগড়।

পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে সেই সুপ্রাচীনকালে একটি মহাজাতির উত্থান ঘটছিল, বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে কারও? জেগে ঘুমোচ্ছেন? কমপ্রাদরদের অসুবিধা হবে সে তো বুঝতেই পারছি। গোবলয়ের অসুবিধা, আর ইসলামিক বলয়েরও অসুবিধা। সবথেকে বড় অসুবিধা বিশ্বমানবদের। কিন্তু আপনার অসুবিধা হবে বলে তো আমাদের পূর্বমানুষগুলোকে জলে ফেলে দিতে পারব না।

ষষ্ঠ মিথ

এই গঙ্গারিডাইদের অস্তিত্ব যদি বা থাকে, এদের বাঙালি বলা যাবে না। তখন কি বাংলা ভাষা ছিল যে বাঙালি বলছেন?

বাঙালির সংজ্ঞা সাংস্কৃতিক। আজ যে ভাষাকে বাংলা বলি, তাকে এই সেদিনও গৌড়ীয় ভাষা বলেছেন রামমোহন। চৈতন্য নিজেকে বাঙালি বলতেন না। গৌড়ীয় বলতেন। জাতির নাম পাল্টায়, ভাষার নাম বদলায়। একটি জাতির সংজ্ঞায়নে সেই জাতির সংস্কৃতি ও ধর্মকে ধ্রুবকের মত ব্যবহার না করলে চলে না, পৃথিবীর কোথাও চলে না। কেবল ভাষাবাদ দিয়ে কোনও জাতির ধারণা হয় না। বাংলায় এই ভাষাবাদ ঘটেছে, কারণ বাংলাদেশের আওয়ামি প্রবর্তিত বিশেষ ভাষাবাদী বাঙালি ধারণা। সে নিয়ে আলোচনা করার স্থান এটা নয়, বারান্তরে করা যাবে। কিন্তু বাঙালির শেকড়ে আছে প্রকৃতিমাতৃকা উপাসনা। বাঙালি জাতির সংজ্ঞা আমরা প্রকৃতিমাতৃকা উপাসনায় খুঁজে পাই। সেটা গঙ্গারিডাইদের মধ্যে দেখছি, জয়নাগ-শশাঙ্ক-পাল-সেনযুগে দেখছি। সেটা চার সহস্র বছর আগেকার পাণ্ডু রাজার ঢিবিতেও দেখেছি।

বাঙালি একটি মাতৃকা-উপাসক মহাজাতি। পূর্ব ভারতে বঙ্গ পুণ্ড্র সুহ্ম (মহাভারতে তাম্রলিপ্ত ও কর্বট জাতির উল্লেখও পাই) প্রভৃতি অনেকগুলি জাতি একত্রিত হয়ে বাঙালি নামক মহাজাতির উৎপত্তি। এ জিনিস একটি সম্প্রদায়কল্পনা ছাড়া ঘটে না। বাঙালির মাতৃকা উপাসনা, যাকে আদি সাংখ্য ও তন্ত্রে প্রকৃতি বলে, সে আমাদের জাতির সংজ্ঞা। চন্দ্রকেতুগড় প্রবল মাতৃকা-উপাসক। পূর্ব ভারতের এই ভূমিতে মাতৃকা উপাসক সভ্যতা দেখছি, তাই বাঙালি বলব। পূর্ব ভারতে আসার আগে হরপ্পা সভ্যতায় অনুরূপ মাতৃকা উপাসনা দেখি, তাকে বাঙালির পূর্বজ বলব।

সপ্তম মিথ

গঙ্গারিডাই আসলে বঙ্গ। গঙ্গার/গঙ্গাল নামে কোনও জাতি ছিল না। ওটা বঙ্গাল হবে। বঙ্গের উল্লেখ ভারতীয় শাস্ত্র পুরাণ ইত্যাদিতে আছে।

সম্পূর্ণ ভুল ধারণা এটা। বঙ্গ হতে পারে না। গ্রীক ও ল্যাটিন সোর্সে হাজারবার তাঁরা গঙ্গারিডাই লিখে গেছেন। একবারও অন্য কিছু নামে এই জাতিকে উল্লেখ করেন নি। বঙ্গারিডাই লেখেন নি। বঙ্গাল জাতি হলে সেটা থাকা উচিত ছিল। ভাষাতত্ত্বের কোনও নিয়মে ব থেকে গ হয় না। যাঁরা ভারতীয় গ্রন্থের দোহাই দিয়ে বঙ্গ বা বঙ্গাল চালাতে চাইছেন গঙ্গারিডাইয়ের জায়গায়, তাঁরা মনে রাখুন, বঙ্গাল শব্দটি খ্রিষ্টপূর্বে যুগে কোনও ভারতীয় গ্রন্থে কিন্তু ব্যবহৃত হতে দেখিনি।

গঙ্গার মোহনায় এই জাতি সেজন্য বাকি ভারত, বাকি বিশ্ব এই গঙ্গারিডাই নামে ডাকত। প্রত্ন নিদর্শনগুলো যা পাওয়া গেছে সবই অধুনা পশ্চিমবঙ্গে। গঙ্গার মোহনা এখানেই।

সেযুগে বঙ্গ বললে বর্তমান বাংলাদেশ বোঝাত। অর্থাৎ পূর্বে। পশ্চিমে এই জায়গায় বঙ্গ নয়। আমি উয়ারি-বটেশ্বরের প্রত্নদ্রব্যের স্বল্প যা আলোচনা দেখেছি, সেখানে গঙ্গারিডাই রাজধানী কোনওমতেই হওয়ার কথা নয়।

উত্তরাপথ পশ্চিমবঙ্গে এসেই সমাপ্ত হত, বুদ্ধের আগে থেকেই। তাম্রলিপ্ত (ও গঙ্গে) থেকে সারা ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যর অনেকটা অংশ নিয়ন্ত্রিত হত। বঙ্গে এই সভ্যতার ভরকেন্দ্র থাকার কথা নয়, তবে বঙ্গে আউটপোস্ট থাকতেই পারে, বঙ্গ এখান থেকে নিয়ন্ত্রিত হত, এমনটা হতেই পারে। গঙ্গারিডাই সভ্যতার ভরকেন্দ্র নিঃসন্দেহে আজকের পশ্চিমবাংলার চন্দ্রকেতুগড় অঞ্চলে ছিল।

shoptodina.com
shoptodina.comhttps://shoptodina.com
সপ্তডিঙা। কথাটা শুনলেই মনে আসে বাঙালির সমুদ্রবাণিজ্যের এক গৌরবময় ইতিহাস। গৌড়ের বণিকরা সাতটি বিশাল নৌকার এই সমবায় নিয়ে সিংহল, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, চীন, রোম, গ্রীস, ক্রীট, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করে ফিরে আসতেন স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার নিয়ে। সপ্তডিঙা তাই বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির অভিজ্ঞান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Advertisingspot_img

Popular posts

My favorites