Wednesday, December 18, 2024
Homeকালীক্ষেত্র আন্দোলনকালী কে, কালিকে?

কালী কে, কালিকে?

★ কালী হলেন জগদকারণ প্রকৃতি। সাংখ্য ও তন্ত্র দর্শনের কেন্দ্রে আছেন প্রকৃতি: অব্যক্ত, আদ্যা, নিত্যা, অদ্বয়। সমস্ত লিঙ্গভেদের ঊর্ধ্বে তিনি, আমাদের ধ্যানের সুবিধার জন্য মা বলে ডাকি। বহু আগে সাধক কবি কমলাকান্ত লিখেছিলেন, কালী কেবল মেয়ে নয়, মেঘের বরণ করিয়ে ধারণ কখনও কখনও পুরুষ হয়। বর্তমানকালে জনপ্রিয় একটি শাক্তগানে বলা হয়েছে, তুমি পুরুষ কি নারী, বুঝিতে নারি, স্বয়ং না বোঝালে তা কি বুঝিতে পারি।

তাই কালী কে, সে কথা আমরা বরং মা কালীকেই জিজ্ঞেস করি। কারণ তিনি অব্যক্ত , বাক্য ও মনের অগোচর, অজ্ঞেয়। রামপ্রসাদ বলেছিলেন, কে জানে কালী কেমন, ষড় দর্শনে পায় না দর্শন।

কালী কে, কালিকে!

★★★

একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা, শ্রী শ্রী চণ্ডীতে দেবী স্বয়ং বলেন: “এই জগতে একমাত্র আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কে আছে!”

তিনি সর্বকারণকারণম্‌, দেবীভাগবত অনুযায়ী। তিনি অনাদি ও অদ্বয়। দেবী ভাগবত বর্ণনা করছে যখন সৃষ্টির আদিতে বেদ ছিল না, বিষ্ণু বা বাসব ছিলেন না, জল, বায়ু, অম্বর ছিল না, মন ছিল না, বুদ্ধি ছিল না, তখন শুধু দেবী ছিলেন। এই রূপটি বাঙালির প্রকৃতিমাতৃকার রূপ। কালীকুলে এই অদ্বয়বাদ আছে। তিনি উৎস, তিনি সমাপ্তি, তিনি ছাড়া আর কিছু নেই।

কালিকা বঙ্গদেশে চ। কালী হলেন বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী।

কলৌ কালী কলৌ কালী নান্যদেবো কলৌযুগে। মা কালী কলিযুগেশ্বরী, কলিযুগে কালী একমাত্র ফলপ্রদা। কলিযুগের একমাত্র গতি কালী, এবং কলিযুগে অপর কোনও দেবতা পূজা পাওয়ার অধিকারী নন।
এবং এই কালী কেবল শাক্তদের নন, তিনি জগজ্জননী। তিনি বৈষ্ণবের কৃষ্ণ। হ্যাঁ, কালী ও কৃষ্ণ অভেদ। নিতাইচাঁদ মা ত্রিপুরাসুন্দরীর উপাসনা করতেন। খড়দহে তাঁর প্রতিষ্ঠিত দুর্গাপুজো আজও হয়। বাংলার বৈষ্ণবও শাক্ত। এবং কালীই শৈবদের পরম উপাস্য, কারণ মহাকাল ও মহাকালী অভিন্ন।

★★★

কালী হরপ্পা সভ্যতা থেকেই পূজিত, যদিও আগে তিনি যন্ত্রে পূজিত হতেন, এছাড়া ভিন্ন ভিন্ন মূর্তিরূপ ছিল। হরপ্পা থেকেই সুভীষণ মাতৃমূর্তির উপস্থিতি দেখা যায় (অর্থাৎ ভয়াভয় মূর্তি দেখা যায়: মায়ের সন্তানদের শত্রুদের মনে ভয় উদ্রেক ও মায়ের সন্তানদের অভয় প্রদান করেন কালী, কেননা তিনি জগদকারণ ও জগদবিলয়। তিনি সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়)। মায়ের বর্তমান মূর্তিরূপ পালযুগের অবদান, এবং সেনযুগে তা চূড়ান্ত রূপ পায়, সেনযুগের বৃহদ্ধর্ম পুরাণে আমরা কালীর বর্তমান মূর্তিরূপ পাই। এর তিন চারশো বছর পরে অন্ধকার মধ্যযুগে আগমবাগীশ মা কালীর সেই রূপ পুনরুদ্ধার করেন।

★★★

কালী ও দুর্গা অভিন্ন। দুর্গোৎসব আসলে ভদ্রকালীর পুজো। দুর্গাপূজার কেন্দ্রে আছে সন্ধিপুজো, এবং সেই সন্ধিপুজোর বলি গ্রহণ করেন স্বয়ং চামুণ্ডা কালী।

বাংলার প্রাচীনতম সভ্যতাকেন্দ্র পাণ্ডু রাজার ঢিবি অন্তিম হরপ্পা সভ্যতার সমসাময়িক। সেই প্রত্নক্ষেত্রে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছিল যে সেখানে বলাকা মাতৃকা পূজিত হতেন। আমরা জানি প্রাচীন বাঙালি জাতি বলাকা মাতৃকার উপাসক ছিলেন: বেদের বয়াংসি শ্লোক দ্রষ্টব্য।

এই বলাকা মাতৃকা হলেন কালীর আদি রূপ। দশমহাবিদ্যার অন্যতম মা বগলামুখী আসলে আদিতে বলাকামুখী। এছাড়া মা কালীর নিত্যা (আবরণ দেবতা) -দের মধ্যে একজন হলেন বলাকা। এই বিষয়ে তমাল দাশগুপ্তের প্ৰবন্ধ মা কালীর উত্থান এবং মা কালীর উৎসরণ দ্রষ্টব্য, যা সপ্তডিঙা পত্রিকার ওয়েবসাইটে বিনামূল্যে পড়া যায়।

★★★

ধর্ম, যা ধারণ করে। ধর্ম কেবল রিলিজিয়ন নয়। বাঙালিত্বের সংজ্ঞা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়, স্রেফ ভাষাগত নয়। তাহলে ইংরেজিতে কথা বলেই সবাই ইংরেজ হত। সমকালের বিখ্যাত তাত্ত্বিক ইউভাল নোয়া হারারি বলেছেন ধর্মের মাধ্যমেই মানুষ বৃহৎ সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করেছে, অন্যান্য প্রাইমেটদের মত ক্ষুদ্র ইমিডিয়েট গোষ্ঠী থেকে বৃহত্তর সভ্যতায় উত্তীর্ণ হয়েছে।

তন্ত্রধর্ম এবং মাতৃধর্ম পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম। সাংখ্য ও তন্ত্রের প্রকৃতি কিন্তু কোনও আল্লা ঈশ্বর গড়ের মত মানবকল্পনা নন। ভারতের অতি প্রাচীন তত্ত্ব হল সাংখ্য যা নিরীশ্বর দর্শন হিসেবে প্রসিদ্ধ। সাংখ্য দর্শনের বিখ্যাত উক্তি, ঈশ্বরাসিদ্ধে। কাজেই প্রকৃতি কোনও তথাকথিত ঈশ্বর নন। জগতের উৎসরূপে তাঁকে বিগ ব্যাং ভাবতে পারেন, এবং তিনি বিশ্বচরাচর জুড়ে ব্যাপ্ত, জীব জড় নির্বিশেষে সমস্ত তাঁর উপাদান, তাঁর অংশ। প্রকৃতি হলেন বৃহৎ ইউনিভার্স এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোয়ান্টাম। এবং এই ধর্ম জগৎকে অস্বীকার করতে শেখায় না, এই ধর্ম বস্তুনিষ্ঠ। এই ধর্ম নরদেহকে অস্বীকার করতেও শেখায় না, কোনও দেহাতীত পরম সত্য নয়, দেহভাণ্ডর মধ্যেই ব্রহ্মাণ্ডকে অনুভব করা এই ধর্মের বৈশিষ্ট্য। আদি তন্ত্র থেকেই যোগ এসেছে আমরা জানি, তন্ত্রাশ্রয়ী হরপ্পা সভ্যতায় যোগাসন প্ৰচলিত ছিল।

মানব সম্পদের সর্বোচ্চ অনুশীলন হল আমাদের জগন্মাতার ধর্মের শিক্ষা। জয় মা কালী ধ্বনি আমাদের উৎসাহ দেয়, জাগতিক সত্যে সম্পৃক্ত করে।

এছাড়া তন্ত্রে লিঙ্গবৈষম্য নেই, পুরুষতন্ত্র নেই, নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য এই ধর্ম শেখায় না। তন্ত্রে বর্ণভেদ-বর্ণবাদ নেই, এই ধর্মে ব্রাহ্মণ শূদ্রের ভেদাভেদ করতে শেখায় না। মা কালীর তন্ত্র কেবল আবহমান নয়, তা একুশ শতকে এবং ভবিষ্যতেও মানুষের সর্বাঙ্গীন মুক্তির পথ, ধ্যান ও আনন্দের পথ, সেজন্যই পশ্চিমের দেশগুলিতে তন্ত্র এবং মাতৃকা উপাসনা সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ছে, অনবরত গবেষণা হচ্ছে। বাঙালি অভাগা, বাংলা ভূমি দালাল অধ্যুষিত, তাই সে নিজের শেকড়ের কথা নিজেই জানতে পারছে না। শিক্ষিত ভদ্রলোক বাঙালি আত্মবিস্মৃতির অন্ধকারে নিমজ্জিত।

★★★

কিন্তু সমস্ত অধঃপতন সত্ত্বেও বাঙালি হল আধুনিক পৃথিবীর একমাত্র মাতৃকা উপাসক মহাজাতি। মাতৃধর্ম পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম, প্রাচীন প্রস্তর যুগ থেকেই মাতৃকা উপাসনা প্ৰচলিত, তার পাথুরে প্রমাণ আছে, কিন্তু বাকি সর্বত্র তা প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর একমাত্র জীবন্ত মাতৃধর্মের বিপুল জনপ্রিয়তা এই বাঙালির মধ্যেই দেখা যায়। বাঙালির সংজ্ঞায়ন হয় মাতৃধর্মে, মা কালী আমাদের জাতির পরিচয়। এবং কালী হলেন অব্যক্ত জগদকারণ প্রকৃতির ব্যক্ত ধ্যানমূর্তি।

কালীর দর্শন ও তত্ত্ব তো অসীম। তবে সবার ওপরে, সবার আগে তিনি আমাদের মা। তিনিই জন্ম দেন, তিনি চতুর্বর্গ দান করেন, জীবনের শেষে তিনিই অন্তিম আশ্রয় দেন।

বাঙালির অস্তিত্ব মা কালীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাঙালির নবজাগরণ একমাত্র তন্ত্রধর্মী শেকড়ের পুনরুদ্ধার করার মাধ্যমেই সম্ভব। তাই কালীতত্ত্ব মহাসমুদ্র থেকে এই এক আঁজলা জল নিয়ে আমরা আমাদের মায়ের নামে জয়ধ্বনি করলাম। জয় মা কালী

shoptodina.com
shoptodina.comhttps://shoptodina.com
সপ্তডিঙা। কথাটা শুনলেই মনে আসে বাঙালির সমুদ্রবাণিজ্যের এক গৌরবময় ইতিহাস। গৌড়ের বণিকরা সাতটি বিশাল নৌকার এই সমবায় নিয়ে সিংহল, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, চীন, রোম, গ্রীস, ক্রীট, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করে ফিরে আসতেন স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার নিয়ে। সপ্তডিঙা তাই বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির অভিজ্ঞান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Advertisingspot_img

Popular posts

My favorites