কিরীটেশ্বরী। মুর্শিদাবাদের একমাত্র সতীপীঠ। উত্তর রাঢ়ের অন্যতম একদা গৌরবময় কিন্তু অধুনা অবহেলিত শক্তিসাধনার ক্ষেত্র। বহরমপুর থেকে ১৯ কিমি দূরে; কিন্তু আধুনিক বাঙালির আগ্রহের জগত থেকে বোধহয় লক্ষ যোজন দূরে নির্বাসিত। লিখছেন- রক্তিম মুখার্জি
পীঠনির্ণয়তন্ত্র সহ একাধিক তন্ত্রগ্রন্থের সাক্ষ্য অনুযায়ী এই স্থানেই পতিত হয়েছিল আদিশক্তি দেবী সতীর মাথার উজ্জ্বল কিরীট বা মুকুট। দেবীর নাম বিমলা; ভৈরব সম্বর্ত। পীঠের প্রাচীন নাম ছিল কিরীটকণা বা কিরীটকোনা। সেই পীঠের অধীশ্বরী হওয়ায় জনমানসে দেবীর নাম কিরীটেশ্বরী।
বর্তমানে মূল মন্দিরে গেলে দেখা যায় দেবীর পিতলের মূর্তির মুখ। মাথায় উজ্জ্বল কিরীট। মুখে ললিত হাস্য। বর্ণ তপ্তকাঞ্চনের ন্যায়। মুখের নিচে থেকে বাকি অংশ আবৃত। মূল মন্দিরের পূজারীর মতে ঐ আবৃত অংশটিই সতীর কিরীটের প্রস্তরীভূত অংশ। দেবীর মূর্তির পাশেই সেই শিলীভূত পীঠবস্তুর ছবিও রাখা আছে। কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় ঐ ছবিতে যে বস্তুটি দেখা যাচ্ছে সেটা মুকুট নয়; বরং শিলানির্মিত সিংহাসন বা রত্নবেদির অংশবিশেষ। বেদিটি আয়তাকার। তার দুই প্রান্ত থেকে অর্ধবৃত্তাকার চূড়া উঠে একত্রিত হয়েছে। উপরে কীর্তিমুখ আছে। নির্মাণশৈলী পাল সেন যুগের।
মূল মন্দিরের পাশেই একটি মন্দিরে শিলানির্মিত একটি সিদ্ধাসন আছে। ইতিহাস এবং জনশ্রুতি আমাদের জানায় ঐ আসনে বসে কালীসাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন নাটোরের রাণী ভবানীর একমাত্র পুত্র অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার অন্যতম প্রধান সাধক কবি রাজা রামকৃষ্ণ। এই দুই মন্দিরের বাইরেই ঘাটবাঁধানো প্রাচীন একটি দহ আছে। দহের পাশে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পাল সেন যুগের স্তম্ভের ভগ্নাবশেষ, ভগ্ন শিবলিঙ্গ, একটি দেববিগ্রহের কারুকার্যমণ্ডিত পাদপীঠ। মূল মন্দির চত্বরকে ঘিরে আছে সপ্তদশ অষ্টাদশ শতাব্দীর সাত আটটি শিবমন্দির। প্রতিটি মন্দিরেই টেরাকোটার অপূর্ব নিদর্শন ছিল একসময়। যদিও বর্তমানে কয়েকটি মন্দির আধুনিক সংস্কারের বদান্যতায় সেসব অমূল্য শিল্পের সব চিহ্ন হারিয়ে ফেলেছে। বাকি কয়েকটি মন্দির বটের ঝুড়ি আশ্রয় করে, অগণিত ফাটলের ক্ষত বুকে নিয়ে বিগ্রহশূন্য অবস্থায় পরিপূর্ণ ধ্বংসের দিন গুনছে। শোনা যায়; সিরাজের পতনের পর রাজা রাজবল্লভ রায় যখন মারা যান; তখনই নাকি মূল মন্দিরের কয়েকটি শিবমন্দির ফেটে যায়। যদিও মন্দিরগুলি দেখে বোঝা যায় কোনোরকম সামরিক অভিযানের কারণেই এই ভগ্নদশা নেমে এসেছে। হয়তো রাজবল্লভ রায়ের মৃত্যুর পরেই নবাব মীরকাশিমের সময়ে এই মন্দিরগুলি আক্রান্ত হয়েছিল।
ভৈরব সম্বর্তের মন্দির বর্তমানে বিগ্রহশূন্য। অথচ নিখিলনাথ মহাশয়ের মুর্শিদাবাদের ইতিহাস বইয়ে সম্বর্ত ভৈরবের ছবি আছে। তিনি পদ্মাসনে উপবিষ্ট, হাতে বরদমুদ্রা, মাথায় জটাজুট, পরিধানে কাষায়বস্ত্র। নিঃসন্দেহে এই মূর্তি মহাযান ও বজ্রযানে উপাসিত পঞ্চবুদ্ধের অন্যতম রত্নসম্ভব বুদ্ধের।
প্রশ্ন জাগে তাহলে মূল পীঠবস্তু কোথায় আছে? ভৈরবের মূর্তিই বা কোথায় গেল? পুরোহিত ও স্থানীয় মানুষদের বক্তব্য অনুযায়ী মূল মন্দির থেকে অল্প দূরেই আছে গুপ্তমন্দির। সেখানেই পীঠবস্তু রক্ষিত আছে। সেখানে গেলে দেখা যায় একটি বাংলা রীতির মন্দির। দেখে মন্দির কম; গৃহস্থের বাড়ি বেশি মনে হয়। পাশে তিনটি শিবমন্দির। অষ্টাদশ শতাব্দীর টেরাকোটার মন্দির। সংস্কারের প্রভাবে প্রাচীনত্ব হারিয়ে গেছে কবেই। আর মন্দির চত্বরের বাইরেই আর একটি মন্দিরের ভগ্নাবশেষ আছে। তার গায়ে এলাকার মানুষ নিয়মিত পরম যত্নে ঘুঁটে দিয়ে থাকেন। ইতিহাসবিস্মৃত জাতির যোগ্য কাজই বটে।
গুপ্তমন্দিরে পূজিত হয় পীঠবস্তু ব্রহ্মশিলা দেবীর কিরীট। গুপ্তমন্দিরের পূজারীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী; অতীতে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত মূল মন্দিরেই পীঠবস্তু থাকত। এখন যেখানে গুপ্তমন্দির আছে; সেখানে দেবীর পূজারীদের ১৭০ টি পরিবার বাস করতেন। সেই সময় বস্ত্রাবৃত পীঠবস্তু ব্রহ্মশিলাই মূল মন্দিরে পূজিত হত। মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার নবাব হয়ে যখন ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন; তখন কিরীটেশ্বরী মন্দিরের সুরক্ষা নিয়ে সংশয় দেখা যায়। নতুন রাজধানী থেকে যেকোনো মুহূর্তে সতীপীঠে আক্রমণ ঘটতে পারে; এটা অনুমান করে পূজারীগণ গোপনে পীঠবস্তু এখানে নিয়ে চলে আসেন। একটি সাধারণ বাসগৃহের মতো মন্দির তৈরি করে তার মধ্যে ব্রহ্মশিলাকে রাখা হয়। যাতে মন্দিরটিকে পূজারীদের গৃহের থেকে আলাদা করে কেউ শনাক্ত করতে না পারে। তখন থেকেই পরিত্যক্ত হয়ে যায় মূল মন্দির।
স্থানীয় বাগদি ও কৈবর্ত জাতির মানুষ এই মন্দিরের রক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন। আজও গুপ্তমন্দিরের চারপাশে তাঁরা বংশপরম্পরায় বাস করেন এবং মন্দিরের আনুষঙ্গিক কাজকর্ম করে থাকেন। এরপর মুর্শিদকুলি থেকে মিরজাফর পর্যন্ত প্রায় সত্তর বছর ধরে এখানেই সেই পূজারীগণ দেবীর পূজা করেন। শোনা যায় কুষ্ঠরোগাক্রান্ত নবাব মীরজাফর মৃত্যুকালে কিরীটেশ্বরী দেবীর চরণামৃত খেয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। সেই সময়েই পরিত্যক্ত মূল মন্দিরের নির্জনতায় কঠোর সাধনায় মগ্ন হন নাটোররাজ রামকৃষ্ণ। ঐ সিদ্ধাসনে বসেই সাধনা এবং শ্যামাসঙ্গীত রচনা করতেন সর্বত্যাগী রাজা। কিরীটেশ্বরী ক্ষেত্র কখনও মুখরিত হত তাঁর অপূর্ব বন্দনাগীতে:
জয় কালী রূপ কি হেরিলাম
হরহৃদে মায়ের পদে মন সঁপিলাম
কখনও ভারী হয়ে উঠত সাধকের অভিমানে ভরা গানের বিষণ্ণতায়:
এখনও কি ব্রহ্মময়ী হইনি মা তোর মনের মত
অকৃতি সন্তানের প্রতি বঞ্চনা কর মা কত
কখনও শোনা যেত তন্ত্রসাধকের অন্তরের কথা:
মন যদি মোর ভোলে
তবে বালির শয্যায় কালীর নাম দিও কর্ণমূলে
তাঁর সাধনক্ষেত্রে ঐ সিদ্ধাসনের উপর বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন লালগোলার স্বনামধন্য মহারাজ যোগীন্দ্রনারায়ণ বাহাদুর।
কিংবদন্তি আমাদের জানায় ইতিমধ্যে ঘটে যাওয়া এক আশ্চর্য দুর্ঘটনার কথা। আজ থেকে আনুমানিক আড়াইশো বছর আগে কোনো এক সময়ে ১৭০ টি পরিবারের পূজারীরা সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রহ্মশিলা দর্শন করবেন। সেই মতো পীঠবস্তুর উপর থেকে বস্ত্রের আবরণ সরানো মাত্র তীব্র আলোকে কয়েকজন দৃষ্টি হারান। বাকিরা তাড়াতাড়ি সেটি আবার আগের মতো আবৃত করে দেন। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ঐ ১৭০টি পরিবারের সমস্ত চিহ্ন এলাকার মাটি থেকে চিরতরে মুছে যায়। আবার কালক্রমে বিভিন্ন স্থান থেকে নতুন পূজারীরা এসে নতুন করে পূজা শুরু করেন।
গুপ্তমন্দিরের পুরোহিতের কাছে জানা গেল ভৈরব সম্বর্তের মূর্তি বছর ষাটেক আগে চুরি হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন মূল মন্দিরটি অবহেলিত হয়েই পড়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীতে লালগোলার রাজা দর্পনারায়ণ এই মন্দির সংস্কার করেন। সেই সময় মাটির নিচে থেকে খননকার্যের সময় পাওয়া ঐ সিংহাসনটি(যেটাকে স্থানীয় অনেকেই ভুল করে দেবীর কিরীট মনে করেন) মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে সেখানে আবার নিত্যপূজা শুরু হয়। সম্প্রতি কয়েক বছর আগে আবার মন্দিরের সংস্কার হয়েছে। কিরীটেশ্বরীর প্রাচীন মন্দিরটি বর্তমান মুর্শিদাবাদের প্রাচীনতম মন্দিরসমূহের অন্যতম। এখন এই পীঠে দেবী কালীর ধ্যানেই পূজিত হন। শারদীয়া মহাষ্টমীর দিন গুপ্ত মন্দিরে পীঠবস্তুর বার্ষিক স্নানাভিষেক হয়। তবে পূজারীরা সতর্ক থাকেন যাতে কোনোভাবেই ব্রহ্মশিলা কারোর দৃষ্টিগোচর না হয়। গুপ্তমন্দিরে বস্ত্রাবৃত দেবীর কিরীট ছাড়াও রাখা আছে পাল সেনযুগের একটি মূর্তির মুখ ( বাসুদেবও হতে পারেন ; সদাশিবও হতে পারেন), বেশ কয়েকটি ভাঙা শিবলিঙ্গ এবং একটি বিষ্ণুমূর্তির চক্রশোভিত হাতের ভগ্নাবশেষ। সবগুলিই পাল সেন যুগের বলে মনে হচ্ছে।
কিংবদন্তি ও ইতিহাসের থেকে মোটামুটি যেটা বোঝা যাচ্ছে তা হল: কিরীটেশ্বরী পীঠ পালযুগ থেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ ও সাধনক্ষেত্র ছিল। মূল মন্দিরে ঐ সিংহাসন বা বেদির উপরেই প্রাচীন দেবীমূর্তি বিদ্যমান ছিল; যা এখন আর নেই। যেহেতু সেই দেবীর নাম বিমলা এবং শারদীয়া অষ্টমীতে তাঁর বিশেষ বাৎসরিক পূজা হত; তাই অনুমান করা যায় তাঁর মূর্তি ছিল মহিষমর্দিনী সিংহবাহিনী। আবার ভৈরব যেহেতু রত্নসম্ভব; সেহেতু দেবী রত্নসম্ভবের শক্তি মামকীর কোনো রূপভেদও হয়ে থাকতে পারেন। বেশ কিছু প্রাচীন শিবলিঙ্গের ভগ্নাবশেষ এবং ঐ বাসুদেব মূর্তিটি দেখে অনুমান করা যায়; বৈষ্ণব শাক্ত ও শৈবতন্ত্রের ধারা এখানে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিল। একদিকে কর্ণসুবর্ণ এবং অন্যদিকে গৌড়ের রামাবতী ও লক্ষ্মণাবতীর মধ্যভাগে গঙ্গার উপকণ্ঠে অবস্থিত কিরীটকোণা ক্ষেত্রে মহাযান ও বজ্রযানেরও পূর্ণ প্রভাব ছিল। সম্ভবত বাগদি ও কৈবর্ত জাতির নায়কেরাই এলাকার প্রধান সামরিক শক্তি ছিলেন। সুলতানি আমলে ১৪০৫ সালে সেই মন্দির একবার আক্রান্ত হয়েছিল। প্রাচীন মন্দির তখন থেকেই পরিত্যক্ত। দেবীমূর্তি, বাসুদেব মূর্তি ও শিবলিঙ্গসমূহ হয়তো তখনই বিনষ্ট হয়ে যায়। ভৈরব ও পীঠবস্তু যেভাবেই হোক রক্ষা পেয়েছিল। পাশের একটি মন্দিরে(যেটি এখন মূল মন্দির) পীঠবস্তু রেখে পূজা শুরু হয়। সপ্তদশ অষ্টাদশ শতাব্দীর ঘটনাবহুলতার কথা তো আগেই বললাম। আজ থেকে আনুমানিক ষাট বছর আগে সম্বর্ত ভৈরবের মূর্তি সম্ভবত প্রত্নচোরদের দ্বারা অপহৃত হয়েছে।
সব মিলিয়ে বলতে গেলে; কিরীটেশ্বরী মন্দির বাঙালির ইতিহাসের এমন এক রত্নভাণ্ডার; যা চূড়ান্ত অবহেলায় দিনে দিনে হারিয়ে ফেলছে সমস্ত সম্পদ। যেখানে পাল সেনযুগে বাগদি কৈবর্ত জাতির সুরক্ষাবলয়ে পূজিত হতেন দেবী বিমলা ও ভৈরব সম্বর্ত, যেখানে সপ্তদশ অষ্টাদশ শতাব্দীর কয়েকটি অমূল্য টেরাকোটার মন্দির বাঙালির শিল্পরীতির গৌরবময় দিনের সাক্ষ্য দিচ্ছে; যে ক্ষেত্র পবিত্র হয়েছে সাধকপ্রবর নাটোররাজ রামকৃষ্ণের মহিমময় সান্নিধ্যে; সেই কিরীটেশ্বরী ক্ষেত্রের রক্ষণাবেক্ষণ ও এখানকার ইতিহাসের পরিপূর্ণ উদ্ঘাটন ইতিহাসবিস্মৃত বাঙালির ইতিহাসচেতনা ও সাংস্কৃতিক শিকড়ের বোধ ফিরিয়ে আনতে একান্ত প্রয়োজন।