Wednesday, December 18, 2024
Homeবাঙালির ইতিহাসঅক্ষয়কুমার বড়াল: বাংলা গীতিকাব্যের অমর ধ্রুবতারা

অক্ষয়কুমার বড়াল: বাংলা গীতিকাব্যের অমর ধ্রুবতারা

অক্ষয়কুমার বড়াল বাংলা গীতিকবিতার ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর কাব্যিক সৃষ্টি আমাদের মননে চির অমর হয়ে থাকবে। লিখেছেন- রামকৃষ্ণ বড়াল

খ্রিস্টীয় উনিশ শতকের বাংলা গীতিকাব্যের আকাশে অক্ষয়কুমার বড়াল ছিলেন এক জাজ্জ্বল্যমাণ ধ্রুবতারা। ১৮৬০ সালে কলকাতার চোরাবাগানের ১৬, শ্রীনাথ রায় গলির ৯ নম্বর বাড়িতে এক সুবর্ণ বণিক পরিবারে জন্ম নেন তিনি। পিতা কালীচরণ বড়াল ও মাতা রানীবালা দাসীর একমাত্র সন্তান অক্ষয়কুমার বড়াল হেয়ার স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন, কিন্তু বিদ্যালয়ের গণ্ডী অতিক্রম করতে পারেননি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সফল না হলেও, তিনি সারাজীবন জ্ঞান আহরণে ব্রতী ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়, তিনি ছিলেন ‘যথার্থ অর্থেই একজন স্বশিক্ষিত মানুষ।’

বিহারিলালের প্রভাব

ছাত্রাবস্থায় কবি বিহারিলাল চক্রবর্তীর সান্নিধ্য লাভ করেন অক্ষয়কুমার। উনিশ শতকের শুরুতে বাংলা কবিদের কাব্যচর্চা ছিল মূলত বহিঃকেন্দ্রিক, যেখানে স্থান পেত দৃশ্যমান প্রকৃতি, মানুষের কীর্তি, প্রাকৃতিক দৃশ্য ইত্যাদি। বিহারিলাল চক্রবর্তী এই ধারার বিপরীতে আত্মকেন্দ্রিক কাব্যচর্চার প্রবর্তন করেন। মানুষের মনের গভীরে অহরহ ঘটে চলা ঘটনাগুলোকে কাব্যে সাজিয়ে উপস্থাপন করেন তিনি। এই নতুন ধারায় আকৃষ্ট হন অক্ষয়কুমার বড়াল। তাঁর ভাষা, ভঙ্গি এবং ভাবনায় বিহারিলালের প্রভাব স্পষ্ট ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘বিহারিলালের সাক্ষাৎ ভাবশিষ্য’ আখ্যায় ভূষিত করেন।

কর্মজীবন

বিদ্যালয় ছাড়ার কিছুদিন পর অক্ষয়কুমার ‘দিল্লি অ্যাণ্ড লণ্ডন’ ব্যাঙ্কে হিসাব বিভাগের কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন। কয়েক বছর পর কর্মাধ্যক্ষের সাথে মনোমালিন্যের কারণে পদত্যাগ করেন এবং ‘নর্থ ব্রিটিশ লাইফ ইনস্যুরেন্স’ কোম্পানিতে সচিব পদে যোগ দেন। সেখানে তিনি আমৃত্যু স্বপদে বহাল ছিলেন।

সাহিত্য জীবন

অক্ষয়কুমারের সাহিত্য জীবন শুরু হয় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর দীর্ঘ কবিতা ‘রজনীর মৃত্যু’ দিয়ে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রদীপ’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ সালে। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলোতে নিসর্গ, প্রেম, শোক, মানব বন্দনা প্রভৃতি বিষয় সুচারু রূপে ফুটে উঠেছে। তাঁর কাব্যে মার্জিত চিন্তাধারা এবং বিজ্ঞান মনস্কতা এক ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করেছে। ‘প্রদীপ’, ‘কনকাঞ্জলি’, ‘ভুল’, ‘শঙ্খ’, ‘এষা’ — এই পাঁচটি কাব্যগ্রন্থের সার্থক রচয়িতা তিনি। ‘ভুল’ বাদে বাকি চারটি কাব্যগ্রন্থের একাধিক সংস্করণ তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়। খুব কম বয়সে তিনি নিজের জাত চিনিয়ে ছিলেন। ‘প্রদীপ’ কাব্যগ্রন্থের জীবন সংগ্রাম কবিতাটি এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। সেখানে তিনি বলেছেন —

” কি ভীষণ চলেছে সংগ্রাম
প্রিয়জন সনে অবিরাম!
পূজ্য বৃদ্ধ পিতামাতা, স্নেহের পুত্তলী ভ্রাতা
সহোদরা বালিকা সুঠাম,
তাহারাও জনে জনে উন্মত্ত এ মহারণে!
হা জীবন, হায় ধরাধাম!
সখা সখী আত্মীয় স্বজন –
তারাও যুঝিছে অনুক্ষণ!
প্রাণাধিকা প্রাণেশ্বরী তারও সনে যুদ্ধ করি,
সেও শত্রুসেনা একজন!
শত শত তপস্যার ফল এই শিশু সুকোমল,
এও এক যোদ্ধা বিচক্ষণ। “
কবিতাটি পাঠ করার পরে ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাশয়ের মনে হয়েছে এখানেই বাংলা সাহিত্যের ‘রোমান্টিসিজমের’ জন্ম। আবার ‘প্রার্থনা’ কবিতায় দেখা যায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এবং তাদের ভাবনার প্রতিফলন —
“দুঃখী বলে, বিধি নাই, নাইকো বিধাতা
চক্রসম অন্ধ ধরা চলে
সুখী বলে, কোথা দুঃখ, অদৃষ্ট কোথায়!
ধরনী নরের পদাতলে।
জ্ঞানী বলে, কার্য আছে, কারণ দুর্জ্ঞেয়
এ জীবন প্রতীক্ষা কাতর।
ভক্ত বলে, ধরণীর মহারাসে সদা
ক্রীড়ামত্ত রসিক শেখর।
ঋষি বলে, ধ্রুব তুমি বরেণ্য ভূমায়
কবি বলে, তুমি শোভাময়।
গৃহি বলে, জীবযুদ্ধে ডাকি হে কাতরে
দয়াময়, হও হে সদয়।”

ব্যক্তিগত জীবন

অক্ষয়কুমার বড়াল জোড়াসাঁকোর দত্ত বাড়ির সুবাসিনী দেবীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পঁচিশ বছর বয়সে তাঁর পিতৃ বিয়োগ ঘটে এবং ছত্রিশ বছর বয়সে প্রিয়তমা পত্নীকে হারিয়ে শোকসাগরে নিমজ্জিত হন। তাঁর পত্নী প্রেমের স্মৃতি হিসাবে ‘এষা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়, যা বাংলা সাহিত্যের এক অমর সৃষ্টি।

শেষ জীবন

জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি ‘চণ্ডীদাস’ নামে একটি নাটক লিখতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু তা সম্পূর্ণ করতে পারেননি। ১৯১৯ সালের ১৯শে জুন যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর প্রয়াণ ঘটে।

অক্ষয়কুমার বড়াল বাংলা গীতিকবিতার ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর কাব্যিক সৃষ্টি আমাদের মননে চির অমর হয়ে থাকবে।

তথ্যসূত্র:

১. অক্ষয়কুমার বড়াল গ্রন্থাবলী : বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ।

২. সাহিত্য সাধক চরিতমালা : বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ।

shoptodina.com
shoptodina.comhttps://shoptodina.com
সপ্তডিঙা। কথাটা শুনলেই মনে আসে বাঙালির সমুদ্রবাণিজ্যের এক গৌরবময় ইতিহাস। গৌড়ের বণিকরা সাতটি বিশাল নৌকার এই সমবায় নিয়ে সিংহল, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, চীন, রোম, গ্রীস, ক্রীট, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করে ফিরে আসতেন স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার নিয়ে। সপ্তডিঙা তাই বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির অভিজ্ঞান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Advertisingspot_img

Popular posts

My favorites