Monday, December 23, 2024
Homeবাঙালির ইতিহাসঅশোককান্তা: মাতৃকার এক বিস্মৃত রূপ

অশোককান্তা: মাতৃকার এক বিস্মৃত রূপ

বারো মাসের তেরো ষষ্ঠীর তালিকায় আজ বছরের অন্তিম ষষ্ঠী; অশোকষষ্ঠীর ব্রতের তিথি। হয়তো শিশুপালিকা মাতৃকার ষষ্ঠী রূপের মধ্যেই মিশে আছেন বজ্রযানের শোকহারিণী মারীভয়হারিণী অশোককান্তা। বিস্মৃত সাধনক্রমের পুনরধ্যয়ন বাঙালিমাত্রেরই একান্ত কর্তব্য। লিখেছেন- রক্তিম মুখার্জি

অশোককান্তা মারীচি বজ্রযানে উপাসিতা মাতৃকাগণের অন্যতমা। সম্ভবত চৈত্রমাসেই এই দেবীর উপাসনা করতেন পাল ও সেনযুগের বাঙালি। কারণ সাধনমালায় উল্লিখিত এঁর দুটি সাধনক্রমেই ধ্যান অনুযায়ী ইনি বিশ্বপদ্মে অশোকমঞ্জরীর উপরে সূর্যমণ্ডলের সমস্ত রশ্মিচ্ছটা অঙ্গে ধারণ করে অবস্থান করেন। দেবী পীতবর্ণা; দ্বিভুজা। রত্নমুকুট তাঁর মস্তকে। হাতে বরদ মুদ্রা ও অশোকমঞ্জরী। অশোকমঞ্জরীর সাথে দেবীর এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক লক্ষণীয়। প্রকৃতিমাতৃকার রূপে প্রকৃতির নিবিড় সংযোগ কল্পনা বাঙালির মাতৃপূজার ধারার একটি সুপ্রাচীন বৈশিষ্ট্য। গঙ্গারিডি সভ্যতার বাঙালি পদ্মহস্তা মাতৃকার উপাসনা করত। দশায়ুধা দেবীর মূর্তির চারিদিকে প্রস্ফুটিত পদ্মের বলয় একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এরপর গুপ্তযুগ ও পালযুগে রাজাদের মুদ্রায় ধান্যমঞ্জরী হস্তে শ্রীদেবী অবস্থিত ছিলেন। অশোককান্তা মারীচি সেই পরম্পরারই এক অনন্য রূপ। অশোকের সাথে এঁর সংযোগ মারীভয় নাশ এবং শোকার্ত জগতবাসীর শোকহরণের ইঙ্গিত দেয়। প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণাধীন এ জগত ত্রিতাপদুঃখময়। মাতৃকাই সেই শোকসাগরে আমাদের একমাত্র সম্বল, একমাত্র আনন্দের হেতু। সেই যে কমলাকান্ত বলেছিলেন:
আর কিছু নাই মা শ্যামা শুধু দুটি চরণ রাঙা
যে সংস্কৃতির হৃদয় থেকে এই পদ উৎসারিত হয়; অশোককান্তা সেই সংস্কৃতিরই প্রাণের দেবী।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য অশোকের সাথে মাতৃকার সংযোগ অত্যন্ত গভীর। প্রাচীনকাল থেকে অশোকবৃক্ষ প্রজননের প্রতীক রূপে পূজনীয়। গ্রামবাংলায় অশোকবৃক্ষের পূজার প্রথা বহুকাল যাবৎ প্রচলিত। দুর্গাপূজার নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদের মধ্যে একটি হল অশোক। অশোক শাখায় মাতৃকাকে শোকরহিতা রূপে বন্দনা করে সাধক প্রার্থনা করেন: মাম্ অশোকম্ সদা কুরু। আমাকে সর্বদা শোকমুক্ত করো। শোকতাপে জর্জরিত পৃথিবীর মরুভূমিতে এ যেন এক চিলতে মরুদ্যান খোঁজার আকুলতা। আবার আজকের অশোকষষ্ঠীর দিনে দেবী ষষ্ঠীর যে শোকহারিণী রূপের বন্দনা করা হয় আমাদের ব্রাত্য সংস্কৃতিতে; সেটিরও একই তাৎপর্য। মাতৃকা উপাসনা ধর্ম এভাবেই আমাদের জীবনযন্ত্রণার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আছে।

অশোককান্তা ছাড়াও মারীচির অন্যান্য মূর্তিতেও বাম হস্তে অশোকমঞ্জরীর অবস্থান একটি ধ্রুব বৈশিষ্ট্য। শুধু শোকহরণ নয়; মারীভয় নাশ করাও এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। আমাদের মাতৃকা উপাসনা ধর্মে মারীভয় নাশের জন্য অগণিত সাধনক্রম আছে। পর্ণশবরী, শীতলা, হারীতি, মহামারবতী, ওলাইচণ্ডী, রক্তবতী প্রমুখ। মারীচির সাধনক্রম এবং বিশেষ করে অশোককান্তা মারীচির সাধনক্রমও এই তালিকার অন্তর্গত। রত্নমুকুটে সজ্জিতা দেবী রাজরাজেশ্বরীর আসন থেকে অশোকবৃক্ষচ্ছায়ায় বরদাত্রী ও ব্যাধিহারিণী রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন সন্তানদের বেদনা হরণ করতে; এই ভাবনা একটি মুমূর্ষু জাতির পুনরুজ্জীবনে কতটা সহায়ক; তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া মারীচির হাতে সূচিকার অবস্থান সম্ভবত এটাই ইঙ্গিত করে যে শুধুই তত্ত্বগত ভাবে নয়; প্রায়োগিকভাবেও কোনো চিকিত্সা বিদ্যার সংযোগ ছিল এই সাধনক্রমের সাথে। অশোকমঞ্জরীরও অনেক ভেষজগুণ আছে। আয়ুর্বেদে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনাও আছে। চৈত্রের শেষভাগে যে রোগগুলি( যেমন বসন্ত, উদরাময়) ক্রান্তীয় জলবায়ুতে প্রবল আকার ধারণ করে; তাদের বেশ কয়েকটির নিরাময়ে এর প্রয়োগ হত বলে জানা যায়। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হল মারীচির দ্বাদশভুজা রূপে বাম হস্তে তর্জনী, ধনুক ও অশোকমঞ্জরীর সাথেই আছে ব্রহ্মশির, অর্থাত্ ব্রহ্মার মস্তক। এটা কি এই সাধনক্রমের এবং এই চিকিত্সা পদ্ধতির অবৈদিক পরিমণ্ডলের ইঙ্গিত দেয়? হয়তো তাই। হয়তো সেই কারণেই উড্ডিয়ান বিনির্গত সাধনক্রমে অশোকমঞ্জরী ধারিণী দ্বাদশভুজা মারীচি দেবী ডাকিনী ও বেতালগণ পরিবৃতা; মুণ্ডমালিনী; ব্যাঘ্রচর্মাম্বরা।

অশোককান্তা দেবীকে স্বতন্ত্র রূপে ছাড়াও আমরা পাই মহাশ্রীতারা দেবীর মণ্ডলে। সেখানে মহাশ্রীতারার দক্ষিণ পাশে থাকেন একজটা ও আর্যজাঙ্গুলি। বামপাশে অশোককান্তা ও মহামায়ূরী। এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমটি হল; অশোককান্তার স্বতন্ত্র রূপে তাঁর দক্ষিণ হস্তে বরদ মুদ্রা থাকলেও এই মণ্ডলে তাঁর দক্ষিণ হস্তে বজ্র থাকে। বামহস্তে যথারীতি অশোকমঞ্জরী। কেন্দ্রের দেবী সৌম্যরসের বিগ্রহ হোন বা রৌদ্ররসের; সহচরীগণ সর্বদাই সশস্ত্র এবং যুদ্ধোদ্যতা। খুব সম্ভবত তন্ত্রের সেই ধ্রুব বৈশিষ্ট্যটিই এখানেও অনুসৃত হয়েছে। কারণ পালযুগের বাঙালি জানতেন যে কৃষ্টির প্রবেশপথে অতন্দ্র প্রহরা না থাকলে সংস্কৃতির ললিত রূপটিকে রক্ষা করা দুঃসাধ্য।

দ্বিতীয় লক্ষণীয় বিষয় হল, মণ্ডলে দেবীগণের পারস্পরিক অবস্থান। মহাশ্রীতারার দক্ষিণ পাশে আর্যজাঙ্গুলি এবং বামপাশে মহামায়ূরী থাকেন। এঁরা উভয়েই সর্পমাতৃকার প্রাচীন ক্রমের সাথে যুক্ত। জাঙ্গুলি যেমন মনসার মতোই সর্পের আভরণ ধারণ করেন; মহামায়ূরী তেমনি শ্রীকুলে মনসার রূপভেদ ত্বরিতার মতো ময়ূরপুচ্ছ ধারণ করেন। অর্থাত্ আপাত বৈপরীত্যের আড়ালে এঁরা স্বরূপতঃ একই। প্রশ্ন হল সেক্ষেত্রে মহাশ্রীতারার দক্ষিণ পাশের দেবী একজটা এবং বাম পাশের দেবী অশোককান্তাও কি বাস্তবে একই মাতৃকার দুই রূপ? একজটা প্রজ্ঞাদায়িনী। ভীষণা রণরঙ্গিনী রূপে তিনি অজ্ঞানতিমির ধ্বংস করেন। সেক্ষেত্রে তাঁর সাথে অশোককান্তার একীভবনের তাৎপর্য হল: প্রজ্ঞার মাধ্যমেই এই জগতের শোকজ্বালা থেকে অব্যাহতি পাওয়া সম্ভব। সে প্রজ্ঞা তাত্ত্বিক দার্শনিকের জীবনজিজ্ঞাসা থেকেই আসুক; কিম্বা মারীর প্রকোপ দূর করতে নিয়োজিত বৈদ্যের নিরলস চর্যা থেকেই আসুক। সেক্ষেত্রে বলাই যায় অশোককান্তার মধ্যে সাঙ্খ্যকারের ভূমির অবৈদিক বস্তুবাদী দর্শনের যথাযথ প্রকাশ ঘটেছে।

বারো মাসের তেরো ষষ্ঠীর তালিকায় আজ বছরের অন্তিম ষষ্ঠী; অশোকষষ্ঠীর ব্রতের তিথি। হয়তো শিশুপালিকা মাতৃকার ষষ্ঠী রূপের মধ্যেই মিশে আছেন বজ্রযানের শোকহারিণী মারীভয়হারিণী অশোককান্তা। বিস্মৃত সাধনক্রমের পুনরধ্যয়ন বাঙালিমাত্রেরই একান্ত কর্তব্য।

ছবি কৃতজ্ঞতা Kalpadeep Paul মহাশয়।
অশোককান্তার স্বতন্ত্র মূর্তি খুবই দুর্লভ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহাশ্রীতারার মণ্ডলে তাঁকে দেখা যায়। এখানে পালযুগের লোকনাথের মণ্ডলের বামপাশে অশোককান্তা বিগ্রহ দেখা যাচ্ছে। দেবী এখানে চতুর্ভুজা। অশোকমঞ্জরী, অঙ্কুশ/ বজ্র, পরশু ও পাশ ধারণ করে আছেন। লোকনাথের দক্ষিণ পাশে সম্ভবত বজ্রস্ফেটকারা। বজ্র ও ধনুর্বাণ ধারিণী।

অশোককান্তা

shoptodina.com
shoptodina.comhttps://shoptodina.com
সপ্তডিঙা। কথাটা শুনলেই মনে আসে বাঙালির সমুদ্রবাণিজ্যের এক গৌরবময় ইতিহাস। গৌড়ের বণিকরা সাতটি বিশাল নৌকার এই সমবায় নিয়ে সিংহল, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, চীন, রোম, গ্রীস, ক্রীট, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করে ফিরে আসতেন স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার নিয়ে। সপ্তডিঙা তাই বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির অভিজ্ঞান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Advertisingspot_img

Popular posts

My favorites