Monday, December 23, 2024
Homeবাঙালির ইতিহাসরাক্ষসীডাঙাঃ প্রাচীন গৌড়ের বিস্মৃত বৌদ্ধবিহার

রাক্ষসীডাঙাঃ প্রাচীন গৌড়ের বিস্মৃত বৌদ্ধবিহার

বিধাতার একি পরিহাস! কর্ণসুবর্ণ মহানগরী আজ বিস্মৃতির আড়ালে তলিয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপের মাঝে মৃত্যুপ্রহর গুনছে মহানগরীর বিভিন্ন পুরাতাত্ত্বিক স্মৃতি। প্রাচীন কর্ণসুবর্ণ মহানগরীর উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলির মধ্যে রাক্ষসীডাঙা অন্যতম। লিখেছেন- রামকৃষ্ণ বড়াল

ভূমিকা

খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের শেষ দিকে অথবা সপ্তম শতকের শুরুতে গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের আমলে মুর্শিদাবাদ জেলার কর্ণসুবর্ণকে কেন্দ্র করে উত্তর পশ্চিমে কনৌজ-বারানসী থেকে পূর্বে কামরূপ সীমানা এবং দক্ষিনে ওড্র প্রদেশের ভুবনেশ্বর পর্যন্ত এক বিশাল বাঙালী সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। বিশাল ভুখণ্ড জুড়ে উড়েছিল বাঙালী জাত্যাভিমানের জয়ধ্বজা। মেদিনীপুর জেলায় প্রাপ্ত এগরা তাম্রশাসনের একটি পদে লেখা আছে, ‘পৃথিব্যাং পরমদৈবৎ-শ্রীপরমভট্টারক-মহারাজাধিরাজ-পরমমাহেশ্বর শ্রীশশাঙ্কদেবো রাজ্যং প্রশাসতি স্ম।’ বড় বড় সার্বভৌম নরপতি বা সম্রাটরাই মহারাজাধিরাজ উপাধী ধারন করতেন। হিউ-এন-সাঙের বিবরণীতে তৎকালীন ভারতের বিভিন্ন রাজধানীর পরিধি নির্ধারিত হয়েছে। সেটার উপর ভিত্তি করেই বলা যায় শশাঙ্কের সার্বভৌমত্ব খুব কম করে হলেও ৩১,১৫০ লি(থমাস ওয়াটারস্ অনুদিত বইতে শুধুমাত্র কর্ণসুবর্ণ মহানগরীর পরিধি ৪৫০০ লি) ক্ষেত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। অত্যন্ত জ্ঞানী বা পণ্ডিত নরপতি হওয়াই ‘পরমভট্টারক’ বিশেষনটি ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর ধর্মজীবন সংক্রান্ত বিশেষন গুলি হল পরমদৈবৎ অর্থাৎ দেবতাদের ভক্ত এবং পরমমাহেশ্বর অর্থাৎ শিবের উপাসক। শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ ছিল তৎকালীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ মহানগরী। কিন্তু হায়! বিধাতার একি পরিহাস! সেই কর্ণসুবর্ণ মহানগরী আজ বিস্মৃতির আড়ালে তলিয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপের মাঝে মৃত্যুপ্রহর গুনছে মহানগরীর বিভিন্ন পুরাতাত্ত্বিক স্মৃতি। প্রাচীন কর্ণসুবর্ণ মহানগরীর উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান গুলির মধ্যে রাক্ষসীডাঙা অন্যতম।

রাক্ষসীডাঙার অবস্থান

মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর বহরমপুর থেকে প্রায় ছয় মাইল দক্ষিনে ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে প্রাচীন কর্ণসুবর্ণ অবস্থিত। চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙের বিবরন অনুযায়ী কি-য়ে-লো-না-সু-ফা-লা-না বা কর্ণসুবর্ণের রাজপ্রাসাদের নিকটেই ছিল লো-টো-বী-চী বা রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার। কর্ণসুবর্ণের একাধিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থলের মধ্যে রাজবাড়ীডাঙা অন্যতম। যদুপুর বাস ডিপোর নিকটেই রয়েছে রাজবাড়ীডাঙা। রাজবাড়ীডাঙা ঢিবিটি সমতল কৃষিক্ষেত্র থেকে প্রায় ১২-১৪ ফুট উঁচু। ঢিবিটির আয়তন প্রায় ৫,০৩,৫০০ বর্গফুট। রাজবাড়ীডাঙার উপরেই রয়েছে প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ। রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের প্রত্নস্থল থেকে রামনগর ঘাট রোড ধরে সোজা দক্ষিনে প্রায় ৪০০ মিটার এগানোর পরে রাস্তা থেকে পশ্চিমদিকে  আরও প্রায় ২০০ মিটার এগিয়ে গেলে একটি স্বর্ণাভ হলুদ বর্নের উচ্চঢিবি দৃশ্যমান হবে। ঐ স্বর্ণাভ হলুদ বর্ণের ঢিবিটিই স্থানীয় লোকের কাছে রাক্ষসীডাঙা নামে পরিচিত। রাক্ষসীডাঙা বর্তমানে চাঁদপাড়া মৌজার প্রতাপপুর গ্রামে অবস্থিত।

 

রাক্ষসীডাঙার আকার-আয়তন ও ভূপ্রকৃতি 

রাক্ষসীডাঙা ঢিবিটি ভাগীরথীর জলস্তর থেকে প্রায় ৫০ ফুট উঁচু। চারিপাশের শষ্যক্ষেত থেকে প্রায় ২৫ ফুট উঁচু। ঢিবিটির পরিধি প্রায় ৭০০ মিটার। ঢিবিটি চারদিক থেকে সন্নাসীডাঙা, রাজবাড়ীডাঙা, ভীমকিতলা এবং নীলকুঠিঢিবি দ্বারা পরিবৃত।  ঢিবির পূর্ব সীমায় রয়েছে ভাগরথী নদী। পশ্চিমে রয়েছে কর্ণসুবর্ণ রেলওয়ে স্টেশান। কর্ণসুবর্ণ স্টেশানের পূর্বনাম ছিল চিরুতি। ১৯৬২ সালের রাজবাড়ীডাঙার খননকার্যের সময় কর্ণসুবর্ণ মহাবিহার বা রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের ধ্বংসস্তূপের অস্তিত্ব প্রমানিত হবার পরে চিরুতি রেলওয়ে স্টেশানের নাম রাখা হয় কর্ণসুবর্ণ। ঢিবির নীচে পূর্বদিকে রয়েছে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ। বটগাছের শীতল ছায়ায় শায়িত আছে পীর তুর্কান সাহেবের সমাধি। পূর্বে সমাধিটি একটি খড়ের ছাউনির কুটিরে রাখা ছিল। বর্তমানে সমাধিটি পাকা ইঁটের গাঁথনি দেওয়া মাজারের মধ্যে রাখা আছে। মাজারের উত্তরদিকে একটি ইঁট নির্মিত চওড়া ভিত্তি দেখা যায়। খুব সম্ভবত সেখানে একটা মসজিদ নির্মিত হচ্ছিল যার কাজ মাঝ পথে বন্ধ হয়েগেছে। রাক্ষসীডাঙার নিকটেই রয়েছে পীর পুকুর। মাজারের পূর্বদিকে একটা ছোট্ট প্রাঙ্গণ রয়েছে। প্রাঙ্গণের মাঝে একটা সুপ্রশস্থ গুঁড়ি যুক্ত তেঁতুল গাছ রয়েছে। গাছের গোঁড়াটা বাঁধিয়ে বসার জায়গা বানানো হয়েছে। মাজারকে কেন্দ্র করে তুর্কান সাহেবের নামে কয়েক বিঘা জমি আছে। প্রতিবছর ২রা বৈশাখ এখানে উরস উৎসব পালিত হয়। উরস উপলক্ষের তুর্কান সাহেবের জমিতে একদিনের মেলা বসে। মেলাতে ২৫০০-৩০০০ লোকের সমাগম হয়। মেলার মূল মঞ্চে সারাদিন ধরে চলে বাউল, পঞ্চরস সহ নানান গানের অনুষ্ঠান। মেলা ও গানের আসর দিনেই বসে। মাঝে মাঝে পীরের ভক্তরা এসে শিন্নি দেন। মাজারের চারিদিকে ঝুলে রয়েছে বটগাছের একাধিক ঝুড়ি। অধিকাংশই মাটি ভেদ করে গভীরে প্রবেশ করেছে। কিছু কিছু ঝুড়িতে লাল, সবুজ প্রভৃতি রঙের ফিতে বাঁধা আছে। আর স্থানে স্থানে ছড়ানো রয়েছে কালো ও লাল রঙের পোড়ামাটির প্রদীপ, ঘোড়া ইত্যাদি। ঢিবির পশ্চিম ও উত্তর দিকে রয়েছে ধানক্ষেত। ধানক্ষেতের আকার বাড়ার সাথে সাথে কালের সাথে তাল মিলিয়ে কমে যাচ্ছে রাক্ষসীডাঙার আয়তন। চুরি হয়ে যায় প্রাচীন স্থাপত্যের ইঁট ও অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান।

রাক্ষসীডাঙার সাথে জড়িত বিভিন্ন লোকগাথা

রাজবাড়ীডাঙার নিকটস্থ রাক্ষসীডাঙা ঢিবিটি চাঁদপাড়া মৌজার প্রতাপপুর গ্রামে অবস্থিত। কর্ণসুবর্ণ নামের সাথে জড়িত বিভিন্ন জনশ্রুতির ন্যায় রাক্ষসীডাঙার সাথেও জড়িত আছে একাধিক লোকগাঁথা।

 

ভীমসেন-বক রাক্ষসের জনশ্রুতি :- রক্ষসীডাঙার নিকটেই রয়েছে ভীমকিতলা। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী মহাকবি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস উল্লিখিত মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবেরা তাদের অজ্ঞাতবাসের কোন এক সময়ে এখানে বসবাস করতেন। সেখান থেকেই ভিমকীতলা নামটি এসেছে। রাক্ষসীঢিবির নিকটেই দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেনের সাথে বক রাক্ষসের যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে ভীমসেন বক রাক্ষসকে হত্যা করে তার দেহ এবং ছিন্ন মুণ্ড ছুঁড়ে ফেলে দেন। রাক্ষসের দেহ যে স্থানে পড়েছিল সেই স্থানটির নাম হয় রাক্ষসীডাঙা। রাক্ষসের মুণ্ডটি পরেছিল চৈতি বিলের জলে। রাঙামাটি কর্ণসুবর্ণের প্রান্তভাগস্থিত মাঝিরা গ্রামে রয়েছে চৈতি বিল। ঐ গ্রামে মাঝি-মাল্লাদের বাস ছিল। সেখান থেকে মাঝিয়ারা বা মাঝিপাড়া নামটা এসেছে পরবর্তী কালের নাম পরিবর্তিত হয়ে মাঝিরা হয়েছে। স্থানীয় কিছু মানুষের বিশ্বাস রাক্ষসীডাঙার উচ্চঢিবি বক রাক্ষসের দেহাংশ। বাস্তবতার দিক থেকে দেখতে গেলে এমন গল্পকথা বিশ্বাসের করার মধ্যে কোন যৌক্তিকতা নেই। হতে পারে কোন এক সময়ে ঐ এলাকার মানুষের মধ্যে মহাভারতের গল্পগাঁথা খুব প্রচলিত ছিল। মহাভারতের অন্যতম নায়ক ভীমের বীরত্ব স্থানীয় জনমানষে কালজ্বয়ী করে রাখার জন্যই হয়ত ভীমকিতলা রাক্ষসীডাঙা প্রভৃতি নামকরণ করা হয়েছে। আর সেই পরম্পরা আজও চলছে।

 

পীর তুর্কান সাহেবের জনশ্রুতি :- অপর একটি গল্পকথা স্থানীয় জনমানষে বেশ প্রচলিত আছে। কর্ণসুবর্ণের রাজা তারা পুত্রের অন্নপ্রাশনের সময় সিংহলের রাজাকে নিমন্ত্রণ করেন। সিংহলের রাজার সাথে ৭ জন রাক্ষসী আসেন কর্ণসুবর্ণরাজের আমন্ত্রন গ্রহন করতে। ভোজসভায় খেতে বসার সময় সিংহলরাজ একজন রাক্ষসীর অনুপুস্থিতি টের পান। কর্ণসুবর্ণরাজের আদেশে চারিদিকে অনুসন্ধান শুরু হয়। রক্ষসীকে খুঁজে পাবার পরে খেতে বসার জন্য অনুরোধ জানালে রাক্ষসী তার দাবি সুস্পষ্ঠ করে। সে জানাই খাদ্যের জন্য প্রতিদিন একটা করে জীবন্ত মানুষের প্রয়োজন। পাশাপাশি রাক্ষসী এই শর্তও আরোপ যে করে প্রতিদিন তার সামনে উপস্থিত হওয়া মানুষটির সাথে সে তর্কযুদ্ধ করবে, কোন মানুষ যদি তাকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করতে পারে তবে সে কর্ণসুবর্ণ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবে আর যতদিন তাকে কেউ তর্কযুদ্ধে পরাজিত করতে পারবে না ততদিন সে একটা করে মানুষ ভক্ষন করবে। অতিথির সম্মানার্থে কর্ণসুবর্ণরাজ রাক্ষসীর শর্ত মেনে নিলেন। প্রতিদিন রাজ্যের একটা করে পণ্ডিত ব্যক্তিকে রাক্ষসীর সাথে তর্কযুদ্ধের জন্য পাঠাতেন। রাক্ষসী তাদেরকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করে ভক্ষন করত। বেশকিছু পণ্ডিত রাক্ষসীর শিকার হওয়াই কর্ণসুবর্ণরাজ পরলেন মহা চিন্তায়। কিছুকাল পরে কর্ণসুবর্ণে পীর তুর্কান সাহেবের উদয় হয়। তিনি কর্ণসুবর্ণরাজের অনুমতি নিয়ে গেলেন রাক্ষসীর সাথে তর্কযুদ্ধ করতে। রাক্ষসীকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করে হত্যা করলেন তারপরে এক বিশাল বৃক্ষের নীচে বসবাস করতে থাকলেন। সেখানেই তিনি আমৃত্যু বসবাস করেন। পীর তুর্কান সাহেবের মৃত্যুর পরে ঐ স্থানেই  তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তুর্কান সাহেবের সমাধির পাশের উচ্চ রাঙামাটির ঢিবিটির নাম রাক্ষসীডাঙা। স্থানীয় মানুষের একাংশের মতে ঐ ঢিবিতেই পীর তুর্কান সাহেব রাক্ষসীকে হত্যা করার পরে পুঁতে ফেলেছিলেন। সেই সূত্রে ঢিবিটির নাম রাক্ষসীডাঙা। পীর তুর্কান সাহেবের ঘটনাটি বঙ্গদেশে ইসলাম আগমনের পরের ঘটনা বলেই অনুমিত হয়। সেক্ষেত্রে ঘটনার প্রাচীনত্ব খ্রীস্টীয় দ্বাদশ শতকের শেষ বা ত্রয়োদশ শতকের আগে নয়। হতে পারে তুর্কান সাহেব কোন জঙ্গলবাসী মানুষ খেঁকো বিশালাকায় জন্তুকে হত্যা করেছিলেন বা কোন নরখাদক বনমানুষকে হত্যা করেছিলেন যাকে রাক্ষসী রূপে উল্লেখ করা হয়েছে যা পরবর্তীকালে লোকগাঁথায় পরিনত হয়েছে।  বাস্তবতার দৃষ্টিতে দেখতে গেলে তুর্কান সাহেবের রাক্ষস হত্যার কাহিনীটাও অলৌকিক প্রতীয়মান হয় যা ইতিহাস সমর্থিত কোন ঘটনা নয়।

★ অপর একটি মতে পালরাজ মহীপালদেবের রাজধানী মহীপাল নগরে একখণ্ড পাথরে শিং যুক্ত হাতির ন্যায় জন্তুর মূর্তি খোদিত আছে। স্থানীয় লোক তাকে রাক্ষসের দেহ বলে থাকেন আবার নীলকুঠিঢিবির প্রাঙ্গণস্থিত এডওয়ার্ড ক্লোজের সমাধি প্রস্তরখণ্ড টিকেও স্থানীয় মানুষেরা রাক্ষসের দেহ বলে থাকেন। বৃহৎ বৃহৎ প্রস্তরখণ্ডের উপস্থিতির কারনে রাক্ষসীডাঙা নামটা আসতে পারে।

★ বৌদ্ধ স্থপতিকলায় নানা ধরনের অস্বাভাবিক ভয়ালদর্শন মূর্তির দেখা মেলে। স্থানটিতে তেমনই ভয়ালদর্শন মূর্তির আধিক্য ছিল। ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দের খননকার্যের ফলে বেশকিছু ভয়ালদর্শন ভগ্ন মূর্তি পাওয়া গেছিল। সেই সূত্রে ঢিবিটির নাম রাক্ষসীঢিবি বা রাক্ষসীডাঙা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

রাক্ষসীডাঙার সাথে একাধিক জনশ্রুতি জড়িত থাকলেও পীর তুর্কান সাহেবের জনশ্রুতিটিই স্থানীয় জনমানষে অধিক প্রচলিত।

রাক্ষসীডাঙার খননকার্য 

কর্ণসুবর্ণ এবং তার আশে পাশের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল গুলি হল রাক্ষসীডাঙা, রাজবাড়ীডাঙা, ঠাকুরবাড়ীডাঙা, সন্ন্যাসীডাঙা, নীলকুঠিঢিবি, ভীমকিতলা, ডাবকই, আঁরোয়া, মধুপুর, গোবিন্দপুর, সংস্কার, মাঝিরা, শুক্রডাঙা, হাতিবাঁধা, কুঁড়াপাড়া, চিরুতি প্রভৃতি। আজ পর্যন্ত কর্ণসুবর্ণের তিনটি জায়গায় উৎখনন হয়েছে। ঐ স্থান গুলি হল রাজবাড়ীডাঙা, রাক্ষসীডাঙা এবং নীলকুঠিঢিবি। কর্ণসুবর্ণ রেলওয়ে স্টেশানের পশ্চিমপাড়ে রয়েছে মধুপুর গ্রাম। এখানেই রয়েছে বর্তমান পাঠাগারটি। এই গ্রামের ভূমিতেই নির্মিত হয়েছে মধুপুর রাজা শশাঙ্ক বিদ্যাপীঠ। ঐ স্কুলেরই একজন শিক্ষক ছিলেন শ্রী শ্রী মৃণাল গুপ্ত মহাশয়। স্কুল নির্মানের জন্য মাটি খোঁড়ার সময় মাটির নীচ থেকে উঠে আসতে থাকে একাধিক প্রত্নদ্রব্যাদি। উৎখননের ফলে বিপুল পরিমানে প্রাচীন ইঁট পাথর ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, গুপ্তযুগের চুনাবালি নির্মিত একটি নারীমূর্তির মুখ উঠে আসে। এর পরে কর্ণসুবর্ণের একাধিক অঞ্চলে অনুসন্ধান চালিয়ে মৃণাল বাবু পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকের দুষ্প্রাপ্য ‘লকুলিশ’ মূর্তি, নবম-দশম শতকের ‘বৌদ্ধতারা’ মূর্তি ও বেশ কিছু শীলমোহর উদ্ধার করেন। তাঁর উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ ১৯৬২ খ্রীষ্টাব্দে সুধীর রঞ্জন দাশ মহাশয়ের নেতৃত্বে কর্ণসুবর্ণ উৎখননে আগ্রহী হয়। এর আগে ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষনের পূর্বাঞ্চলীয় শাখা মুর্শিদাবাদের জেলা জজ মিস্টার এইচ. বেভারিজ সাহেবের পরামর্শে কে.এন. দীক্ষিতের নেতৃত্বে রাক্ষসীডাঙায় খননকার্য চালাই। কলকাতা রাজ্য প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সহ-অধিকর্তা অমলবাবু বলেন, “ঢিবি দেখে চতুষ্কোণ বা বর্গাকার স্থাপত্যের নির্দশন পাওয়া যাবে, এই অনুমানের ভিত্তিতে প্রথম বার উৎখনন কার্য চালানো হয়েছিল। তাতে ইঁটের স্থাপত্যের দক্ষিণ দিকের প্রায় পুরো দেওয়াল চিহ্নিত বা উন্মোচিত হয়েছে।” ঐ খননকার্যের প্রতিবেদনটি ১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বেভারিজ সাহেবই সর্বপ্রথম রাক্ষসীডাঙাকে চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙের ভ্রমনবৃত্তান্ত সি-য়ু-কি বর্ণিত রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার ও সন্নিহিত কর্ণসুবর্ণ মহানগরীর অবস্থানক্ষেত্র বলে সনাক্ত করেন। পরের খননকার্যটি সংঘটিত হয় ২০১০ সালের ২২শে মার্চ। এটি পরিচালনা করেছিল ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষন দপ্তর এবং রাজ্য পুরাতত্ত্ব দপ্তরের কলকাতা মণ্ডল। দুটি দপ্তর যুগ্মভাবে চাঁদপাড়ার প্রতাপপুরে খননকার্য চালনা করেছিল।

রাক্ষসীডাঙায় খননকার্যে প্রাপ্ত নিদর্শন

প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সংগ্রহের জন্য ২৫ ফুট উচ্চ ঢিবিটির নানান অংশে বিভিন্ন মাপের গর্ত খোঁড়া হয়েছিল। এর মধ্যে কোন কোন গর্ত ১৮ ফুট গভীর ছিল। উৎখননে প্রাপ্ত উপাদান গুলি নিম্নলিখিত…

★ খননকার্যের ফলে তিনটি যুগের ঘর-বাড়ির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের সহ-অধিকর্তা অমল বাবু বলেন, “গুপ্তযুগের শেষ পর্যায়ের ইট অপেক্ষাকৃত বড় এবং সুন্দর ভাবে পোড়ানো, শশাঙ্কের আমলে বা সপ্তম শতাব্দীর ইট অপেক্ষাকৃত ছোট আর পাল-সেন যুগের ইট আরও ছোট।” তিনি আরও বলেন, “২০০৯-১০ সালে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ এবং রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতর যৌথ ভাবে খননকার্য চালিয়ে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতকের ইটের স্থাপত্য ঘর ও প্রবেশ দ্বার চিহ্নিত করেছে, যা গুপ্ত যুগের শেষ দিকের এবং শশাঙ্কের সময় কালের। মূল কাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনের তাগিদে ওই স্থাপত্য পরিবর্ধন বা পরিমার্জন করার ফলে তিন ধরনের ইঁটই সেখানে দেখতে পাওয়া যায়।”

★ উপরের দিক থেকে ৬ ফুট গভীরে বিচ্ছিন্ন মেঝে, বাঁধান জায়গা এবং ইঁটের দেওয়ালের অবশেষ পাওয়া গেছে। নিশ্চিৎরূপে এগুলি সপ্তম শতকের পরবর্তী কালের নির্মিত অর্থাৎ শশাঙ্ক পরবর্তী কালের স্থাপত্য। ঐ একই স্তরে প্রাচীনতর যুগের চুনাবালি(স্টাকো), পোড়ামাটি(টেরাকোটা) এবং বিভিন্ন ধরনের অলঙ্করনযুক্ত মূর্তি ও মূর্তির ভগ্নাংশ পাওয়া গেছে। ঐ স্থান থেকে দীর্ঘদিন ধরে  ইঁট চুরি করে নিয়ে যাওয়া এবং অন্যান্য সম্পদের লোভে দুষ্কৃতিদের আনাগোনার ফলেই হয়ত এমনটা ঘটেছে। এক স্তরের প্রত্নদ্রব্যাদি অন্যস্তরে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে।

★ সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সৌধটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে উপর থেকে ৯-১৩ ফুট গভীরে।

এই স্তরে প্রাপ্ত ইঁট গুলির আয়তন ১৫.৫”x১০”x২.৫”। এই স্তরে সৌধটির গঠন এবং প্রাপ্ত দ্রব্যাদি প্রমান করে এটির নির্মাণ কাল ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোন এক সময়ের। পরাক্রমশালী গৌড়রাজ মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কদেবের আমলে এটি নির্মিত হওয়ার একাধিক সম্ভবনা রয়েছে।

★ একটি প্রশস্থ কেন্দ্রীয় দেওয়ালের দুপাশে কয়েকটি বিশালাকায় ঘরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। উত্তর-পূর্ব দিকে রয়েছে একটি দালান যুক্ত দীর্ঘ কক্ষ। দক্ষিন-পশ্চিম দিকেও রয়েছে কয়েকটি অসংলগ্ন দেওয়ালের ধ্বংসাবশেষ। মেঝে গুলির অবস্থান ঢিবি শীর্ষ থেকে ১২-১৩ ফুট গভীরে। দেওয়াল গুলির ভিত্তি চলে গেছে মাটির ২৩ ফুট গভীর পর্যন্ত। নিঃসন্দেহের এগুলি প্রাক শশাঙ্কযুগের অর্থাৎ গুপ্ত বা মৌর্য্য যুগের নির্মিত হবার সম্ভবনা আছে।

★ খননকার্যের ফলে ২৯২ টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগৃহীত হয়। তার মধ্যে ৯৫ টি চূনাবালি নির্মিত গোটা ও ভাঙা মূর্তি। একটা ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি বা অমিতাভ(অমিত আভা যার) পাওয়া গেছে। চূনাবালি নির্মিত মস্তক গুলির মধ্যে ৫-৬ টা বুদ্ধের মূর্তি। স্টাকো হেড গুলির মুখমণ্ডলের ভঙ্গিমা এবং উৎকর্ষতা এতটাই বেশি ছিল যে অষ্টম শতকের শেষভাগ বা নবম শতকের শুরুতে পাল সম্রাট ধর্মপাল নির্মিত পাহারপুর বা সোমপুর বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত চুনাবালির বৌদ্ধমূর্তি গুলিও ম্লান হয়ে যেত। প্রাপ্ত অন্যান্য নিদর্শন গুলির মধ্যে আছে পোড়ামাটির খেলনা, মৃৎপাত্র, কিছু ভীষনদর্শন অস্বাভাবিক মূর্তি।

★ মাটি খুঁড়তে গিয়ে একটি ভগ্ন বুদ্ধ মূর্তির সঙ্গে ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের যে লিপিটি উদ্ধার করা হয়েছে, দক্ষিণবঙ্গে তা বিরল। এর আগে উত্তরবঙ্গের কোথাও কোথাও ব্রাহ্মীতে লেখা সেই সংস্কৃত মন্ত্রটি অবশ্য পাওয়া গিয়েছে। মুর্শিদাবাদের পার্শ্ববর্তী মালদহেও ধাতু নির্মিত বুদ্ধমূর্তির পিছনে এই মন্ত্র পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু তা-ও ছিল অষ্টম শতাব্দীর। পুরাতাত্ত্বিকেরা জানাচ্ছেন, দক্ষিণবঙ্গে এমনিতেই বুদ্ধ মূর্তি কম পাওয়া গিয়েছে। শুধু তাই নয়, এই লেখ-টি থেকে সমসাময়িক ইতিহাস সম্পর্কেও নতুন আলোকপাত সম্ভব বলে পুরাতাত্ত্বিকেরা মনে করেন। রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের উপ-অধিকর্তা অমল রায় বলেন, “দক্ষিণবঙ্গে এত পুরনো লেখ আমরা কমই পেয়েছি। কর্ণসুবর্ণ অঞ্চল সে সময়ে রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। গুপ্ত যুগের পরপরই শশাঙ্কের আমলের কাছাকাছি সময়ে তাঁর রাজধানী কর্ণসুবর্ণ এলাকায় বৌদ্ধরাও যে ছিলেন, তার একটা প্রমাণ এই মূর্তি থেকে পাওয়া গেল।”
ধ্বংসাবশেষ সম্বন্ধে ধারনা

♦ পোড়ামাটির মূর্তি গুলির উপস্থাপনা ও নিখুঁত নির্মাণশৈলী প্রমান করে ঐগুলি গুপ্ত যুগের শেষ দিকে বানানো।

♦ ধ্যানমগ্ন বৌদ্ধমূর্তি বা অমিতাভ মূর্তির উপস্থিতি প্রমান করে ঐ স্থানে মহাযান বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আনাগোনা ছিল।

♦ ঢিবির শীর্ষদেশ থেকে ৬-২৩ ফুট গভীরতায় তিনটি যুগের ইঁট এবং অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের অস্তিত্ব মিলেছে। এটা থেকে পরিষ্কার যে গুপ্ত অথবা মৌর্য্য যুগে প্রতিষ্ঠিত স্থাপত্যের একাধিকবার পূনঃনির্মান করা হয়েছিল। অর্থাৎ প্রাক শশাঙ্ক যুগের অট্টালিকাগুলি শশাঙ্ক যুগে ও পরবর্তী শশাঙ্ক যুগে নবনির্মিত হয়েছিল।

♦ খননকার্যের ফলে পোড়ামাটির ঘোড়া, হাতি, ময়ূরের মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছিল। কিছু দেওয়ালের ভগ্নাংশ থেকে ৭.৫-৯”x৬”x১.৫” আয়তনের ইঁট পাওয়া গেছিল। একটা দেওয়ালের সজ্জা থেকে ১০মিটারx৮মিটার মাপের তিনটি ঘরের সন্ধান পাওয়া গেছিল। ঐ ঘর গুলির প্রবেশ পথ উন্মুক্ত ছিল। একটি অনুজ্জ্বল কাদামাটির পাত্র, বাটি ও শসপ্যান সদৃশ কিছু  বাসনপত্রের ভগ্নাংশ, প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত লৌহ ও তাম্র নির্মিত বাসনপত্রের কিছু নমুনা পাওয়া গেছিল। পোড়ামাটির শীলে তৃতীয় শতকের কিছু ব্রাহ্মী লিপি খোদিত ছিল। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি দপ্তরের কর্মী শ্রীমতী সুস্মিতা বসু মজুমদারের মতে ঐ শীল গুলি খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকের শীল যা কোন রাজকীয় শীল ছিলনা। তিনটে দেব বিগ্রহের মস্তক পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে ঐ মস্তক গুলি অন্য কোন মূর্তির অংশ নয়। ওগুলি মস্তক মূর্তি হিসেবেই পূজিত হত। রাজ্য প্রত্নতাত্ত্বিক দপ্তরের কর্মী অমল বাবুর মতে ঐ মস্তকগুলি কোন দেব-দেবীর তা এখনও জানা যায়নি। রাক্ষসীডাঙা থেকে ৩৫ কিমি দূরে অবস্থিত প্রত্নস্থল ডেকায় প্রাপ্ত প্রত্নদ্রব্য গুলিও শশাঙ্কের রাজধানী মহানগরী কর্ণসুবর্ণে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সাথে সাদৃশ্যপূর্ন হওয়ায় অমল বাবু মনে করেন ডেকাও কর্ণসুবর্ণ মহানগরীর অংশ ছিল।

♦ পরীক্ষামূলক উৎখননে প্রাপ্ত প্রত্নদ্রব্যাদি প্রমান করে রাক্ষসীডাঙায় বৌদ্ধধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিশেষত বৌদ্ধমঠ বা বৌদ্ধবিহারের অস্তিত্ব ছিল যার বিকাশ ঘটেছিল মৌর্য্য অথবা গুপ্তযুগ থেকে পরবর্তী শশাঙ্ক যুগ পর্যন্ত।

♦ প্রকৃতপক্ষে রাক্ষসীডাঙায় যে ক্ষুদ্র পরিসরে উৎখনন হয়েছে তাতে ঢিবি ও তার আশেপাশের জায়গা থেকে যে পরিমান প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান পাওয়া গেছে সেটা অপর্যাপ্ত। সঠিক ইতিহাস ও প্রচীনত্ব জানতে আরও খননকার্যের প্রয়োজন আছে।

রাক্ষসীডাঙাই কি অশোক নির্মিত বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ?

‌মৌর্য্যসম্রাট দেবানমপ্রিয় প্রিয়দর্শী অশোক ভারতবর্ষে ৮৪০০০ বৌদ্ধ স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙ ৬২৯ খ্রীষ্টাব্দে ভারতে অসেন। তিনি স্থানেশ্বরের পষ্যুভূতি বংশীয় রাজা হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ভ্রমন করতে করতে ৬৩৮ খ্রীস্টাব্দে ৭০০ লি পথ পেরিয়ে তাম্রলিপ্তি থেকে কর্ণসুবর্ণ মহানগরীতে পৌঁছান। তাঁর বিরবন অনুযায়ী কর্ণসুবর্ণ মহানগরীর রাজপ্রাসাদ ২০ লি পরিধি বিশিষ্ট ক্ষেত্রের উপর অবস্থিত ছিল। মহানগরী কর্ণসুবর্ণ ঘনবসতিপূর্ন ছিল। উর্বর ও নিম্নভূমি গুলিতে ফসলের প্রাচুর্য ছিল। অধিবাসীরা অর্থনৈতিকভাবে বৃত্তশালী, জ্ঞান পিপাসু, পরিশ্রমী, সৎ ও আময়িক ছিল। মহানগরীর ভেতরে ১৪ টি সঙ্ঘরাম ও ৫০ টি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দেবমন্দিরের অস্তিত্ব ছিল। এর মধ্যে তিনটি সঙ্ঘরামে গৌতম বুদ্ধের বৈমাত্রেয় ভাই দেবদত্তের অনুগামীরা থাকত। তারা মাখন, ক্ষীর প্রভৃতি দুগ্ধজাত দ্রব্য ভক্ষন করতো না। সঙ্ঘরাম গুলিতে ২০০০ বৌদ্ধ শ্রমন বাস করতেন। রাজপ্রাসাদের সন্নিকটে প্রখ্যাত রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। মহাবিহারটির সভাগৃহ ছিল সুপ্রশস্থ ও আলোকোজ্জ্বল। এর বুরুজ ও চূড়া ছিল অত্যুচ্চ। সম্রাট অশোক নির্মিত বৌদ্ধস্তূপটি এই মহাবিহারের নিকটেই ছিল। তার পাশেই ছিল আরও একটি বৌদ্ধবিহার। তথাগত বুদ্ধ বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে এসে এখানেই সাত দিন কাটিয়েছিল। যে সব জায়গায় থেকে বুদ্ধদেব ধর্ম প্রচার করেছিলেন মহামতি অশোক সেই সমস্ত জায়গায় বৌদ্ধস্তূপ নির্মান করেছিলেন। কর্ণসুবর্ণতে অশোক নির্মিত চারটে বৌদ্ধস্তূপের কথা হিউ-এন-সাঙ বলেছেন। মুর্শিদাবাদের ভূতপূর্ব ইঞ্জিনীয়ার ক্যাপ্টেন লেয়ার্ড সাহেব রাক্ষসীডাঙাকে হিউ-সাঙ-বর্নিত কর্ণসুবর্ণ মহাবিহার বা রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের প্রত্নস্থল বলে অনুমান করেছিলের কিন্তু রাক্ষসীডাঙার ১৯২৮ খ্রীস্টাব্দের খননকার্যে তেমন কোন প্রমান মেলেনি যার দ্বারা নিশ্চিৎরূপে বলা যায় যে এটাই রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার। এর বহুকাল পরে সুধীর রঞ্জন দাস মহাশয় মৃনাল বাবুর আমন্ত্রন পেয়ে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের অনুসন্ধানে কর্ণসুবর্ণের রাজবাড়ীডাঙায় উৎখননে আগ্রহী হন। পাশাপাশি তিনি এটাও জানতে পারেন মুর্শিদাবাদের সাটুই গ্রামের সন্তোষ সেনের নিকট একটা প্রাচীন ভগ্নমূর্তি আছে। তিনি সন্তোষ সেনের সাথে যোগাযোগ করে সাটুই চৌরীগাছা রেলওয়ে স্টেশান সংলগ্ন কামরায় গিয়ে মূর্তিটি পরিদর্শন করেন এবং বিস্মিত হন। এটা ছিল অবিকল সেই মূর্তি যেটা লেয়ার্ড সাহেব ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশ করেছিলেন। ঐ মূর্তিটি ছিল অষ্টভূজা মহিষমর্দিনী মূর্তি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ সন্তোষ সেনের কাছ থেকে অষ্টভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তিটি অধিগ্রহন করে। মূর্তিটি বর্তমানে কলকাতার হাজরা রোডের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগীয় কার্যালয়ে রক্ষিত আছে। ভীমকিতলার নিকটস্থ শুষ্ক যমুনা পুষ্করিনীর উৎখনননের ফলে মূর্তিটি পাওয়া গেছিল। সেটি রাক্ষসীডাঙার বটতলায় রাখা ছিল। সাটুই রাজেন্দ্র নারায়ন হাইস্কুল ও চৌরীগাছা স্টেশান সংলগ্ন একটা উচ্চঢিবি আজও সাটুই কামরা নামে পরিচিত। ঐ কামরায় থাকতেন মাখন বাবু। উনার চৌরীগাছা রেলওয়ে স্টেশানের পাড়ে ৩০০ বিঘা জমি ছিল। জমি ও ব্যবসার হিসাব দেখার জন্য উনি সন্তোষ সেন মহাশয়কে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। কলকাতাবাসী সন্তোষ বাবু কর্মসূত্রে সাটুয়ে থাকতেন। উনিই রাক্ষসীডাঙা থেকে অষ্টভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তিটি তুলে এনে সাটুই কামরায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সন্তোষ বাবু ও মৃনাল বাবুর সাথে যোগাযোগ করার পরেই সুধীর রঞ্জন বাবু রাজবাড়িডাঙায় ১৯৬২ সালে পরীক্ষামূলক উৎখনন চালান। এর পরে ১৯৬৪ এবং ১৯৭৯ খ্রীষ্টব্দে উৎখনন চালান হয়। প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান রাজবাড়ীডাঙাকে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের প্রত্নস্থল হিসেবে চিহ্নিত করে। রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের পত্নস্থল চিহ্নিত হবার পর অনুসন্ধান চালানো হয় শশাঙ্কের রাজপ্রাসাদ ও হিউ-এন-সাঙ বর্নিত অশোক নির্মিত স্তূপ গুলির। রাজপ্রাসাদ এবং অশোক নির্মিত স্তূপ কোনটিরই সন্ধান পাওয়া যায়নি। অনেকের মতে কর্ণসুবর্ণ রাজপ্রসাদ কালের স্রোতে ভাগীরথী গর্ভে তলিয়ে গেছে। রাক্ষসীডাঙায় যে বৌদ্ধস্তূপের ধ্বংসাবশেষ মিলেছে সেটিকে বেভারিজ সাহেব কর্ণসুবর্ণ বা রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের প্রত্নস্থল রূপে অনুমান করেছিলেন। রাজবাড়ীডাঙায় ১৯৬২ খ্রীষ্টাব্দের খননকার্যের তাঁর ধারনাটি ভুল প্রমানিত হয়। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় আবার অন্যরকম ধারনা পোষন করেন। তিনি রাক্ষসীডাঙাস্থিত বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসবশেষটিকে অশোক নির্মিত চারটি স্তূপের একটি বলে মনে করেন। হিউ-এন-সাঙের বিবরনে তেমনটাই বলা আছে যে রাজপ্রাসাদের নিকটেই ছিল রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার। তার নিকটেই ছিল অশোক নির্মিত একটি বৌদ্ধবিহার। রাজবাড়ীডাঙায় প্রাপ্ত রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের ধ্বংসস্তূপের কাছাকাছি রাক্ষসীডাঙাতেই আবিস্কৃত হয়েছে অপর একটি বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ। আবার প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে প্রাপ্ত উপাদানের উপর নির্ভর করে এটাও নিশ্চিৎভাবে বলা যাচ্ছেনা যে রাক্ষসীডাঙা সম্রাট অশোক নির্মিত স্তূপেরই ধ্বংসাবশেষ। আবার এটাও সত্যি যে ১৯২৮ সালে রাক্ষসীডাঙায় খুব কম পরিসরেই খননকার্য চলেছে। হতেও পারে এটি অশোক নির্মিত বৌদ্ধস্তূপেরই ধ্বংসাবশেষ কিন্তু উপযুক্ত খননকার্যের অভাবে বা দুস্কৃতি কর্তৃক গুরুত্বপূর্ন উপাদান চুরি অথবা স্থানান্তরিত হবার ফলে সেটা আজও নিশ্চিৎরূপে প্রমানিত হয়নি।

 

রাক্ষসীডাঙার খননকার্য থমকে থাকার কারণ

১৯২৮ সালের পরীক্ষামূলক উৎখননের পর থেকেই থমকে রয়েছে রাক্ষসীডাঙার খননকার্য। বলার মত তেমন কোন খননকার্যই হয়নি। কর্ণসুবর্ণের এখনও অনেক প্রাচীন ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সমৃদ্ধ স্থল রয়েছে যেখানে আজ পর্যন্ত কোন খননকার্য হয়নি। কর্ণসুবর্নের বিভিন্ন প্রাচীন স্থল গুলিতে কি কারনে খননকার্য হয়না সেই ব্যপারে সুধীর রঞ্জন বাবু তাঁর বিস্তারিত মতামত জানিয়েছেন। তাঁর মতে সমগ্র কর্ণসুবর্ণ অঞ্চল ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধিকারে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালা ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের কাছে অনুমতি নিয়ে মাঝে মাঝে খননকার্য চালাই। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে-কলমে শিক্ষা দানের জন্য যেটুকু করা দরকার তার বেশি সামর্থ নেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সমগ্র স্থানটি উপযুক্তভাবে খননকার্যের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা বিশ্ববিদ্যালয়ে মজুত নেই। কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার এই ব্যপারে বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্থ সাহায্য করেনা কারন তাদের নিজস্ব প্রত্নতত্ত্ব দপ্তর আছে। কেন্দ্রীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হাতে কর্ণসুবর্ণকে তুলে দিলে তারা হয়ত কাজটি ভালভাবে সম্পাদন করতে পারেন কিন্তু তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ বজায় রাখতে গিয়ে ইতিহাস এবং মুর্শিদাবাদ জেলার ক্ষতি হচ্ছে কারন এইভাবে খননকার্য চললে এই অঞ্চলের সমগ্র প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সংগ্রহে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের স্বার্থ বিঘ্নিত করে তাদের অধিকার অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিতে কোনমতেই রাজী নয়।

 

রাক্ষসীডাঙাস্থিত বৌদ্ধ বিহারের পতন

শশাঙ্কের রাজত্বকালে কর্ণসুবর্ণ মহানগরী গৌরব ও প্রাচুর্য়ের চূড়ায় পৌঁছেছিল। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বানিজ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, গৌড়ীয় লিপির প্রয়োগ প্রভৃতি সকল বিষয়ে দ্রুত বিকাশলাভ করেছিল এই মহানগরী কিন্তু সেই গৌরব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মহারাজাধিরাজ পরমভট্টারক শশাঙ্কদেবের মৃত্যুর সাথে সাথেই কর্ণসুবর্ণ প্রতিবেশী রাজ্যগুলির দ্বারা আক্রান্ত হয় যার ফলে কর্ণসুবর্ণ মহানগরীর গুরুত্ব কমতে থাকে। কর্ণসুবর্ণ মহানগরী ভাগীরথীর ভাঙন, প্রকৃতিক বিপর্যয়, বৈদেশিক আক্রমনের ফলে দ্রুত গুরুত্ব হারাতে থাকে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কর্ণসুবর্ণ নামটাই বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যায়। মিনহাজউদ্দিন সিরাজ ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’ গ্রন্থটি লেখেন ১২৬০ খ্রীষ্টাব্দে। গ্রন্থটির অনুবাদক কর্নেল রেভার্টি সাহেব দেখিয়েছেন সেই সময় ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ের নাম ছিল রাঙামাটি। তাঁর মতে সেইসময় অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতকেই কর্ণসুবর্ণ নামের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় এবং ঐ অঞ্চলটি রাঙামাটি নামে পরিচিত হয়। ১৬৬৪ খ্রীষ্টাব্দে ফ্যান ডেন ব্রুকের মানচিত্রেও রাঙামাটির অবস্থান গুরুত্বের সাথেই দেখান হয়েছে। যার উত্থান আছে তার পতন হবে কালের নিয়ম মেনেই। রাক্ষসীডাঙাস্থিত বৌদ্ধবিহারটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এটির পতনের নেপথ্যেও একধিক কারন রয়েছে। কারন গুলি নিম্নে আলোচনা করা হল-

♣  পূর্বদিকে থাকা ভাগীরথীর প্রবাহ ক্রমশ স্থানচ্যুত হয়ে পশ্চিমে সরে আসায় রাজপথ, রাজপ্রসাদ সহ বেশকিছু বিশাল বিশাল অট্টালিকা ভাগীরথী গর্ভে তলিয়ে যায়। হিউ-এন-সাঙের বিবরন ‘সি-য়ু-কি’ ও ‘জীবন স্মৃতি’ গ্রন্থানুযায়ী কর্ণসুবর্ণে ১৪টি বৌদ্ধ সঙ্ঘরাম সহ ৫০ টি দেবমন্দির ছিল। ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের দীর্ঘকালিন অনুসন্ধানের ফলে যদুপুর থেকে মাত্র দুটি বৌদ্ধ সংঘরামের ধ্বংসস্তূপ আবিষ্কৃত হয়েছে। কোথায় গেল বাকী গুলি? হতে পারে লুকিয়ে আছে মাটির তলায় আবার এটাও হতে পারে কিছু সঙ্ঘরাম তলিয়ে গেছে ভাগীরথীর গর্ভে। যদিও ভাগীরথী রাক্ষসীডাঙাস্থিত বিহারটিকে আত্মগর্ভস্থ করতে পারেনি তবুও ভাগীরথীর গ্রাসে কর্ণসুবর্ণ মহানগরীর ভাঙন যে এখানকার বৌদ্ধ শ্রমনদের মনে শঙ্কার সৃষ্টি করেনি সেটাই বা কে বলতে পারে? ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়ের মতে ভাগীরথীর প্লাবনেই কর্ণসুবর্ণ মহানগরী ধ্বংস ও জনশূন্য হয়ে গেছিল।

♣ শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে স্থানেশ্বর ও কনৌজরাজ হর্ষবর্ধন, মালবরাজ মাধবগুপ্ত এবং কামরূপরাজ ভাষ্করবর্মার মিলিত বাহিনী কর্ণসুবর্ণ দখল করে। ভাষ্করবর্মার নিধনপুর তাম্রশাসন থেকে জানা যায় তিনি কর্ণসুবর্ণে জয়স্কন্ধবার থেকে ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করেছিলেন। হয়ত মিলিত বাহিনীর বিজিত রাজ্য সমূহের লভ্যাংশ স্বরূপ কর্ণসুবর্ণের ভূখণ্ডটি লাভ করেন। শশাঙ্কের জীবৎদশায় এই ত্রিশক্তি মিত্রজোট গৌড় দখল করেছেন এমন প্রমান হর্ষবর্ধনের বাঁশখেরা বা মধুবন তাম্রশাসন, বানভট্ট প্রণীত হর্ষচরিত বা কাদম্বরী কোথাও নেই অথচ হর্ষবর্ধন ভারতের মানচিত্র থেকে গৌড়শূন্য করার জন্য যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ  হয়েছিলেন তেমন প্রমান একাধিক লিখিত উপাদানে রয়েছে। শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে ত্রিশক্তি মিত্রজোটের আক্রমনে মহানগরী কর্ণসুবর্ণতে যে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তাতে রাক্ষসীডাঙায় বসবাসকারী শ্রমনেরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সাময়িকভাবে স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছিলেন। সেটাও হতে পারে।

♣ ঐতিহাসিকেরা কর্ণসুবর্ণকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন। ল্যাসেন সাহেব ‘কর্ণসুবর্ণ গড়’ অর্থাৎ কর্ণসুবর্ণ দূর্গের কথা বলেছেন। ১৮০৭ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত মতানুযায়ী উইলফোর্ড সাহেব জানান কর্ণসুবর্ণের প্রাচীনতম নাম ছিল ‘কুসুমপুরী’। ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে লেয়ার্ড সাহেব মুর্শিদাবাব জেলার রাঙামাটি অঞ্চলের নাম ‘কানসোনাপুরী’ বা ‘কার্ণ(কর্ণ)-সোনা-কা-গড়’ বলে উল্লেখ করেন। একটা জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে উইলোফোর্ড সাহেব কর্ণসুবর্ণ মহানগরী ধ্বংসের কারন বর্ননা করেন। তাঁর মতে লঙ্কার রাজা নৌবহর নিয়ে বঙ্গদেশ আক্রমন করেন। তাঁর নৌবহর ভাগীরথী বেয়ে রাঙামাটি বা কর্ণসুবর্ণে পৌঁছে নগরীটি লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে। বেভারিজ সাহেবের মতে সিংহলরাজ পরাক্রমবাহু ১১৮২-৮৩ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গদেশ আক্রমন করেন। কর্ণসুবর্ণ রাজপ্রসাদের উপকণ্ঠেই রাক্ষসীডাঙা বৌদ্ধবিহারের অবস্থান সূতরাং রাজধানী কোন বৈদেশিক আক্রমনকারী দ্বারা আক্রান্ত হলে নিকটস্থ বৌদ্ধবিহারবাসী শ্রমন গনের প্রানহানি ঘটার সম্ভবনা রয়েছে। তবে কোন ঐতিহাসিক তথ্য দ্বারা উইলফোর্ড সাহেব বা বেভারিজ সাহবের কর্ণসুবর্ণ মহানগরী ধ্বংসের মতবাদ দুটি সমর্থিত নয়। পরবর্তীকালের গবেষনার মাধ্যমে জানা গেছে পরাক্রমবাহু যে রাজ্যটি আক্রমন করেছিলেন সেটি উড়িষ্যার সমুদ্রোপকুলস্থ একটি রাজ্য।

♣ কর্ণসুবর্ণ মহানগরী ধ্বংসের কারন হিসেবে ডা. সুধীর রঞ্জন দাস চোলসম্রাট রাজেন্দ্র চোলদেবকে দায়ী করেন। রাজেন্দ্রচোলদেবের তিরুমালৈ অভিলেখের বিবরণ অনুযায়ী ১০২৫ খ্রীষ্টাব্দের কিছুকাল আগে চোল সেনাপতি শিবনাথ বাঙলা অভিযানে এসে দণ্ডভুক্তির ধর্মপাল, দক্ষিন রাঢ়ের রনশূর, বঙ্গালের গোবিন্দ চন্দ্র এবং উত্তর রাঢ়ের মহীপালকে পরাজিত করেন। বাঙলা জয়ের স্মৃতিতে রাজেন্দ্রচোলদেব ‘গঙ্গোইকোণ্ড’ বা গঙ্গাবিজেতা উপাধি ধারন করেন। রাজেন্দ্রচোলদেবের বঙ্গবিজয় প্রথম মহীপালের উপরে তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি। চোলবাহিনী স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পরে প্রথম মহীপাল আবার পূর্নবিক্রমে রাজ্যশাসন করতে থাকেন। কলচুরি রাজাদের অভিলেখ থেকে জানা যায় ১০১৯ খ্রীষ্টাব্দের কিছু পূর্বে কলচুরিরাজ গাঙ্গেয়দেব উত্তরবিহার থেকে প্রথম মহীপালকে বিতারিত করেন। এই আক্রমনও যে মহীপালের উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারেনি সেটা প্রমান করে মহীপালের সারানাথ লেখ। ১০২৬ খ্রীষ্টাব্দে উৎকীর্ন লেখ অনুযায়ী মহীপালের দুই ভাই স্থিরপাল ও বসন্তপাল বারনসীতে মন্দিরাদি নির্মাণ করেন। সুধীর রঞ্জন বাবুর মতে রাজেন্দ্রচোলের আক্রমনকে সিংহলরাজের আক্রমনের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। চোলদের আক্রমনের ফলে কর্ণসুবর্ণের গুরুত্ব একেবারে কমে যায় এবং সেন আমলে মহানগরীটি সম্ভবত একটি মণ্ডলে পরিনত হয়। ত্রয়োদশ শতকের প্রারম্ভে মুসলমান আক্রমনে কর্ণসুবর্ণ পুরোপুরিভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।

♣ রাক্ষসীডাঙার খননকার্যে প্রাপ্ত উপাদানের উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে স্থানীয় বৌদ্ধবিহারটি প্রাক শশাঙ্ক অর্থাৎ মৌর্য্য অথবা গুপ্তযুগ থেকে শুরু করে পরবর্তী শশাঙ্ক যুগ অর্থাৎ পাল বা সেন যুগ পর্যন্ত ঠিকে ছিল। বিভিন্ন স্তরভিত্তিক উপাদানের উপর নির্ভর করে এটাও বলা যায় যে বিহারটির একাধিকবার পুনঃনির্মিত হয়েছিল। সেন রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রবল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সেন রাজাদের আমলে বৌদ্ধশ্রমন ও বৌদ্ধবিহার গুলি অবহেলিত হতে থাকে। ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুত্থানের ফলে বৌদ্ধরা হিন্দুসমাজে ব্রাত্য হয়ে পরছিল। বৌদ্ধরা  আত্মসম্মান রক্ষা এবং সমাজে উপযুক্ত স্থান লাভের জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহন করার দিকে ঝুঁকছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য রাক্ষসীডাঙার পীর তুর্কান সাহেব খুব সম্ভবত একজন ইসলাম ধর্ম প্রচারক ছিলেন এবং ঐ অঞ্চলটিতে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারে উনার গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকাটা অসম্ভব নয়।

♣ গৌড়েশ্বর নরসিংহ অরিরাজ-মর্দন-শঙ্কর লক্ষ্মণসেনের আমলে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরনীয় ঘটনা হল ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ-বিন-বখতিয়ার খলজীর নেতৃত্বে বঙ্গদেশে তুর্কী আক্রমন। বখতিয়ার খলজী পূর্বভারতে সামরিক অভিযানের সাথে সাথে ব্যপকভাবে লুণ্ঠনাদি পরিচালনা করেছিলেন। তার বিজয়াভিযানের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় মৌলানা মিনহাজউদ্দিন সিরাজের ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’ গ্রন্থে। ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’ গ্রন্থের বর্ননা অনুযায়ী বখতিয়ার খলজী বিহারশরিফের বিখ্যাত বৌদ্ধবিহার উদন্তপুর ধ্বংস করেন। এই বৌদ্ধবিহারটি পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল কর্তৃক নির্মিত হয়। ধর্মপাল প্রতিষ্ঠিত বিক্রমশিলা বৌদ্ধবিহার ও গুপ্তসম্রাট কুমারগুপ্ত নির্মিত আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়টিও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় বখতিয়ার খলজীর হাতেই। বিশ্ববিদ্যালয়স্থিত বৌদ্ধ শ্রমনদের নির্বিচারে হত্যা করে মহাবিহারটিতে অগ্নি সংযোগ করেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের সাথে সাথে অসংখ্য মূলবান ও দুস্প্রাপ্য গ্রন্থের সংগ্রহ চিরতরের জন্য বিনষ্ট যায়। এখানেই শেষ নয়। বিহার রাজ্যে ধ্বংসযজ্ঞ শেষ করে বখতিয়ার খলজী নবদ্বীপ আক্রমনের জন্য প্রস্তুত হন। সেন রাজাদের স্থায়ী রাজধানী ছিল বিক্রমপুর। পরে লক্ষ্মণসেন নদীয়াতে আরেকটি রাজধানী লক্ষ্মণাবতী স্থাপন করেন। বখতিয়ার খলজীর আক্রমনকালে উনি নবদ্বীপে ছিলেন। মিনহাজউদ্দিন সিরাজের বিবরন অনুযায়ী লক্ষ্মণসেন তীর্থবাসের জন্য নদীয়া গমন করেছিলেন এবং কিছুদিন একটি বসতবাটিতে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন। বখতিয়ার খলজী ১৮ জন অশ্বারোহী নিয়ে নদীয়া নগরীর উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়েছিলেন। অশ্ববিক্রেতার পরিচয়ে নগরে প্রবেশাধিকারও পেয়েছিলেন। প্রাসাদে প্রবেশ করার পরে রক্ষীদের সাথে বখতিয়ার খলজীর দলের যুদ্ধ বাঁধে। এরপরেই হয়ত বাইরে অপেক্ষমান পশ্চাদবর্তী তুর্কী সেনাদল প্রাসাদের দিকে ধেয়ে আসে। লক্ষ্মণসেন আকস্মিক সঙ্কট ও বিপর্যয় টের পেয়ে কোনরকম প্রতিরোধের ব্যবস্থা না করেই গুপ্ত পথে ভাগীরথী পাড় হয়ে পূর্ববঙ্গে পলায়ন করলেন। পূর্ববঙ্গ থেকেই তিনি এমন প্রতিরোধ গড়ে তুললেন যে তুর্কীবাহিনী আর অগ্রসর হতে পারেনি। তুর্কীরা নদীয়া অধিকারের পরেও লক্ষ্মণসেন পূর্ববঙ্গ থেকে আরও অন্ততপক্ষে ৩-৪ বছর রাজত্ব করেন। রাজত্বের সপ্তবিংশতি বছরে ভূমিদান প্রসঙ্গে ঢাকা জেলায় ভাওয়াল তাম্রশাসন প্রচার করেন। লক্ষ্মণসেন ও তাঁর উত্তরাধিকারীরা পূর্ববঙ্গে তুর্কী আক্রমন প্রতিহত করে নিজেরা ‘ম্লেচ্ছ ও যবনবিজেতা’ উপাধি ধারন করেছিলেন। লক্ষ্মণসেন এবং তাঁর উত্তরাধিকারী কেশবসেন ও বিশ্বরূপসেনদের প্রতিরোধের কারনেই তুর্কীরা উত্তরবঙ্গেই আবদ্ধ ছিল, পশ্চিমবঙ্গ বা রাঢ়দেশে দীর্ঘকাল আধিকার জমাতে পারেনি। মুখিসুদ্দীন উজবেকের জীবনবৃত্তান্ত থেকে জানা যায় যে ১২৫৫ খ্রীষ্টাব্দে রাঢ়দেশে ইসলাম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। লক্ষ্মণসেন নবদ্বীপ ত্যাগ করে গোপনে পূর্ববঙ্গে পাড়ি দেবার পরে বখতিয়ার খলজি নবদ্বীপে লুণ্ঠন চালিয়ে সেন রাজধানী লক্ষ্মণাবতীর দিকে ধাবিত হন। ঐ পথেই ছিল কর্ণসুবর্ণের অবস্থান। বাকী নগর বিহার গুলির মত কর্ণসুবর্ণও অবাধ লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলার হাত থেকে রক্ষা পাইনি। নানা আক্রমন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অবহেলাজনিত ক্ষয়ক্ষতির সহ্য করেও নগরের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, বখতিয়ার খলজীর সামরিক অভিযানে সেটুকুও ধ্বংস হল। এই অভিযানের সাথে সাথেই হয়ত রাজবাড়ীডাঙাস্থিত রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার, রাক্ষসীডাঙাস্থিত বৌদ্ধবিহার সহ আরও যেসব বৌদ্ধবিহার অস্তমিত অবস্থায় ধুঁকছিল তাদের কফিনেও শেষ পেরেক পোঁতা হল। কর্ণসুবর্ণের বিভিন্ন স্থানে এখনও সেই ধ্বংসলীলার অনেক চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায়। আজও কর্ণসুবর্ণের লোকমুখে একটি কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। সেটি হল বখতিয়ার খলজীর ধ্বংসলীলায় ভীত-সন্ত্রস্ত কর্ণসুবর্ণরাজ ক্ষোভ ও অপমানের জ্বালায় সপরিবারে রাজধানী ত্যাগ করে নগরের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে চৈতি বিলে প্রান বিষর্জন দেন। লক্ষ্মণসেনের আমলে কর্ণসুবর্ণে কোন সার্বভৌম রাজা থাকা সম্ভব নয় কারন লক্ষ্মণসেনের কোন তাম্রশাসনে কর্ণসুবর্ণের নাম না থাকলেও তাঁর বিভিন্ন তাম্রশাসন থেকে এটা পরিষ্কার যে কর্ণসুবর্ণ অঞ্চল তাঁর শাসনাধীন ছিল। হতে পারে লক্ষ্মণসেন পূর্ববঙ্গে পলায়নের পরে তারই কোন সামন্ত বা মহাসামন্ত বখতিয়ার খলজীকে বাঁধাদান করতে গিয়ে পরাজিত হয়ে সপরিবারে চৈতি বিলে আত্মাহুতি দেন।

রাক্ষসীডাঙার বর্তমান অবস্থা

বেভারিজ সাহেবের আমলে রাক্ষসীডাঙার খননকার্য হয় এবং ধ্বংসস্তূপের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের অস্তিত্ব প্রমানিত হয়। বৌদ্ধবিহারটি খুব সম্ভবত মৌর্য্যযুগ থেকে গুপ্তযুগ, পালযুগ পেরিয়ে সেনযুগ পর্যন্ত টিকে ছিল। ২০১০ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে খননকার্যের পর ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ রাক্ষসীডাঙাকে স্মারকলিপি লাগিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থলের মর্যাদা দান করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় রাক্ষসীডাঙার সম্মানটা যেন স্মারকলিপিতেই আটকে আছে। স্থানটিতে গিয়ে স্বচক্ষে না দেখলে বোঝা যাবে না একটা প্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল কিভাবে দিনের পর দিন অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। অবহেলা এবং দুস্কৃতিদের দৌরাত্ম্যে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে রাক্ষসীঢিবি। লোপাট হয়ে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। নিম্নলিখিত কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে রাক্ষসীঢিবি ও তার গর্ভে থাকা মূল্যবান প্রত্নদ্রব্য-

♠ কোন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল যাতে সাধারন মানুষ বা গবাদি পশুর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেইজন্য স্থলটিকে প্রাচীর অথবা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। কিন্তু রাক্ষসীঢিবির সুরক্ষার জন্য  না আছে কাঁটাতারের বেড়া আর না আছে ঘেরা প্রাচীর। এই প্রসঙ্গে ২০১১ সালের ২২শে ডিসেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটা প্রতিবেদনে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের কলকাতা মণ্ডলের অধিকর্তা তপনজ্যোতি বৈদ্য বলেছেন “রাক্ষসীডাঙার ওই ঢিবিটি ১০০ মিটার বাই ৮০ মিটার জায়গা জুড়ে। তার চারপাশে আমরা পাঁচিল বা কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু ওই জমির কিছুটা অংশ নিয়ে সমস্যা রয়েছে। তাই বেড়া দেওয়ার কাজ করা যায়নি।” তিনি আরও বলেন, “সেই সঙ্গে অর্থ সঙ্কটও ছিল।” স্থানটি উন্মুক্ত থাকার কারনে অবাদে চড়ে বেড়াই গবাদি পশু। এছাড়াও আঁধার ঘনিয়ে এলে বাড়ে দুস্কৃতিদের উপদ্রব।

♠ ১৯৫৯(৩২নং ধারা) আইন অনুযায়ী প্রত্নতাত্ত্বিক স্থলের সংরক্ষিত সীমা থেকে তার চারিদিকে ১০০মিটার মিটার দূরত্ব  পর্যন্ত এলাকাকে সংরক্ষিত স্মারকের  ‘নিকটবর্তী এলাকা’ বা ‘সংলগ্ন অঞ্চল’ ঘোষনা করা হয় এবং তার পরে আরও ২০০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত এলাকাকে স্মারকের ‘নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল’ ঘোষনা করা হয়। স্মারক থেকে তার চারিদিকে ২০০ মিটার পর্যন্ত এলাকায় সাধারন মানুষের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ। কিন্তু রাক্ষসীডাঙার সংরক্ষিত সীমা থেকে ২০০মিটার তো দূর অস্ত তার চারিদিকে ৫-৬ মিটার দূর পর্যন্তও সাধারন মানুষের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করা যায়নি। ঢিবিটির তিনদিকে(উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিন) ধানক্ষেত। উত্তর আর পশ্চিম দিকের ধানক্ষেত দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে ঢিবির অনেকটা অংশই কেটে নিয়ে ঐসব ক্ষেতি জমির সীমানা বাড়ান হয়েছে।

♠ ২০১০ খ্রীষ্টাব্দে ২২শে মার্চ পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ ও রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতর যৌথ ভাবে রাক্ষসীডাঙা ঢিপি উৎখনন করে। উৎখননের ফলে চিহ্নিত করা গিয়েছে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতকের ইঁটের স্থাপত্য। তার ঘর ও প্রবেশ দ্বার পাওয়া যায়, যা গুপ্ত যুগের শেষ পর্যায়ের ও শশাঙ্কের আমলের সূচনা কালের। এ ছাড়াও পোড়া মাটির বেশ কিছু প্রত্নসামগ্রী পাওয়া যায়। তার মধ্যে রয়েছে পোড়ামাটির তিনটি মস্তকও। এর পরেই ইতিহাসের দলিল হিসেবে ওই রাক্ষসীডাঙাকে সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের তরফে বোর্ডও ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ২৪ ঘন্টা রক্ষনাবেক্ষনের জন্য মোতায়েন করা হয় দু’জন নিরাপত্তারক্ষী। ২০১১ খ্রীষ্টাব্দে ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে দুষ্কৃতীরা মাটি খুঁড়ে বোর্ডটি উপড়ে ফেলে রেখে যায়। স্থানীয় বাসিন্দা মানিক দে তা তুলে নিজের বাড়িতে রেখে দিয়েছিলেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরেই পুরাতাত্ত্বিক বিভাগীয় কর্তারা লালবাগ থেকে এসে পুনরায় বোর্ডটি লাগানোর বন্দোবস্ত করেন। স্থানীয় বাসিন্দা কুশকুমার দাস অভিযোগের সুরে বলেছিলেন, “নিরাপত্তারক্ষী রয়েছেন, কিন্তু তাঁদের এলাকায় দেখা পাওয়া যায় না।”

♠ ২০১১ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে হাওড়া নরসিংহদত্ত কলেজের নৃতত্ব বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ২০ জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে ৩ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা মুর্শিদাবাদে আসেন। তাঁরা ১৭ই ডিসেম্বর শনিবারে রাক্ষসীডাঙায় যান। এর পরেই বিষয়টি নজরে আসে। বেভারিজ সাহেব ১৯২৮-২৯ খ্রীষ্টাব্দের খননকার্যের পরে ইঁট চুরি ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান নষ্টের ব্যপারটা তুলে ধরেছিলেন। বিংশ শতকের আগে থেকে আজ পর্যন্ত রাক্ষসীডাঙা অনাবৃতই রয়েছে। ইঁট চুরি ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান নষ্টের পরম্পরা এখনও অব্যাহত আছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপত্যটির গা থেকে প্রায় ৮০০-২৩০০ বছর আগের ইট চুরি করে কেউ বাঁধিয়েছেন বাড়ির কলতলার পাড়, কেউ ভরাট করেছেন রান্নাঘরের নীচু জায়গা। ক্রমাগত ইঁট চুরির ফলে স্থাপত্যটির আকারও বদলে যাচ্ছে। ঐ দলের সক্রিয়তার কারনে ব্যপক ইঁট চুরির ঘটনাটা সংবাদ মাধ্যমের চোখে পড়ে। ঐ দলের নৃতত্ব বিভাগের অধ্যাপিকা শ্রীমতি জয়িতা রায় বলেন, “প্রত্নস্থল সংরক্ষণে আরও যত্নবান হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। রাক্ষসীডাঙায় গিয়ে আবিষ্কারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার আনন্দের চেয়ে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি বলে যন্ত্রণা পেয়েছি।” কলাকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সহ-কর্তা অমল বাবু বলেন, “এখন ওই ইঁট খুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেই আমলের ইতিহাসের উপাদান হারিয়ে যাবে। ইতিহাসের সঠিক মূল্যায়ন হবে না। অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।” স্থাপত্যের গা থেকে ইঁট চুরির ব্যপারে সরব হয়েছেন আরেক ইতিহাস গবেষক শ্রী বিজয়কুমার বন্দোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “দীর্ঘ দিন ধরে ইট খুলে নিয়ে যাওয়ায় ওই এলাকার ইতিহাসের উপাদান এখন সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। গর্তগুলো আবর্জনা দিয়ে ভরাট করে দেওয়া হয়েছে।”

♠ ধন-সম্পদের লোভে দুষ্কৃতিরা ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক দপ্তরের সাবধানবানী উপেক্ষা করে ঢিবিটি খোঁড়াখুড়ি করে থাকে। মাঝে মাঝে ঢিবিটির চারিধার ঘুরে দেখলে জায়গায় জায়গায় খোঁড়াখুড়ির চিহ্ন কিছুতেই দৃষ্টি এড়াবে না। এখানেই শেষ নয় ঢিবির উপরে এবং আশে পাশে একটু ভাল করে লক্ষ করলেই চোখে পড়বে বেশকিছু গোটা এবং ভাঙা মদের বোতল। ঢিবির নীচে পশ্চিম পাড়ের গা ঘেঁষে এবং উপরের কিছু কিছু জায়গায় মানুষের প্রাতঃকৃত্যের ছবিটাও ফুটে ওঠে। ঢিবির কিছু কিছু আংশে চাকার গভীর ছাপ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে কোন কোন সময়ে মালবাহী ট্র্যাক্টর ঢিবিটির উপরে যথেচ্ছভাবে চালান হয়। এতকিছু চোখে পড়ার পরে এটাই মনে হয় যে স্থানীয় মানুষেরা প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসের গুরুত্ব বোঝেনা অথবা গুরুত্ব সম্বন্ধে উদাসীন। স্থাপত্যের গরিমা ম্লান হয়েছে বহু আগে থেকেই। কে বা কারা প্রাচীন স্থাপত্য, ঐতিহ্য নষ্ট করছে তা দেখার কেউ নেই। অনেকের বলেন, “একমাত্র হাজারদুয়ারি ছাড়া মুর্শিদাবাদের অন্য পর্যটনকেন্দ্র নিয়ে কোনও সরকারই কোনওদিন মাথা ঘামায়নি।” এই নিয়ে জেলাবাসীর বিস্তর ক্ষোভ রয়েছে। এই জেলার আনাচেকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। সতীপীঠ থেকে শুরু করে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার, অশোক নির্মিত চারটি বৌদ্ধসঙ্ঘরাম কর্ণসুবর্ণ মহানগরীর ভেতরেই ছিল, আরও কত জিনিসের হদিশই না মিলেছে এই জেলায়!

♣ প্রতিদিন একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য। পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে ঢেলে সাজানো তো দূরের কথা, সব জেনে বুঝেও প্রশাসন নির্বিকার বলে অভিযোগ। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাফাই, “বিশাল এলাকা পড়ে রয়েছে তাই মানুষ ব্যবহার করছে।” অনেকে বলছেন, “সরকার কড়া ব্যবস্থা নিলে কেউ লোহার গ্রিলের ভিতরে ঢোকার সাহস পর্যন্ত পাবে না।” এলাকার অনেকেই চান, পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠুক কর্ণসুবর্ণ। তাহলে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটবে। এই নিয়ে জেলা প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে।

উপসংহার

কালের চাকা ঘুরে চলেছে প্রতিনিয়ত। আজ যেটা সৃষ্টির পথে এগিয়ে চলছে ভাবীদিনে সেটা ধ্বংসের পথে লয় হবে। বর্তমানকে বুঝে ভবিষ্যতে পদক্ষেপ ফেলার জন্য আমাদের ইতিহাস অবশ্যই জানতে হবে। ইতিহাস জানার পথের সোপানই হল প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। সূতরাং সকলকেই প্রত্নদ্রব্য এবং প্রত্নস্থলের সংরক্ষন এবং সমাদর করা উচিত। রাজবাড়ীডাঙার মত রাক্ষসীডাঙাও একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রত্নস্থল। হাজারদুয়ারীর মত রাজবাড়ীডাঙা, নীলকুঠিঢিবি, রাক্ষসীডাঙারও সংরক্ষন প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে রাক্ষসীডাঙা, রাজবাড়ীডাঙা, নীলকুঠিঢিবির ঐতিহ্য বহু প্রাচীন আর এটা ভুললেও চলবে না যে এই স্থান তিনটে ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের ভারতের শ্রেষ্ঠ মহানগরীর অংশ। তাছাড়াও উক্ত স্থান গুলির গর্ভে থাকা প্রত্নদ্রব্য মুর্শিদাবাদ তথা ভারতের ইতিহাস বদলে দিতে পারে। রাক্ষসীডাঙা এবং রাজবাড়ীডাঙা দুটি একে অপরের গা লাগোয়া বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ। এদুটিকে যদি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা যায় তাহলে প্রাচীন কর্ণসুবর্ণ মহানগরীর প্রদর্শনী ও প্রত্নদ্রব্য দেখার জন্য অনেকেই ভীড় জমাবেন। সাথে সাথে বদলে যাবে বর্তমান কর্ণসুবর্ণের অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মান।

 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

এই প্রবন্ধটি লেখার ব্যপারে আমি অনেকেরই সহায়তা পেয়েছি। যে সমস্ত বই থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং যাদের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য পেয়েছি তাদের নাম কৃতজ্ঞতার সাথে নিম্নে স্মরণ করলাম।

১. কর্ণসুবর্ণ মহানগরী : বঙ্গদেশের বিস্মৃত রাজধানী – সুধীর রঞ্জন দাশ। প্রকাশনা – পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ।

২. প্রাচীন মুর্শিদাবাদ : কর্ণসুবর্ণ ও মহীপাল  – বিজয়কুমার বন্দোপাধ্যায়। প্রকাশনা – রাডিক্যাল ইম্প্রেশন।

৩. RAJBADIDANGA : 1962 – সুধীর রঞ্জন দাশ। প্রকাশনা – দ্যা এশিয়াটিক সোসাইটি।

৪. রাজা শশাঙ্ক ও অন্যান্য – রাধারমন রায়। প্রকাশনা – ভবিষ্যত।

৫. বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদিপর্ব  – নীহার রঞ্জন রায়। প্রকাশনা – দে’শ পাবলিশিং।

৬. নিত্যকালের তুই পুরাতন – দেবার্চনা সরকার। প্রকাশনা – পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ।

৭. ভারত ইতিহাসের সন্ধানে – দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়। প্রকাশনা – সাহিত্যলোক।

৮. শিলালেখ তাম্রশাসনাদির প্রসঙ্গ – ড. দীনেশচন্দ্র সরকার। প্রকাশনা – সাহিত্যলোক।

৯. মুর্শিদাবাদের ইতিহাস – নিখিলনাথ রায়। প্রকাশনা – কে.পি.এম।

১০. বাঙলা দেশের ইতিহাস : প্রাচীন যুগ – রমেশচন্দ্র মজুমদার। প্রকাশনা – জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যাণ্ড পাবলিশার্স লিমিটেড।

১১. গৌড়রাজমালা – রমাপ্রসাদ চন্দ। প্রকাশনা – দে’জ পাবলিশিং।

১২. বাঙ্গালার ইতিহাস : অখণ্ড সংস্করন – রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়। প্রকাশনা – দে’জ পাবলিশিং।

১৩. কুমারপুর ভোলানাথ মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শ্রী দিলীপ কুমার দাস মহাশয়।

(প্রসঙ্গত উল্লেখ্য দিলীপ বাবু ইতিহাস বিষয়ক শিক্ষক। উনি মধুপুর রাজা শশাঙ্ক বিদ্যাপীঠের প্রাক্তন ছাত্র পাশাপাশিভাবে মৃনাল গুপ্ত মহাশয়েরও ছাত্র। দিলীপ স্যার কর্ণসুবর্ণের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল, তার সথে জড়িত কিংবদন্তী সংক্রান্ত তথ্যবলী দিয়ে উপকৃত করেছেন।)

১৪. সাটুই ব্যোমকেশ স্মৃতি পাঠাগারের প্রাক্তন সম্পাদক শ্রী সুবোধ কুমার বড়াল মহাশয়।

(মাখন বাবু ও সন্তোষ সেন সংক্রান্ত তথ্যাবলী প্রদান করে উপকৃত করেছেন।)

১৫. রঞ্জন দত্তের ব্লগ ও আনন্দবাজার পত্রিকা(২২শে ডিসেম্বর, ২০১১ খ্রীষ্টাব্দ – সংখ্যার প্রতিবেদন)।

১৬. মধুপুর রাজা শশাঙ্ক বিদ্যাপীঠের প্রাক্তন ছাত্র  অরিজিৎ মুখার্জী মহাশয়।

(সাটুই গ্রামের বাসিন্দা শ্রীমান অরিজিৎ মুখার্জীর রাজবাড়ীডাঙা, রাক্ষসীডাঙা সহ কর্ণসুবর্ণের একাধিক প্রত্নস্থল ভ্রমনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। রাজবাড়ীডাঙা ও রাক্ষসীডাঙার বেশকিছু ফটোস্যুট ওর হাতেই হয়েছে।)

shoptodina.com
shoptodina.comhttps://shoptodina.com
সপ্তডিঙা। কথাটা শুনলেই মনে আসে বাঙালির সমুদ্রবাণিজ্যের এক গৌরবময় ইতিহাস। গৌড়ের বণিকরা সাতটি বিশাল নৌকার এই সমবায় নিয়ে সিংহল, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, চীন, রোম, গ্রীস, ক্রীট, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করে ফিরে আসতেন স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার নিয়ে। সপ্তডিঙা তাই বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির অভিজ্ঞান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Advertisingspot_img

Popular posts

My favorites