আষাঢ় নবরাত্রিতে রথ থেকে উল্টোরথের মধ্যে মঙ্গল ও শনিবার এই মা বিপত্তারিণীর পুজো ও ব্রতধর্ম পালিত হয়। বিপত্তারিণী প্রাচীন মাতৃকা। তাঁর উপাসনা প্রাচীন কাল থেকে হচ্ছে। লিখেছেন- ডঃ তমাল দাশগুপ্ত
★১. প্রাচীন সাংখ্য দর্শনের মূল কথা, জগৎ দুঃখময়। এই দুঃখের নানা উৎস, আধিদৈবিক, আধিভৌতিক, আধ্যাত্মিক। এই দুঃখ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সাংখ্য দর্শনের নানা পদ্ধতি আছে যা গত তিন হাজার বছর ধরে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। বিপত্তারিণী ব্রতে মূলত আধিদৈবিক বা আচমকা ভাগ্যবিপর্যয়ের বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রয়াস দেখা যায়, ব্রতকাহিনীতে দেখি। কিন্তু নিজের মনের আকাঙ্ক্ষা থেকে বিপদ (আধ্যাত্মিক) এবং কোনও দ্রব্য বা বস্তু থেকে বিপদ (আধিভৌতিক) সমানভাবে চোখে পড়ে এই কাহিনীতে।
★২. বিপত্তারিণী ব্রতের উদযাপনে উপচারে তেরো সংখ্যার গুরুত্ব। এটিও সাংখ্য দর্শনের দিকে ইঙ্গিত করে।
★৩. মহাভারতে দুর্গাস্তবে “তারিণী” নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়। নিঃসন্দেহে যিনি বিপদ থেকে তারণ করেন, তিনিই তারিণী।
★৪. কিন্তু তারিণী হল মা তারার নাম। বিপত্তারিণী পুজোয় মূলত মা চণ্ডী পূজিত হন, কোথাও কোথাও জয়দুর্গা বা কৌশিকী। তারা ও চণ্ডীর অভিন্নতার সাক্ষ্য দেয় বিপত্তারিণী ব্রত।
★৫. বিপত্তারিণী পুজোয় মন্ত্রপূত লাল সুতোর রক্ষাসূত্র কব্জিতে বাঁধার প্রথাও প্রাচীনত্বের স্মারক। লাল রঙ সেই প্রাচীন প্রস্তর যুগ থেকেই মাতৃধর্মের রঙ, বিপত্তারিণী পুজোয় লাল জবা ফুল প্রয়োজন হয়। হাতে লাল (পলা) এবং সাদা (শঙ্খ) বলয় ধারণ করার প্রথা হরপ্পা সভ্যতা থেকে চলে আসছে। আবার তাঁত এবং তন্তুজাত দ্রব্যাদি, যার প্রতীক এই সুতো, তা ছিল প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারিগরি উদ্ভাবন। তন্ত্র শব্দটিই তন্তু থেকে এসেছে (তনুকে ত্রাণ – এই অর্থ অনেক পরে তৈরি, আদি অর্থ ছিল তন্তুবয়নের মত, পরস্পর সংযুক্ত সাধনপদ্ধতি গেঁথে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন নির্মাণ)। এই সেদিন মধ্যযুগেও বাংলাকে পৃথিবীর তাঁতঘর বলা হত। আগ্রহীরা গুগল করুন, “সিন্ধু থেকে সুতানুটি তমাল দাশগুপ্ত”, একটি চমৎকার প্রবন্ধের সন্ধান পাবেন যা সপ্তডিঙা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল কয়েক বছর আগে।
★৬. মঙ্গল ও শনির গুরুত্ব আমাদের মধ্যে এক রকমের সৌর তন্ত্রের প্রভাব, যা রোমান জ্যোতির্বিদ্যা, বৈশাখী নববর্ষ প্রচলন, সপ্তাহমূলক গণনা (আগে চান্দ্র তিথিমূলক শুক্ল ও কৃষ্ণ পক্ষ মেনেই কেবল গণনা হত), মঙ্গলবার মায়ের মঙ্গলকাহিনী শ্রবণ করার প্রথা (মঙ্গলকাব্য) এবং মা কালীর ক্ষেত্রপাল দ্বারপাল হিসেবে গ্রহরাজ শনিদেবের জনপ্রিয়তার সঙ্গে জড়িত। আমরা সৌরধর্মকে পৌরাণিক স্মার্ত পঞ্চ উপাসনার অংশ হিসেবেই জানি কেবল, কিন্তু আসলে সৌরতন্ত্রমতে নবগ্রহ পূজিত হতেন, কেবল সূর্যের উপাসনা হত না আমাদের দেশে। এবং নবগ্রহ উপাসনার প্রাচীন স্মারক হিসেবেই আমাদের মাতৃধর্মের মধ্যে শনি মঙ্গলের গুরুত্ব।
★৭. এই বিপত্তারিণী ব্রতে মঙ্গল ও শনিবার মায়ের নাম করে যে তন্তু আমরা কব্জিতে বাঁধি, তা তন্ত্রের অসীম শক্তির প্রতীক। পালযুগের তন্ত্রধর্মে মা পঞ্চরক্ষার উপাসনা হত যিনি সমস্ত বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করতেন, আজ মা রক্ষাকালীর উপাসনায় সেই রেশ আছে। মা বিপত্তারিণীও রক্ষামাতৃকা, তিনি সমস্ত আধিদৈবিক বিপদ থেকে আমাদের তারণ করেন।