Monday, December 23, 2024
Homeবাঙালির ইতিহাসউড্ডিয়ানের বিশিষ্ট সাধনক্রম ও তার গুরুত্ব নির্ণয়

উড্ডিয়ানের বিশিষ্ট সাধনক্রম ও তার গুরুত্ব নির্ণয়

উড্ডিয়ান। শুধু এই নামটিই বাঙালির ইতিহাস বিষয়ে ওয়াকিবহাল পণ্ডিতবর্গের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট। পাল ও সেনযুগের তন্ত্রচর্চার প্রধানতম কেন্দ্র এই উড্ডিয়ান। একাধিক তিব্বতী সূত্র অনুযায়ী এখানেই উৎসরণ ঘটেছিল বজ্রযান তন্ত্রের। শূন্যতার সাথে আলোচিত প্রজ্ঞা ও মহাকরুণা বজ্রযানের পথে বৃহৎ বঙ্গের আবহমানকালের মাতৃকা উপাসনা ধর্মের অগণিত মাতৃকার রূপ পরিগ্রহ করেন এবং দার্শনিক তত্ত্বের উচ্চতা থেকে গণধর্মের ভূমিতে অবতীর্ণ হন। এখানেই উড্ডিয়ানের গুরুত্ব। মননশীলতার জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে একটি দিশাহীন জাতিকে নৈরাজ্যের অন্ধকার থেকে গৌরবের উত্তুঙ্গে উত্তরণের মার্গ দেখিয়েছিল এই উড্ডিয়ান। আবার বৌদ্ধতন্ত্রের গ্রন্থসমূহ থেকে জানা যায় কালক্রমে বজ্রযান জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠলে দশম শতাব্দীর মধ্যভাগে এই উড্ডিয়ানেই সিদ্ধাচার্য নারোপা ও নিগু ডাকিনীর মাধ্যমে বজ্রযান থেকে সহজযানের উত্থান ঘটে। চুরাশি সিদ্ধের গৌরবময় পরম্পরা শুরু হয় এই উড্ডিয়ানকে কেন্দ্র করে। অর্থাত্ উড্ডিয়ান কোনো অচলায়তনে পর্যবসিত না হয়ে এক নিয়ত পরিবর্তিত বৈপ্লবিক জ্ঞানপীঠ রূপেই বাঙালির চেতনাকে আলোকিত করেছিল।

তন্ত্র অনুযায়ী সতীর দেহখণ্ডের ওপর নির্মিত আদি চারটি পীঠ ( জলন্ধর, পূর্ণগিরি, উড্ডিয়ান ও কামরূপ) এর অন্যতম এই উড্ডিয়ানপীঠ। কিন্তু আজও এই গুরুত্বপূর্ণ পীঠের অবস্থান অজ্ঞাত। উৎকলের পুরুষোত্তম ক্ষেত্র; মগধের ওদন্তপুর; বঙ্গের বজ্রযোগিনী গ্রাম; হিমালয়ের সাংগ্রিলা; একাধিক স্থানকে এই পীঠের সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু উড্ডিয়ানের অবস্থান নির্ণয়ের বিষয়টি এতটাই চিত্তাকর্ষক যে উড্ডিয়ানের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য প্রায় অনালোচিতই থেকে গেছে। সেটি হল এই পীঠের বিশিষ্ট সাধনক্রম।
সাধনমালা ও গুহ্যসমাজতন্ত্রে বজ্রযানী ও সহজযানী মাতৃকাদের যে সাধনক্রমসমূহ আলোচিত হয়েছে সেখানে প্রায়ই উড্ডিয়ানের এক একটি নিজস্ব ক্রম দেখা যায়। সেই ক্রমগুলিকে উড্ডিয়ান-বিনির্গত, উড্ডিয়ানপীঠান্তর্গত উড্ডিয়ান তন্ত্রোক্ত প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হল এই সমস্ত সাধনক্রমে বজ্রবারাহী, কুরুকুল্লা, নৈরাত্মা, আর্যতারা, আর্যজাঙ্গুলি, মারীচি প্রভৃতি দেবীর উগ্র রিপুদলনী রূপই প্রাধান্য পেয়েছে। এই রূপগুলির প্রতিটিই বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। তবে সংক্ষেপে বলতে গেলে এই সমস্ত রূপের কয়েকটি সাধারণ সাদৃশ্য চোখে পড়ে। মাতৃকাগণের সাধনক্রম অন্যত্র যেমনই হোক না কেন; উড্ডিয়ান তন্ত্রে তাঁরা সকলেই রণোন্মত্তা, রুধিরলিপ্তা, নৃত্যরতা।ক্রোধহাস্যে তাঁদের আনন দীপ্ত অথচ ভীষণ, এবং প্রণিধানযোগ্য বিশেষত্ব তাঁরা সকলেই মুণ্ডমালিনী এবং ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা।

মাতৃকার সৌম্য রূপের পাশাপাশি এই ভয়ঙ্করী রূপের উপাসনার একটি নিগূঢ় তাৎপর্য আছে। নিজের সংস্কৃতিকে সম্ভাব্য আঘাতের থেকে সুরক্ষিত না করতে শিখলে; কৃষ্টির পথে অতন্দ্র প্রহরার ব্যবস্থা না করলে সংস্কৃতির মূলান্বেষণ এবং অন্তর্নিহিত মাধুর্যের অনুসন্ধান করা যায় না। উদাহরণ স্বরূপ নৈরাত্মার উড্ডিয়ান ক্রমের রূপটি লক্ষণীয়। নৈরাত্মা হলেন যোগিনীমুখ্যা; আবার ইনিই ডাকিনী অর্থাত্ প্রজ্ঞা দান করেন। নৈরাত্মা অর্থে কৈবল্য বা মোক্ষ, এমন দশা যেখানে সমস্ত আত্মবোধ লুপ্ত হয়েছে। ইনিই চর্যাপদে উল্লিখিতা বেদাতীতা ডোম্বী। উড্ডিয়ান ক্রমে এই নৈরাত্মা মুণ্ডমালিনী, এবং পদ্মোপরি নৃত্যরতা। অর্থাত্ কৈবল্য বা জ্ঞানপারম্যের বিশুদ্ধ প্রকাশকে এখানে ভীষণা মাতৃকার রূপ দেওয়া হয়েছে। আবার এই একই বিষয় সমকালীন অন্যান্য তন্ত্রেও পরিলক্ষিত হয়। তন্ত্ররাজ গ্রন্থে শান্ত লালিত্যময়ী হাস্যযুক্তা ত্বরিতার ধ্যানে তাঁর দ্বারদেবী স্ফেটকারার উল্লেখ পাই; যিনি উগ্রা এবং ধনুঃশরধারিণী। অর্থাত্ বহিরঙ্গে এক ভীষণা রণরঙ্গিনী, অন্তরঙ্গে ললিতভাবের বিগ্রহ; পালযুগের বাঙালি এভাবেই জাতীয় জীবনের মধুরভাবটিকে রক্ষা করতে বহিঃশত্রুর সামনে ভীষণরূপা মাতৃকার মূর্তি উপস্থাপিত করেছিল এবং এই বিষয়ে পথিকৃৎ ছিল উড্ডিয়ানের বিশিষ্ট সাধনক্রম।

এছাড়া এই রূপসমূহের আর একটি অপূর্ব দিক রয়েছে। বজ্রযানে উপাসিতা মাতৃকাদের এই বিশিষ্ট রূপসমূহের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলিকে আলাদা করে লক্ষ করলে বাঙালির প্রাণের দেবী কালিকার উৎসরণের মার্গও সহজেই চোখে পড়ে। এই সমস্ত রূপের মধ্যে রণোন্মত্ত; ক্রুদ্ধ; নৃত্যরতা, নৃমুণ্ডমালিনী যে মাতৃকার ছায়াসম্পাত ঘটেছে তিনিই পালযুগের মধ্যভাগ থেকে ধীরে ধীরে কালীর বর্তমান রূপ ধারণ করেছেন। এই সময়েই সমগ্র উত্তরাপথ ও দাক্ষিণাত্যে কালিকার অগণিত মূর্তি নির্মিত হয়েছে। এই সময়েই চর্চিকার রূপে ভয়হারিণী মাতৃকা বাঙালির হৃদয়ের পরম আশ্বাসের কেন্দ্র হয়ে উঠেছেন। আবার বজ্রযোগিনী, নৈরাত্মা ও বুদ্ধডাকিনীর মণ্ডলেও কালীর আবির্ভাব ঘটেছে। মহাকালের মণ্ডলের দক্ষিণ পূর্বে তাঁর অবস্থান মহাকালের সাথে অভিন্নতার দ্যোতক। এবং এই মণ্ডলকল্পনা তাঁকে পুরুষ ও নারী এই উভয়রূপেই মূর্ত করে তুলেছে। উড্ডিয়ান বিনির্গত কুরুকুল্লার রূপ কালীর পঞ্চদশ নিত্যাশক্তির মণ্ডলে আত্তীকৃত হয়েছে। পাণ্ডুরাজার ঢিবি ও গঙ্গারিডি সভ্যতার পক্ষীমাতৃকার মধ্যে যে রূপ নিহিত ছিল; পালযুগের উড্ডিয়ান পীঠে তাঁরই পুনরাবির্ভাব ঘটেছে। এবং অগণিত সাধনক্রম এই ভীষণা ভয়হারিণী রূপের সুরক্ষাকবচের অন্তরালে দীর্ঘকাল বাঙালির মননে মাধুর্যের সঞ্চার করেছে।

আরো একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল এই রূপসমূহের বেশ কয়েকটিতে( আর্যজাঙ্গুলি, আর্যতারা) মাতৃকা ‘কুমারীভাবসম্পন্না’, অর্থাত্ তাঁর কোনো কনসর্ট বা পতি নেই। আবার বেশ কয়েকটি রূপের( ওড়িয়ান মারীচি; উড্ডিয়ান-বিনির্গত কুরুকুল্লা) মুকুটে কুলচিহ্ন অনুপস্থিত। অর্থাত্ বজ্রযানের সীমা ছাড়িয়ে অদ্বৈতা পরমা প্রকৃতির রূপই এই সাধনক্রমে প্রাধান্য লাভ করেছে। যে আর্যতারা বজ্রযানের সূচনাকালে অবলোকিতেশ্বরের করুণার মূর্ত রূপ; তিনিই সেনযুগে গৌরী গিরিজা মনসা মঙ্গলা প্রমুখ মাতৃকার সাথে একীভূত এবং বিশ্বজননী রূপে আরাধিত। বিশেষ কোনো ‘যান’ বা আচারের সীমা পেরিয়ে একাধিক মাতৃকার আবহমান ধারণার এই যে সংযুক্তি পাল ও সেনযুগে ঘটতে পেরেছিল; তার পিছনে উড্ডিয়ান সাধনক্রমের বিশেষ ভূমিকা বর্তমান।
সাঙ্খ্য ও আদিতন্ত্রের প্রকৃতি নিত্যা; জগতকারণ। অথচ দীর্ঘদিন পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাবে তন্ত্রের এই কেন্দ্রীয় ধারণাটি বিকৃত হয়েছিল। ভীষণা কুমারীরূপিণী মাতৃকাদের মাধ্যমে যেন বাঙালির চেতনা সেই বিকৃতি থেকে মুক্ত হয়েছে। যোগিনীতন্ত্রে যে মনসার সাধনক্রমে গৌড়ী নাগবল্লভা সাধনক্রমে নানা অভিচারের বাহুল্য দেখা যায়; পৌরাণিক কাহিনীতে যে মনসাকে কখনও শিবের কখনও জরৎকারু ঋষির প্রভুত্বের মুখাপেক্ষী করা হয়েছে; সেই সৌম্যা সর্পমাতৃকা উড্ডিয়ান-বিনির্গত-আর্যজাঙ্গুলি রূপে সপ্তনাগের ফণায় নৃত্যরতা, কুমারীরূপা, গুঞ্জাফুলের মালাধারিণী, ত্রিনেত্রা, ত্রিমুখী, মুখে ক্রুদ্ধ হাসির রেখা, হস্তে বজ্র, খড়্গ, ধনুর্বাণ, তর্জনীমুদ্রা ও বিষপুস্তক শোভিত। বজ্রজ্বালায় তাঁর কান্তি অতি ভীষণ হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে শত্রুনিপাতের উগ্রতা এবং বিষবৈদ্যের করুণা ও প্রজ্ঞা তাঁর এই ধ্যানে ধৃত হয়েছে। এরপরেই মধ্যযুগ পর্যন্ত সর্পমাতৃকার উপাসনার ব্যাপক গণধর্মীয় অভ্যুত্থান লক্ষ করা যায় যা সম্ভবত এই অভিনব সাধনক্রম থেকেই শক্তি সংগ্রহ করেছে।

উড্ডিয়ান বর্ণিত ক্রমে মাতৃকাগণ প্রাচীন বাঙালির হৃদয়ে একই সঙ্গে প্রজ্ঞা করুণা ও নির্ভরতার অসীম আধাররূপে অধিষ্ঠিতা ছিলেন। চর্যাপদের কবি নৈরাত্মার নৃত্য দেখে বলেছেন:
এক সো পদুম চৌষট্টি পাখুরি
তহি চড়ি নাচত ডোম্বী বাপুড়ী

কখনও বেদাচার ও হীনযানের ঊর্ধ্বে সহজযানের মহিমা কীর্তন করে বলেছেন:
নগর বাহিরে ডোম্বী তোহারি কুড়িআ
ছুঁই ছুঁই যাওত ব্রাহ্মণ নাড়িআ

গুঞ্জাফুলের মালায় সেজে ওঠা জাঙ্গুলির রূপ দেখে পদকর্তা বলেছেন:
উঁচা উঁচা পাবত তহি বসই শবরী বালি
মোরঙ্গ পিচ্ছ পরহিণ শবরী গিবত গুঞ্জরীমালী

সংস্কৃতির মধুর রূপটিকে আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে দ্বারপথে ভীষণ সাধনক্রমের প্রহরা রাখা প্রয়োজন। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উড্ডিয়ান সাধনক্রমের মাধ্যমে গৌড়বঙ্গের রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছিল। যখন আমরা দেখি মধ্যযুগে বৈষ্ণব পদাবলীর অমর দুই পদকর্তা চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি যথাক্রমে বাশুলিচণ্ডী ও চর্চিকার বন্দনা করেছেন, নিত্যানন্দ মহাপ্রভু মস্তকে অপরাজিতা বিগ্রহ ধারণ করেছেন; তখন বুঝি, এক নিরবচ্ছিন্ন পরম্পরা পাল-সেনযুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই পথেই মহাকালের উপাসক বিরূপা, বজ্রযোগিনীর সাধক মৈত্রীপা ও নারোপা অপূর্ব চর্যাপদের রচনা করেছিলেন; সেনসভায় উগ্রমাধবের বন্দনা করে কুশেশ্বর মন্দিরের ত্রিপুরাসুন্দরী যন্ত্রে জয়দেব গীতগোবিন্দ কাব্যের মধুরকোমলকান্তপদাবলী রচনা করেছিলেন। উড্ডিয়ান এই বিষয়ে সমগ্র বৃহৎ বঙ্গের পথপ্রদর্শক ছিল। আবার উড্ডিয়ান সাধনক্রমেই আমরা স্পষ্টভাবে বাঙালির প্রাণের মাতৃকা কালীর বর্তমান রূপের পদধ্বনি শুনতে পাই। উগ্র রূপের আড়ালে কৈবল্যদায়িনী শ্যামা মায়ের মধুর হাসি সেই সময় থেকেই বাঙালির চিত্তকে বিমোহিত করেছে; যা আজও সগৌরবে বর্তমান। উড্ডিয়ান পীঠ তাই কালীরূপের উৎসরণের মহাপীঠও বটে।

রক্তিম মুখার্জি

তথ্য ও ছবি কৃতজ্ঞতা তমাল দাশগুপ্ত মহাশয়

shoptodina.com
shoptodina.comhttps://shoptodina.com
সপ্তডিঙা। কথাটা শুনলেই মনে আসে বাঙালির সমুদ্রবাণিজ্যের এক গৌরবময় ইতিহাস। গৌড়ের বণিকরা সাতটি বিশাল নৌকার এই সমবায় নিয়ে সিংহল, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, চীন, রোম, গ্রীস, ক্রীট, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করে ফিরে আসতেন স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার নিয়ে। সপ্তডিঙা তাই বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির অভিজ্ঞান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Advertisingspot_img

Popular posts

My favorites