কঠিন ছিল, দীর্ঘ শতবছরস্থায়ী মাৎস্যন্যায় যুগের অন্ধকার কাটিয়ে ওঠা সহজ ছিল না। সেজন্য পালসাম্রাজ্যের স্থপতি গোপালের কাহিনী প্রত্যেক বাঙালির কাছে শিক্ষণীয়। গোপাল সম্পর্কে যা যা জানা গেছে, বাঙালির জন্য এই ক্যাপসুল-স্টেটাসে পুরোটা রইল।
তাঁর কোনও মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়নি, তাঁর কোনও তাম্রশাসন বা শিলালিপি পাওয়া যায় না, তাঁর কোনও জীবনী লিখে যান নি কোনও সভাকবি। গোপাল সম্পর্কে আমরা জানতে পারি তাঁর সুযোগ্য পুত্র, পরবর্তীকালের ভারত যাঁকে “সকলোত্তরপথস্বামী” অভিধায় মনে রেখেছে, সেই ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসন থেকে। এছাড়া হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অষ্টসাহস্রিকাপ্রজ্ঞাপারমিতার একটি টীকা খুঁজে পেয়েছিলেন, হরিভদ্র রচিত, যাতে পালদের “রাজভটবংশাদিপতিত” (বৌদ্ধধর্মীয় খড়্গ রাজবংশর রাজা ছিলেন রাজভট, সমতট অঞ্চলে রাজত্ব ছিল) বলা হয়েছিল, যদিও পালরা নিজেদের এই উৎসের কথা কোনওদিন বলেন নি, বলার কথাও না যদি বংশপতিত হয়ে থাকেন, কারণ এই শব্দের ইঙ্গিত প্রান্তিকতার। আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প পালসম্রাটদের “দাসজীবিনঃ” বলছে। দাসবংশীয় বললে অনেক কিছু বোঝাতে পারে। যেমন কৈবর্তজাতির একটি নাম দাসজাতি (দস্যু থেকে দাস এসেছে, আদতে নামটি আর্যাবর্তের দেওয়া)। আবার গোবলয়ের কাছে চিরকালই বাঙালি মাত্রেই শূদ্র, সেজন্য পালরাও দাস, এরকমও অর্থ হতে পারে।
এছাড়া তিব্বতী ইতিহাসবিদ তারনাথ (অনেক পরে অবশ্য, ১৬০৮ সালে) গোপাল সম্পর্কে কিছু কিংবদন্তী লিখে গেছেন। তার একটি হল এই যে পালবংশ সমুদ্রসম্ভূত ছিলেন। রামপালের সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দী গোপালের পুত্র ধর্মপালকে সমুদ্রকুলদীপ বলেছেন। পালযুগের অনেক পরে এমনকি মধ্যযুগেও ধর্মমঙ্গলে ঘনরাম লিখেছেন যে দেবপালের জন্ম সমুদ্রদেবতার ঔরসে। সমতট থেকে এসেছিলেন পালরা, সেজন্য সমুদ্রবংশীয়?
কিন্তু পালদের “জনকভূ” ছিল বরেন্দ্রভূমি, সেটাও সন্ধাকর বলেন। সমতট আর বরেন্দ্র, অর্থাৎ দক্ষিণ থেকে উত্তর পর্যন্ত একত্রে বন্ধন করেছিলেন সেক্ষেত্রে বাঙালি জাতিকে গোপাল?
পালরাজারা নিজেদের উৎস সম্পর্কে কোনও পৌরাণিক ইনভেন্টেড ট্র্যাডিশন বানান নি, অর্থাৎ অমুক সূর্য বা চন্দ্রবংশীয় বলে মহাকাব্য বা পুরাণের নায়কদের বংশধর বলে নিজেদের পরিচয় দেন নি। যাঁরা ভারতের বাকি অঞ্চলগুলোর রাজন্যদের ইতিহাস সেভাবে জানেন না, তাঁরা বুঝতে পারবেন না এর মারাত্মক গুরুত্ব। এবং বাঙালির ইতিহাস কেন কাল্পনিক আস্ফালন বরদাস্ত করবে না, বাকিদের মত আমাদের ইতিহাসচর্চায় আমরা কেন মিথ্যা, কল্পনা বা মিথের আশ্রয় নেব না, সে আশ্রয় আমরা নিই নি কখনও, সেটা না বুঝলে বাঙালির শেকড়ের অনুসন্ধান করা যায় না। পালদের নথি পাঠ করার সময় এটি ধ্রুবতারার মত মনে রাখতে হয়।
ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসন জানায়, গোপালের পিতা ব্যপট ছিলেন “খণ্ডিতারাতি”, অর্থাৎ তিনি অরাতি (শত্রু) খণ্ডন করতেন। যোদ্ধা ছিলেন। গোপালের পিতামহ দয়িতবিষ্ণু ছিলেন “সর্ব-বিদ্যা-বিশুদ্ধ” “সর্ব-অবদাত”, অর্থাৎ সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত। তিনি অধ্যাপনা করতেন। মাৎস্যন্যায় যুগ, তাই অধ্যাপকের ছেলেকেও যোদ্ধা হতে হয়েছিল।
ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসনে বলছেঃ “মাৎস্যন্যায় দূর করিবার অভিপ্রায়ে, প্রকৃতিপুঞ্জ যাঁহাকে রাজলক্ষ্মীর করগ্রহণ করাইয়াছিল, পূর্ণিমা রজনীর জ্যোৎস্নারাশির অতিমাত্র ধবলতাই যাঁহার স্থায়ী যশোরাশির অনুকরণ করিতে পারিত, নরপাল-কুলচূড়ামণি গোপাল নামক সেই প্রসিদ্ধ রাজা ব্যপট হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন” (রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়)।
কোনও একটি বহিরাগত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে (সম্ভবত কামরূপ) সফল প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গোপাল, এবং তার পরেই তাঁকে নেতৃত্বপদে বরণ করেছিল বাঙালি জাতি।
গোপাল যে পালসাম্রাজ্য সৃষ্টি করেন, সেটা সাড়ে চারশো বছর ধরে রাজত্ব করেছিল। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কম রাজবংশ আছে এত দীর্ঘস্থায়ী।
তারনাথ লিপিবদ্ধ করেছেন যে জনশ্রুতি, তা অনুযায়ী গোপাল উপাসনা করতেন বজ্রযানী তান্ত্রিক দেবী চুন্দার।
প্রথম পালসম্রাট গোপালের আরাধ্য দেবী ছিলেন চুন্দা, লামা তারানাথের বর্ণনায় জানতে পারি।
তান্ত্রিক দেবী চুন্দাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাদের বাঙালিদের, যার জন্য আর্যাবর্তের ব্রাহ্মণ্য হিন্দুত্ব দায়ী। পরবর্তীকালে হিন্দি শব্দ চুড়েলের মধ্যে এই চুন্দা অন্তর্নিহিত আছেন বলে সুকুমার সেন মনে করেন।
চুন্দা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ সার্কিটে জনপ্রিয় ছিলেন। জাভা, মঙ্গোলিয়া, জাপান, চীন, সর্বত্র তিনি পূজিত হতেন। ইলোরার গুহাচিত্রে চুন্দা আছেন। অষ্টসহস্রিকাপ্রজ্ঞাপারমিতার একাদশ শতকের একটি পুঁথিতে পট্টিকেরা (এখনকার নোয়াখালি-কুমিল্লা-ত্রিপুরা) অঞ্চলে পূজিত চুন্দার চিত্র আছে, এছাড়া রাঢ়দেশে পূজিত চুন্দার ছবিও পাওয়া গেছে এই পুঁথিতে।
চুন্দার (চুন্দি নামেও ডাকা হয়) সঙ্গে চন্দ্রী/চন্দ্রা/চণ্ডী হল cognate, এরকম ভাবা হয়। জাপানে তাঁকে শিবের স্ত্রী অর্থাৎ শক্তি/দুর্গার সঙ্গে এক ভাবা হয়েছে। তাঁকে শরৎকালের চাঁদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। পালযুগে তাঁর উপাসনা সম্ভবত শরত কালে হত। পূজার মন্ত্র ছিল “ওম চলে চুলে চুন্দে স্বাহা”।
চুন্দার হাতে মুদ্গর (গদা), কুন্ত (ভল্ল), বজ্র, পাত্র/কলস, পদ্ম, দণ্ড, অনেক সময় পুস্তক। চতুর্ভুজ থেকে শুরু করে দ্বাদশভুজ, অষ্টদশভুজ এমনকি ছাব্বিশহস্ত চুন্দার মূর্তিও পাওয়া গেছে, আমাদের দশভুজা দুর্গার কল্পনায় অবশ্যই চুন্দা মিশে আছেন। তিনি মূলত প্রজ্ঞার দেবী। তাঁকে সপ্তকোটি বুদ্ধের জননী বলা হয়। চুন্দাকে ধারিণী বলা হয়েছে, এবং এই ধারিণীরূপে তাঁকে ধ্যানী বুদ্ধ বৈরোচন এবং অমোঘঘোষের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।
আগেই বলেছি, গোপালের কোনও মুদ্রা, তাম্রশাসন বা ভূমিদানপট্টোলী, শিলালিপি, জীবনী পাওয়া যায় না। তাঁর কোনও প্রতিকৃতিও নেই। সঙ্গের ছবিটি ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসনের।