Monday, December 23, 2024
Homeকালীক্ষেত্র আন্দোলনলক্ষ্মী ও মনসা: বাঙালির উপাস্য দুই মাতৃকার আশ্চর্য সাদৃশ্য

লক্ষ্মী ও মনসা: বাঙালির উপাস্য দুই মাতৃকার আশ্চর্য সাদৃশ্য

লক্ষ্মী ও মনসা—এই দুই দেবী বাঙালির উপাস্য মাতৃকারূপে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য বিদ্যমান, যা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। -লিখেছেন রক্তিম মুখার্জ্জি

মনসা নাগমাতা। উনকোটি নাগ তাঁর সন্তান। অন্যদিকে নাগ শব্দের অন্য অর্থ গজ বা হাতি। গজের সাথে লক্ষ্মীর সংযোগ অত্যন্ত প্রাচীন। তাঁর গজলক্ষ্মী, আদিলক্ষ্মী, মহাবিদ্যা কমলা প্রভৃতি রূপে গজরাজ তাঁর অভিষেক করাচ্ছেন। এবং বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বাঙালির ভূখণ্ড যেমন একদিকে সর্পসঙ্কুল, অন্যদিকে তেমনই হস্তিবাহিনীর জন্য প্রসিদ্ধ ছিল।

মনসার তত্ত্বে জলময়ী মাতৃকার প্রবল উপস্থিতি। জলধারার সর্পণ অর্থাত আঁকাবাঁকা পথে সঞ্চারণ এবং সর্পরাজ্ঞীর যোগ তো বটেই। আজও গঙ্গার এই ভূখণ্ডে অবতরণের তিথি দশহরা মনসাপূজার জন্য নির্দিষ্ট। এছাড়া তাঁর জগতগৌরী রূপে মিশে আছে জলময়ী মাতৃকা গৌরীর উপস্থিতি। বেদে তিনিই জল কেটে কেটে একপদী দ্বিপদী চতুষ্পদী অষ্টাপদী নবপদী ছন্দ রচনা করেন যা পরমব্যোমে সহস্রাক্ষর হতে ইচ্ছা করে। মনসা পদ্মাবতী; পদ্মবনে বাস করেন। তাঁর সহচরী নেতা ( নিত্যা/নেত্রা); যাঁর আবির্ভাবের সাথে অশ্রুসিক্ত নেত্রের প্রসঙ্গ মিশে আছে। অন্যদিকে লক্ষ্মীও পদ্মা; পদ্মালয়া। তাঁর আবির্ভাব সমুদ্র থেকে।

সমুদ্রবাণিজ্যে সারা পৃথিবীতে একাধিপত্যের যুগে বাঙালির জাতীয় জীবনেও লক্ষ্মী সমুদ্রসম্ভবা ছিলেন। সমুদ্রবাণিজ্য করেই বাঙালি বণিক সিংহল, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, রোম, গ্রীস, এশিয়া মাইনর থেকে স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার আনতেন। কমলা ও গজলক্ষ্মী রূপে চারটি গজরাজের শুঁড়ে ধরা কুম্ভের জলে তাঁর অভিষেক হয়। এ হল কল্যাণের মূর্ত প্রকাশের সাথে জলের সংযোগের প্রাচীন তত্ত্ব।

লক্ষ্মী শস্যদায়িনী। ভূমিতে উৎপন্ন সমস্ত শস্য তাঁর আশীর্বাদ। তাই তাঁর প্রাচীন মূর্তির মুকুটে ধানের শিস, হাতে শস্যের মঞ্জরী। অন্যদিকে মনসার বিভিন্ন কাহিনীতে মৃত্যু ও পুনর্জন্মের বারংবার উল্লেখের একটি ব্যাখ্যা কৃষির রূপকে করা যায়। মনসামঙ্গলের জনপ্রিয় কাহিনীতে শ্রাবণ মাসে লখীন্দরের মৃত্যুর ছয় মাস পরে অর্থাত পৌষ মাসে লখীন্দরের বেঁচে ওঠার মধ্যেও যুক্ত হয়েছে বর্ষা থেকে হেমন্তের শেষ পর্যন্ত কৃষির ষান্মাসিক চক্রের দ্যোতনা।

 

লক্ষ্মী মনসা

মনসা একদিকে বিষদৃষ্টিতে সংহার করেন। অন্যদিকে তিনিই বিষহরী রূপে বিষবিদ্যার অধিশ্বরী। অমৃততত্ত্ব প্রদান করে বিষ হরণ করেন। নাগিনী কন্যার কাহিনীতে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় হিজলের বেদে জাতির মধ্যে প্রচলিত মনসার এক রূপ বর্ণনা করেছিলেন। সেখানে তিনি অজগরের কুণ্ডলীতে বিষধর সর্পের আভরণ ধারণ করে অধিষ্ঠিতা। হাতের শঙ্খ থেকে বিষ কন্ঠে ঢেলে আবার উগরে দেন বিষকুম্ভে। এই বর্ণনা মনে করিয়ে দেয় লক্ষ্মীর কমলেকামিনী মূর্তি। তিনিও সমুদ্রের মধ্যে পদ্মের উপর বসে কোলের হাতিকে একবার গ্রাস করেন; আবার উগরে দেন। একই সাথে সৃষ্টি ও বিনাশ কারিণী, ভয়ঙ্করী এবঃ অভয়া কালরূপা মাতৃকার যে তত্ত্ব আমাদের সাধনদর্শনে সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে আছে; মনসা ও লক্ষ্মীর এই দুই রূপ তারই অসামান্য দৃষ্টান্ত। বস্তুত আমরা লক্ষ্মীর সৌম্য রূপেই অভ্যস্ত বটে। কিন্তু অসুরনাশিনী মহালক্ষ্মীর বিবরণ শ্রীশ্রীচণ্ডীতেই আছে। এছাড়া চমকপ্রদভাবে তিনি চামুণ্ডার সাথেও অভিন্ন হয়েছেন তন্ত্রে। পেঁচা বাহন বিশিষ্ট চামুণ্ডার বিগ্রহ তার একটি দৃষ্টান্ত।

মনসা যোগ ও তন্ত্রে কুণ্ডলিনী শক্তির প্রকাশ। তিনি শ্রীকুলে ত্বরিতা রূপে পূজিতা। পরমা মাতৃকা রূপে লক্ষ্মীও কুণ্ডলিনী তত্ত্বে সহস্রারের শ্রীপীঠে অধিষ্ঠিতা।

পরিশেষে বলা যায় যে বাঙালি সর্পসংকুল নদীমাতৃক ভূখণ্ডে সমুদ্রবাণিজ্য করেছে আর যোগ তন্ত্র ও বিষবিদ্যার চর্চা করেছে এই দুই আপাত ভিন্ন মাতৃকার সমন্বয় ঘটানো তাঁদের পক্ষে একান্তই স্বাভাবিক।

shoptodina.com
shoptodina.comhttps://shoptodina.com
সপ্তডিঙা। কথাটা শুনলেই মনে আসে বাঙালির সমুদ্রবাণিজ্যের এক গৌরবময় ইতিহাস। গৌড়ের বণিকরা সাতটি বিশাল নৌকার এই সমবায় নিয়ে সিংহল, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, চীন, রোম, গ্রীস, ক্রীট, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করে ফিরে আসতেন স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার নিয়ে। সপ্তডিঙা তাই বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির অভিজ্ঞান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Advertisingspot_img

Popular posts

My favorites