বাঙালি মাত্রই আজ বিদ্যার দেবীর আরাধনায় মগ্ন। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, এককালে সারা পৃথিবীর নানা সভ্যতায় বিদ্যার আরাধনা প্রচলিত ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে শুরু করে মেসোপটেমিয়া, গ্রীস, রোম, পারস্য, এমনকি জাপান পর্যন্ত জ্ঞানের দেবীদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধার নিদর্শন পাওয়া যায়। লিখেছেন- ডঃ ঋতুপর্ণা কোলে।
পশ্চিমা দেশগুলির মতো প্রাচীন ভারত জ্ঞান-বিজ্ঞান-বিদ্যা চর্চায় যথেষ্ট উন্নত ছিলো। এই বিদ্যাচর্চার বাকি অন্যতম ধারাগুলি ছিলো যুদ্ধবিদ্যা, কলাবিদ্যা ইত্যাদি যা কিছু শেখার বিষয় সবই। প্রাচীন বিশ্বের কাছে জ্ঞান অর্জন, তাকে ধরে রাখা, তার উপযুক্ত প্রয়োগ এবং সেই জ্ঞানকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া ছিলো একদিকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অন্যদিকে ছিলো খুবই প্রতিবন্ধকতার একটা বিষয়। জ্ঞানকে রক্ষা করার জন্য দেব-দেবীর উপর ভরসা করাও খুব স্বাভাবিক চিন্তা।
আজ আলোচনা করবো প্রাচীন পৃথিবীর যত সভ্যতা আছে তাদের মধ্যে অন্যতম কিছু বিদ্যার দেবীকে নিয়ে।
সরস্বতী: জ্ঞান ও সৃষ্টিশীলতার দেবী
আজ দেবী সরস্বতীকেই বিশেষভাবে স্মরণ করার দিন। তাই সবার প্রথমে তাঁর কথাই বলা যাক। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন মাতৃকাদের মধ্যে দেবী সরস্বতী হলেন অন্যতম। তিনি বেদ পূর্ববর্তী ও বেদ পরবর্তী দুইযুগেই পূজিতা। তিনি একাধারে নদীমাতা, অন্যদিকে জ্ঞানের দেবী। তিনি যতটা বিজ্ঞানের ঠিক ততটাই কলাবিদ্যার। টানা পাঁচহাজার বছরের ধারাবাহিক ঐতিহ্য আজও প্রবহমান সরস্বতী পুজোর মধ্যে দিয়ে।
এবার আসা যাক সেইসব মাতৃকাদের কথায়। যারা নানা আগ্রাসনের মুখে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেন নি।
অন্যান্য সভ্যতার বিদ্যার দেবী
নিসাবা (মেসোপটেমিয়া)
মেসোপটেমীয় সভ্যতায় নিসাবা ছিলেন প্রজ্ঞার দেবী। তিনি একাধারে সরস্বতী ও লক্ষ্মীর মতো বিদ্যা ও শস্যের দেবী হিসেবে পূজিত হতেন। মেসোপটেমীয়দের কাছে জ্ঞানই ছিল সর্বোচ্চ সম্পদ, যা সমৃদ্ধি এনে দিত।
এথেনা (গ্রীস)
প্রাচীন গ্রীক সভ্যতায় এথেনা ছিলেন বিদ্যা, শিল্প, আইন, গণিত ও যুদ্ধবিদ্যার দেবী। প্রজ্ঞার প্রতীক হিসেবে পেঁচা ছিল তাঁর সঙ্গী, যা লক্ষ্মীর বাহনের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এথেনার হাতে ছিল জ্ঞানচর্চার অজস্র পুঁথি, যা তাঁকে সরস্বতীর সমান্তরালে স্থাপন করে।
মিনার্ভা (রোম)
রোমান সভ্যতার বিদ্যার দেবী ছিলেন মিনার্ভা, যিনি জ্ঞান, শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতীক। এথেনার মতোই তাঁকেও পেঁচার সঙ্গে একাত্ম করে দেখা হতো। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হওয়ায় তাঁর মধ্যে সরস্বতীর অসুরবধের বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়।
অনাহিতা (পারস্য)
পারস্য সভ্যতায় অনাহিতা ছিলেন একদিকে জল ও প্রজননের দেবী, অন্যদিকে জ্ঞানের প্রতীক। তবে তাঁর রূপ সবচেয়ে বেশি মিল খুঁজে পায় দশভুজা দেবী দুর্গার সঙ্গে, কারণ তিনিও অস্ত্রসজ্জিতা ও সিংহবাহিনী ছিলেন।
কামরূসেপা (হিটাইট সভ্যতা)
হিটাইট জাতির জ্ঞানের দেবী ছিলেন কামরূসেপা, যাঁকে হিটাইট লিপির দেবী হিসেবেও বিবেচনা করা হতো।
বেঞ্জাইতেন (জাপান)
ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতকের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে জাপানে সরস্বতীর অনুরূপ বিদ্যার দেবী বেঞ্জাইতেনের পূজা শুরু হয়। মঞ্জুশ্রী, প্রজ্ঞাপারমিতা ও সরস্বতীর মিশ্রিত রূপ হিসেবে তিনি বিদ্যা ও সংগীতের দেবী হিসেবে বিবেচিত হন।
বিদ্যার দেবী ও সভ্যতার ধারাবাহিকতা
প্রাচীন বিশ্বের বহু সভ্যতায় জ্ঞান ও বিদ্যার দেবীদের আরাধনা থাকলেও, নানা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই এই উপাসনার ধারা বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষে দেবী সরস্বতীর পূজা টিকে আছে হাজার বছর ধরে, যা আমাদের সংস্কৃতির স্থায়িত্ব ও শেকড়ের শক্তিকে প্রমাণ করে।
অনেকে প্রশ্ন করেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যার দেবীর আরাধনা কতটা প্রাসঙ্গিক? উত্তর সহজ—বিদ্যার ক্ষেত্রে বিদ্যার দেবীর আরাধনা স্বাভাবিক ও ঐতিহ্যের অংশ। দেবী সরস্বতী শুধু ধর্মীয় দেবী নন, তিনি জ্ঞানের প্রতীক। তাঁর আরাধনা কোনো সংকীর্ণ চিন্তার বিষয় নয়, বরং এটি জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ঐতিহ্য।
কেউ কেউ এই চর্চার বিরোধিতা করেন, কিন্তু তাঁদের অনেকেরই শেকড়ের প্রতি টান নেই। শেকড় বিচ্ছিন্ন এই মানসিকতার কাছে বাঙালি মাথা নোয়াবে না। কারণ সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাই জাতির শক্তি, আর সেই শক্তির অন্যতম প্রতীক দেবী সরস্বতী।
শুভ বসন্ত পঞ্চমী!