বাংলাভাগ বাংলার হিন্দুর জন্য আশীর্বাদ, কারণ এর ফলে বাংলাভাষী হিন্দুর নিজস্ব ভূখণ্ড, কালীক্ষেত্র পশ্চিমবঙ্গ বেঁচে যায় জেহাদি আগ্রাসনের হাত থেকে। লিখেছেন- অধ্যাপক তমাল দাশগুপ্ত
১. বাংলার হিন্দু সর্বসম্মতভাবে বাংলাভাগ করেছিল। অমৃতবাজার পত্রিকা সাতচল্লিশ সালে একটি সার্ভে করে যাতে দেখা যায় প্রায় একশ শতাংশ শিক্ষিত বাংলাভাষী হিন্দু (যাদের পত্রিকা হিসেবে অমৃতবাজার পত্রিকার অবিসংবাদী প্রতিষ্ঠা) বাংলাভাগ চাইছে।
২. ইংরেজ আমলে নানা কারসাজি করে বাংলার হিন্দুকে চিরন্তন সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়, ফলে আইনসভার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মুসলমানদের হাতে। ১৯৩৭-৪৭, এই দশ বছর তিনজন মুসলমান প্রধানমন্ত্রীর শাসনে ছিল অবিভক্ত বাংলা। সেই অভিশপ্ত অবিভক্ত বাংলায় বাঙালির নাভিশ্বাস উঠে গেছিল। ছেচল্লিশ সালে সরকারি মদতে বাংলার হিন্দুর এথনিক ক্লিনজিং করার পরিকল্পনা করেন প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী, যাকে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং বলা হয়, এবং এই সোহরাওয়ার্দী কলকাতার কশাই আখ্যা পান। কিন্তু এই সময় একজন সত্যিকারের কশাই, সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করা জেহাদি নন, সত্যিকারের বাঙালি কশাই প্রতিরোধ করতে উঠে দাঁড়ান, তাঁর নাম গোপাল পাঁঠা। সঙ্গে ছিলেন আরও অনেক বাঙালি বাহুবলী। ফলে সোহরাওয়ার্দীর জেহাদি বাহিনী এবং মুসলমান দারোগা বাহিনী পিছু হটেন।
প্রসঙ্গত পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের জনক আখ্যা পাওয়া মুজিব এই গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর সময় সোহরাওয়ার্দীর গুণ্ডা, তিনি লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ধ্বনি দেওয়া মুসলিম ছাত্র লীগের কাডার। বস্তুত যারা ছেচল্লিশ সালে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান করলেন, পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে তারা রাতারাতি “অসাম্প্রদায়িক” আওয়ামি মুসলিম লীগ বানিয়ে ফেললেন, এটা ইতিহাসের পরিহাস। এভাবে রাতারাতি কেউ অসাম্প্রদায়িক হয় না। আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে লাথি ঝাঁটা খেয়ে ওরা বুঝে গেছিলেন সার সত্য। ফলে পূর্ববঙ্গের বিরাট হিন্দু জনসংখ্যা (তখনও পঁয়ত্রিশ শতাংশ, আজ যা কমে মাত্র দশ শতাংশে দাঁড়িয়েছে)-র ভোট পাওয়া এবং তাদের ঘাড়ে চেপে নৌকো প্রতীককে ঘাটে ভেড়ানোর জন্য আওয়ামী লীগের উৎপত্তি। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক মুসলমান আসলে সিন্দবাদের বুড়ো, এরা একবার পশ্চিম পাকিস্তানীর ঘাড়ে চেপে বাংলা ভাগ করেন সাতচল্লিশ সালে, তারপর পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুর ঘাড়ে চেপে বাহাত্তর সালে একটি স্বাধীন দেশ! গ্যারি বাস তাঁর ব্লাড টেলিগ্রাম বইতে বলেন, তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের নব্বই শতাংশ হিন্দু। এই তথ্য ভারত সরকার চেপে রেখেছিল, পশ্চিমবঙ্গে এবং ভারতের হিন্দুদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে। সত্যকে চেপে রাখার ফল বিষময় সর্বদাই। আজকের বাংলাদেশ হিন্দুর লাশের ওপরে তৈরি, সে সত্যকে চেপে রাখার ফলে সেখানে জেহাদি অপশক্তির উত্থান অনিবার্য।
৩. একদা কংগ্রেসের বিগ ফাইভের একজন, কিন্তু সমকালীন রাজনৈতিক সমীকরণে সম্পূর্ণ ব্রাত্য শরৎ বসু (ইনি সুভাষ বসুর দাদা পরিচয়েই বিখ্যাত, কিন্তু রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে সুভাষ বসু এই জাঁদরেল ব্যারিস্টারের ভাই হিসেবে নানা সুবিধা পেয়েছেন, দেশপ্রাণ শাসমলকে টপকে কলকাতা করপোরেশনের অল্ডারম্যান হওয়া, উদাহরণ স্বরূপ) এই সাতচল্লিশ সালে হঠাৎ করে শিরোনামে উঠে আসেন, কলকাতার কশাই সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে একত্রে যুক্তবঙ্গ চেয়ে।
একদা প্রবল শক্তিশালী, কিন্তু আজ অপাংক্তেয়, রাজনীতিতে আকছার হয়। সাতচল্লিশ সালে নিজের রাজনৈতিক জমি পুনরুদ্ধার করতে মরিয়া হয়ে শরৎ বসু একটি যুক্ত বঙ্গ প্রস্তাব রাখেন সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। এটা নিছক গ্যাসবেলুন, প্রচুর গরম হাওয়া ছিল, কিছু উড়েছিল, অনেকটা আজকের বাংলায় জয় বাংলা ধ্বনি দেওয়া কাংলাপক্ষর মত, যাদের কোনও বাস্তব সমর্থন নেই, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু গরম হাওয়া আছে।। বাস্তবের মাটিতে এই যুক্ত বঙ্গপ্রস্তাবের পক্ষে কোনও সমর্থন ছিল না। কলকাতার কশাই সোহরাওয়ার্দীর জন্য কোনও সহানুভূতি দূরে থাক, সে ব্যক্তি যে নিজের পশ্চিমবঙ্গের সম্পত্তি বাঁচানোর জন্যই এই যুক্ত বঙ্গের ছল করছে, হিন্দুরা সবাই বুঝেছিল। শরৎ বসুর পক্ষে জনসমর্থন একেবারে ছিল না।
৪. আইনসভায় সাতচল্লিশ সালের বিশে জুন ভোটাভুটি হয়। যুক্ত বঙ্গের প্রস্তাব কেউ পেশ করেন নি, না সোহরাওয়ার্দী, না তার পক্ষের কেউ। প্রথমে ভোটাভুটি হয় সম্পূর্ণ অখণ্ড বাংলা ভারতে যাবে কি না, মুসলমান সদস্যদের সংখ্যাধিক্যে সে প্রস্তাব বাতিল হয়। এরপর ভোট হয় সম্পূর্ণ বাংলা পাকিস্তানে যাবে কি না, মুসলমান সদস্যরা মহা উৎসাহে সম্পূর্ণ বাংলাকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেন। কিন্তু ইংরেজ সরকার এই ভোটাভুটির সময় একটি রাইডার যোগ করেন। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলির বিধায়করা চাইলে বাংলাভাগ হবে এবং সেই খণ্ডবঙ্গ তখন ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হবে। এই বিষয়ে ভোটাভুটি হয়, এবং তখন মূলত বাংলার কংগ্রেসের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের বিধায়করা সবাই বাংলাভাগের পক্ষে ভোট দেন, সেখানে জ্যোতি বসু-সহ কমিউনিস্ট সদস্যরাও বাংলাভাগের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, এবং একই সঙ্গে বাংলাভাগের পক্ষে ভোট দেন হিন্দু মহাসভা, যাদের সদস্য সংখ্যা কমিউনিস্টদের মতোই অতি স্বল্প ছিল। বাংলা ভাগ হিন্দুর সর্বসম্মত, একমাত্র পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম বিধায়করা এর বিরুদ্ধে ভোট দেন, এরা পুরো বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে চেয়েছিলেন।
এই বাংলাভাগ বাংলার হিন্দুর জন্য আশীর্বাদ, কারণ এর ফলে বাংলাভাষী হিন্দুর নিজস্ব ভূখণ্ড, কালীক্ষেত্র পশ্চিমবঙ্গ বেঁচে যায় জেহাদি আগ্রাসনের হাত থেকে। এই বাংলাভাগ সেযুগে কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের ফলে সম্ভব হয়। বাংলাভাগ চেয়ে সবথেকে বেশি মিটিং মিছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বে হয়েছিল, এবং আইনসভার ভেতরেও তারাই মূল কাণ্ডারী ছিলেন বাংলাভাগের।
কিন্তু এরা সবাই সেযুগে বাংলা ভাগ করলেও পপুলেশন ট্রান্সফারে বাধা দেন। সাতচল্লিশ সালে হিন্দু মহাসভার একটি লিফলেট আমাদের চোখে পড়েছে যেখানে পূর্ববঙ্গের হিন্দুর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে যে তারা যেন পূর্বেই থাকেন, পশ্চিমবঙ্গে না আসেন। পশ্চিমবঙ্গ তৈরি হওয়ার পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী (তখনও প্রধানমন্ত্রী বলা হত) প্ৰফুল্ল ঘোষ তো পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে রীতিমত সভা করে বলে এসেছিলেন, কেউ যেন পশ্চিমবঙ্গে না আসেন। এরা সবাই একটি হিন্দুপ্রধান রাজ্যের ক্ষীরটুকু খেতে চেয়েছেন কিন্তু পূর্ববঙ্গের হিন্দুর দায় দায়িত্ব নিতে চান নি। বাংলার উদ্বাস্তু সমস্যা এজন্য আজও মেটে নি।
৪. বাংলাভাগের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মত, কারণ দশ বছর মুসলমানদের শাসনে বাস করেই নাভিশ্বাস উঠে গেছিল আমাদের পিতামহ প্রপিতামহদের। ছেচল্লিশ সালের কলকাতা আর নোয়াখালী দেখার পর সাতচল্লিশ সালে অবিভক্ত যুক্ত বঙ্গের কথা বলার জন্য বদ্ধ পাগল অথবা শরৎ বসু ছাড়া কাউকে পাওয়া অসম্ভব ছিল।
কিন্তু পঞ্চাশ সালে ঢাকা বরিশাল খুলনায় ভয়াবহ গণহত্যার আগে জনসংখ্যা বিনিময় দাবি কেউ তোলেন নি। দুই বাঙালি মন্ত্রী শ্যামা এবং কে সি নিয়োগী এই সময় পদত্যাগ করেন নেহরু ক্যাবিনেট থেকে, নেহরু লিয়াকত চুক্তির প্রতিবাদে। মেঘনাদ সাহা এই সময় জনসংখ্যা বিনিময় দাবি করেন। এগুলো কাগুজে দাবি হয়েই থেকে যায়।
পাঞ্জাবে যে পপুলেশন ট্রান্সফার হয়েছিল, তার জন্য কেউ নেহরুর সঙ্গে বিতর্ক করতে যায় নি। সভা টভা করে, পদত্যাগ পত্র লিখে কেউ জনসংখ্যা বিনিময় করেন নি পাঞ্জাবে। বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে সর্দারজির এই ফারাক।
৫. কিন্তু উদ্বাস্তু সমস্যার ছুতো দেখিয়ে একদল গ্রেটার ইসলামিক বাংলাদেশের দালাল বলে বেড়াচ্ছে বাংলাভাগ ভুল। ইতিহাসকে বিকৃত করে দেখাতে চাইছে যে বাংলায় সবাই নাকি শরৎ বসুর সমর্থক ছিল, সবাই যুক্ত বঙ্গ চেয়েছিল, একা দুষ্টু সাম্প্রদায়িক শ্যামা নাকি বাংলা ভেঙে দেন। শ্যামার এত ক্ষমতা ছিলই না!
এই সমস্ত বিশ্বমানব সেকুলার গবেট, এই সব বামছাগল অথবা দলিতবাদী উদ্বাস্তু – এরা শুধু ইতিহাস বিকৃতি করে না, এরা বাংলায় বিজেপির সবথেকে বড় বন্ধু। শ্যামা যে পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা, এ কথাটা তৈরিই হয়েছে বামছাগলদের ইতিহাস জালিয়াতি থেকে। বামছাগলদের পিতামহ জ্যোতিবাবু নিজেই বাংলাভাগের পক্ষে ভোট দিয়েছেন, এ তো নথিবদ্ধ প্রমাণ। আজকে আব্বাসীয় জেহাদের একনিষ্ঠ চাটুকারিতায় বেঁচে থাকা ঝাণ্ডু বাম, আজকে মহম্মদ সেলিমের হালাল বাম সেই ইতিহাসকে বিকৃত করলে কি হবে, এ নথি তো মুছে ফেলা যাবে না।।
বর্তমানে বাংলাদেশের জেহাদি আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন দিতে পশ্চিমবঙ্গের বামছাগল যুক্ত বঙ্গের পক্ষেও লাফালাফি করছেন। এরা বাংলাভাগবিরোধী, এরা গ্রেটার বাংলাদেশ তৈরি করতে চায় তৃণমূল স্পন্সর্ড কাংলাপক্ষের মতোই।
এদের জন্য কার্ল মার্ক্সের উদ্ধৃতিতে বলি, বাংলা ভাগ সেদিনই হয়ে গেছিল যেদিন বাংলায় ইসলাম এসেছিল, কারণ ইসলাম যে কোনও দেশের যে কোনও জাতির সংস্কৃতিকে ভেঙে দেয় সুবিধাবাদী দ্বিজাতীয় দ্বিদেশীয় বিভাজনে। ইসলামে বিশ্বাসী, আর ইসলামে অবিশ্বাসী। ইসলামে অবিশ্বাসী হল শত্রু, কাফের। ইসলাম নিষিদ্ধ করে কাফেরদের জাতিকে, ফলে এক চিরস্থায়ী যুদ্ধ শুরু হয় ইসলামে বিশ্বাসী ও ইসলামে অবিশ্বাসীদের মধ্যে।
এই যুদ্ধের একটি মাইলস্টোন হল বাংলা ভাগ। এই ইতিহাস যারা মুছতে চাইছে, তারা ইসলামিক বলয়ের নির্ভেজাল দালাল। এবং তারা ইতিহাসের সত্যিটা যখনই শোনে, তখনই আমাদের উদ্দেশ্যে গালাগাল বর্ষণ শুরু করে, আমরাও নাকি তাদেরই মত দালাল, নির্ঘাত গোবলয়ের দালাল।
যারা এদের মত জেহাদি অপশক্তির দালালি করবে না, তারা সবাই নাকি বিজেপি। আমি বলছি, বাংলার বুকে বিজেপি আজকে বেড়েছে শুধুমাত্র এদের উগ্র তোষণ রাজনীতির জন্য। ইতিহাসের চুনোপুঁটি শ্যামাকে এরাই পশ্চিমবঙ্গের জনক বানিয়ে দিয়েছে, জ্যোতিবাবু এবং সেযুগের কংগ্রেসকে আড়াল করতে, যাতে আজকে তাদের মুসলমান মালিকরা রুষ্ট না হয়, যাতে মুসলমান ভোটব্যাংক অক্ষুণ্ন থাকে। বর্তমানের ভেস্টেড ইন্টারেস্ট নিয়ে এই জেহাদি অপশক্তি সাতচল্লিশ সালে ইসলামিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির নির্ভীক প্রতিরোধের ইতিহাসকে আড়াল করছে।