তারপর হঠাৎ করে আর জি করের মতো ঘটনা ঘটে যায়। পুরো পচে যাওয়া সিস্টেমটা আমাদের সামনে এসে ধরা দেয়। সেটাকে বদলে ফেলতে না পারলে ভবিষ্যৎকে রক্ষা করা অসম্ভব। লিখেছেন- ডঃ ঋতুপর্ণা কোলে।
গত তিনদিন ধরে রান্না বন্ধ কারণ বাসন ধোওয়া এবং জলের ফিল্টার ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। যে বেসিনে এসব কাজ করা হয় তাকেই বন্ধ রাখতে হয়েছে। বেসিনের পাইপটা মেঝের যে অংশ দিয়ে বাইরে বেরিয়েছে সেখান দিয়ে ঘরে জল ঢুকছে। আমাদের ফ্ল্যাটটি কিন্তু পাঁচ তলায়। ফলে গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসমস্যা খানিক স্বাভাবিক হলেও এত উপরে এটা কীভাবে হচ্ছে প্রথমে বোঝা যাচ্ছিলো না। বেসিনের মুখে অনেক কিছু রাসায়নিক ঢালা হলো কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। কাল ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘর জলে থইথই করছে। এর আগে দু তিন বার ওই জায়গা দিয়ে জল ঢুকেছিল। বিশেষ পাত্তা দেওয়া হয়নি। নিজেই জল বেরোতে লেগেছিলো। কিন্তু পরশু থেকে আর কিছুই করা যাচ্ছিলো না।
অবশেষে কাল সন্ধ্যায় ঠিক করা হল পাইপ খোলা হবে। আজ সকালে সেই মতো প্লাম্বার এলেন। ধীরে ধীরে যা সামনে এলো তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ছাদে একটি ছোট বটগাছ হয়েছে। একেবারে লিকপিকে। বাইরে থেকে তাকে খুবই স্বাভাবিক মনে হবে। সেই গাছের শেকড় পাইপের ভেতরে গিয়ে জল যাওয়ার রাস্তা আটকেছে। আশ্চর্যের বিষয়ের হলো সেই শেকড় বিল্ডিংয়ের সমস্ত তলা কভার করে পাইপের ভেতর দিয়েই মাটি স্পর্শ করেছে। সমস্ত পাইপটাই বদলাতে হচ্ছে। এছাড়া আর রাস্তা নেই। এটা যদি আগেই খেয়াল করা যেত তাহলে পাইপটাকে রক্ষা করা যেত।
ঠিক এই বিষয়টাই শরীর ও সমাজ দুটোর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। শরীরে রোগ বাসা বাঁধলে তার প্রকাশ কিছু হলেও ঘটেও কিন্তু আমরা গুরুত্ব দিই না। শেষে সেই রোগ ছয়তলা লম্বা পাইপটার মতো শরীরটাকে ফেলতে বাধ্য করায়। কিন্তু ঠিক সময়ে চিকিৎসকের কাছে গেলে রোগটাকেই ফেলা যায় শরীরটাকে বাঁচিয়ে।
ঠিক তেমনি সমাজে অনেক কিছুই ঘটে আমরা পাত্তা দিই না। তারপর হঠাৎ করে আর জি করের মতো ঘটনা ঘটে যায়। পুরো পচে যাওয়া সিস্টেমটা আমাদের সামনে এসে ধরা দেয়। সেটাকে বদলে ফেলতে না পারলে ভবিষ্যৎকে রক্ষা করা অসম্ভব। আমাদের জুনিয়র ডাক্তাররা আজ স্বাস্থ্যক্ষেত্রের সিস্টেম বদলের লড়াইটাই লড়ছেন। আপনি নিজের জায়গাটার জন্য লড়ুন। নয়তো আপনার জায়গাটা আরজি কর যেকোনো দিন হয়ে যেতে পারে।
তবে এটাও ঠিক আরজি করের ঘটনা বাকি সব ঘটনার থেকে অনেক আলাদা।
প্রতিদিন অজস্র খুন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, প্রতিটা ঘটনাই মর্মান্তিক। তবু আরজি কর কেনো আলাদা আজ সেটাই বলি। আরজি কর প্রসঙ্গ আলোচনায় এলেই বাংলার শাসকদল হাতরস, মণিপুর দেখাচ্ছেন। অন্যপক্ষ কামদুনি, সন্দেশখালি দেখাচ্ছেন। হাতরস থেকে সন্দেশখালি সবকটা ব্যাপারই দু:খজনক। তবু আরজি করের সঙ্গে তুলনা হয় না।
১. প্রথম ও প্রধান কারণ হল স্থান। আপনি বা আমি চাইলেই ওই বিল্ডিংয়ের তিনতলায় উঠতে পারবো না। পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষীর বলয় পেরিয়ে, তাদেরকে যেতে চাওয়ার গুরুত্ব বুঝিয়েই আপনাকে যেতে হবে। এমনকি আপনার খুব কাছের আত্মীয় ভেতরে ভর্তি থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়া আপনি যেতে পারবেন না।
সেই নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থাকা একজন ডাক্তার যিনি হলেন ওই বিল্ডিংয়ের একপ্রকার শেষকথা কারণ তিনি এখানে আছেন বলেই রোগী বাড়িতে না থেকে এখানে আছেন, সেই তিনিই খুন হচ্ছেন। তাহলে নার্স, আয়া, রোগী, অন্যান্য স্টাফ এরা কতটা বিপন্ন সেটা একবার ভাবুন। এই নিরাপত্তা বলয়ে যদি ডাক্তারের জীবন যেতে পারে সেখানে সাধারণ রোগীর কিডনি রোগীর শরীরেই থাকছে কিনা সে ব্যাপারে কীভাবে নিশ্চিত হব?
পাশাপাশি ভাবুন এই নিরাপত্তা বলয়ের বাইরে আমরা যারা আছি আপনি, আমি, আমরা সবাই; আমাদের জীবনের বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা কি আছে? এখানেই আরজি করের ঘটনার সঙ্গে ফারাক কামদুনিসহ অন্যান্য সব ঘটনার। তুলনা একেবারেই চলে না। খালি কল্পনা করা যেতে পারে এরকম সিকিউরিটি সমৃদ্ধ জায়গায় যদি এইঘটনা ঘটতে পারে তাহলে আপনার আমার সঙ্গে রাস্তাঘাটে কী হতে পারে।
২. কেন্দ্র সরকারের অন্যতম প্রজেক্ট “বেটি পড়াও, বেটি বাঁচাও”। রাস্তাঘাটে হেন গাড়ি চোখে পড়ে না যেখানে এই বক্তব্য লেখা নেই। কিন্তু আরজি কর চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে বেটিকে পড়িয়ে শিক্ষার উচ্চতর অবস্থানে পৌঁছে দিলেও বেটি বাঁচবে না। ‘বেটা বেটি’ দুজনকেই প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারলে এই সমাজটা ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এই শিক্ষিত করার ব্যাপারে কেন্দ্র বা রাজ্য কারোরই সদিচ্ছা আছে কিনা সেটাই প্রশ্ন। থাকলে টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের শিক্ষক বানাতো না রাজ্যসরকার আর কেন্দ্র সরকার নিট স্ক্যাম, NTA ঘোটালায় নাম লেখাতো না বা শিক্ষাখাতে, গবেষণাখাতে অর্থ বরাদ্দ কমাতো না।
সুতরাং আরজি কর চোখে আঙুল দিয়ে বোঝালো এত পপুলার একটা প্রজেক্ট আসলে একটা স্ক্যাম।
৩. খেয়াল করে দেখুন ধর্ষণটাকে আরজি করের ঘটনার মুখ্য বিষয় রূপে উপস্থাপিত করা হচ্ছে। ধর্ষণ ভারতীয় সমাজে একটা মারাত্মক বিষয়। কিন্তু আরজি কর এমন একটা ঘটনার জন্ম দিয়েছে যেখানে ধর্ষণকে মুখ্য হিসাবে দেখলে আসল ঘটনাকেই ধামাচাপা দেওয়া যায়। এটা এমন একটা কেস যেখানে ধর্ষণের মতো নোংরা ঘটনা ঘটলেও সেটাকে মুখ্য বিষয় বলে ধরা যায় না। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের সঙ্গে এজন্যই একেবারে তুলনীয় নয়। দিল্লির কাণ্ডে ধর্ষণ করাই ছিলো মুখ্য উদ্দেশ্য খুন করা নয়। আর জি করের মৃতদেহের ইতিহাস এবং ৯ তারিখ সকাল থেকে চলা কর্তৃপক্ষের নাটক ভাবতে বাধ্য করাচ্ছে এখানে খুনটাই মুখ্য উদ্দেশ্য। আততায়ীরা খুন করতে গিয়ে ধর্ষণকে উপরি পাওনা হিসাবে নিয়েছে।
যে কেসের জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বলতে বাধ্য হন এমন কিছু এখানে হয়েছে যা নাকি তিনি তাঁর তিরিশ বছরের বিচারকজীবনে দেখেন নি। সেখানে যারা অন্য কেসের সঙ্গে আরজি করকে তুলনা করেছে তারা হয় কেসটাকে লঘু করতে চাইছে, নয়তো গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে।
আবারও বলছি যেকোনো খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি ইত্যাদি খুবই দু:খজনক কিন্তু তাকে আরজি করের ঘটনার সঙ্গে তুলনা করবেন না বা মেলাবেন না।
সময় থাকতে সতর্ক হন।