চলছে শ্রাবণ মাস, মা মনসার মাস। এই সময় বাংলা জুড়ে মা মনসার পুজো হয়। ভারত জুড়ে এই সময়টা শৈব তীর্থযাত্রী শিবের মাথার জল ঢালতে যান। উত্তর ভারতে কানওয়াড়িয়া বলে এদের। বাংলায় বাবা তারকনাথ ছবিটি সুপারহিট হওয়ার পর এখানেও শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় জল ঢালার প্রথা শুরু হয় বাঙালির মধ্যে। তারকেশ্বর অঞ্চলের পুরোনো লোকেদের কাছ থেকে শোনা যায় যে বাবা তারকনাথ সুপারহিট হওয়ার আগে এই তীর্থযাত্রা (ওখানে সবাই বলে শ্রাবণী মেলা) মূলত পশ্চিমবঙ্গের অবাঙালিরাই করতেন। প্রসঙ্গত তারকেশ্বর শিব মন্দিরটি একজন অবাঙালি ক্ষত্রিয় তৈরি করেন এবং মন্দিরটি উত্তরপ্রদেশের একটি মঠ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, মোহন্ত সেই উত্তরপ্রদেশের মঠ থেকেই হন, এবং মন্দির কমিটির সমস্ত অর্থ উত্তরপ্রদেশের মঠেই চলে যায়।
কিন্তু সে কথা থাক। আজকে এই শৈব উৎসবের গোড়ায় কিভাবে শাক্ত ধর্ম মিশে আছে, সেই আশ্চর্য প্রত্নতাত্ত্বিক কাহিনী জানব
শৈব ধর্ম মূলত পুরোহিত বা গুরুকেন্দ্রিক ধর্ম। শিব নিজেই আদি গুরু এবং আদি যোগী। যোগী শব্দের সবথেকে প্রাচীন অর্থ হল যিনি পূজার যোগান দেন, যিনি দেবতার সহযোগী, দেবতার উপাসক। যোগাসন কথাটাও সেখান থেকেই এসেছে, অর্থাৎ এই আসনে বসে দেবতার উপাসনা করতে হত।
হরপ্পা সভ্যতায় এরকম যোগাসনে উপবিষ্ট একটি মূর্তি দেখি আমরা। এই মূর্তি আসলে হরপ্পা সভ্যতার Shaman বা তান্ত্রিক। ইনি হরপ্পা সভ্যতার তন্ত্রধর্মের পুরোহিত। বলির মোষের শৃঙ্গ ইনি কখনও কখনও তাঁর মস্তকে ধারণ করতেন (পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই প্রথা দেখা গেছে, পুরোহিত স্বয়ং বলি দিয়ে বলিদানের পশুর শৃঙ্গ নিজের মাথায় ধারণ করতেন)।
বর্তমানকালে সমস্ত গবেষক একমত যে এই হরপ্পা সভ্যতার উপবিষ্ট চরিত্রটি ছিলেন সেখানকার তন্ত্রধর্মী পুরোহিত। কিন্তু অনেকেই একে শিব আখ্যা দেন। আজকের দেবাদিদেব মহাদেব শিব, বা বৈদিক রুদ্র ইনি নন। শৈব ধর্মের উত্থান অনেক পরে ঘটেছে (গবেষক আলেক্সিস স্যান্ডারসন দ্রষ্টব্য)। কিন্তু একটা চিত্তাকর্ষক বিষয় হল, এঁর ছায়া অবলম্বন করেই আজকের শৈব ধর্ম নির্মিত, যে তথ্য সর্বপ্রথম প্রফেসর তমাল দাশগুপ্ত তুলে ধরেছেন তাঁর বিভিন্ন বাংলা ও ইংরেজি লেখায়।
কিভাবে? হরপ্পার উপবিষ্ট মূর্তি কিভাবে শৈব ধর্মের সঙ্গে যুক্ত? ইনি কি বৈদিক পশুপতি, কারণ এঁর সিলে বিভিন্ন বন্য জন্তু দেখা যায়? কিন্তু বৈদিক পশুপতি হলেন গৃহপালিত পশুর দেবতা, বেদ পড়লেই দেখা যাবে। তাঁর সঙ্গে বন্য পশুর যোগ নেই। আরেকটি বিষয় হল, হরপ্পার উপবিষ্ট এই পুরোহিত সব সময় পুরুষ নন, কিছু সিলে দেখা যাচ্ছে তিনি মহিলা।
আসলে একটি (তথাকথিত) “পশুপতি” সিলের হরপ্পা বর্ণমালার লেখা পাঠোদ্ধার করেছেন বিখ্যাত ইতিহাসতাত্ত্বিক আস্কো পার্পোলা। তিনি বলছেন তাতে লেখা আছে Servant of Water Deity, অর্থাৎ “যিনি জলদেবীর ভৃত্য”। এই জলদেবতা বা জলদেবীর চিহ্ন হিসেবে হরপ্পা সভ্যতায় মাছের প্রতীক ব্যবহার হত। প্রসঙ্গত এই জলদেবীর স্মৃতি আজকে মা তারা বা নীল সরস্বতীর মধ্যে প্রবহমান। এছাড়া বলা বাহুল্য মা গঙ্গা সহ সমস্ত নদীমাতৃকার মধ্যেও এই জল উপাসনার স্মৃতি আছে। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও আজকের মা মনসা, মা লক্ষ্মী, মা সরস্বতী, মা শীতলা – এঁদের সকলের মধ্যেই প্রাচীন জলদেবীর কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব অন্তর্লীন আছে। হরপ্পা সভ্যতার ধর্মে জল সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তো, হরপ্পা সভ্যতার পুরোহিত ছিলেন আসলে এই জলেশ্বরীর উপাসক।
হরপ্পা সভ্যতার পতনের পর কেটে গেল দুহাজার বছর। ভারতে বৈদিক যুগ শেষে শুরু পৌরাণিক যুগ। এই যুগে শৈব ধর্মের নির্মাণের সময় এটাই হয়ে গেল শিবের মাথায় গঙ্গা। শিবের মাথায় গঙ্গাজল ঢালা আজ সেই প্রাচীন, বিলুপ্ত, বিস্মৃত হরপ্পা সভ্যতার তন্ত্রধর্মী পুরোহিতের আশ্চর্য উদযাপন। শিবের মাথায় অবস্থিত গঙ্গা এখন নিতান্ত এক গৌণ দেবী,কারণ মাতৃধর্মের গরিমা পরবর্তী পৌরাণিক যুগে খর্ব করে প্রবল প্রতাপান্বিত পুরুষ দেবতাদের মহিমান্বিত করা হয়েছে। কিন্তু মা তারার কোলে শিশু শিব (তারাপীঠ) এবং শিবের মাথায় গঙ্গাজল ঢালার উৎসব আমাদের মধ্যে আজও প্রবহমান সেই আদিম মাতৃকা উপাসনার পুরোহিতকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, তাদের দেখিয়ে দিচ্ছে যাদের দেখার চোখ আছে।
সেই হরপ্পার তান্ত্রিক, যিনি জলদেবীর ভৃত্য/যোগী/পুরোহিত ছিলেন। না, তিনি কোনও সর্বময় দেবতা নন, হরপ্পা সভ্যতায় কোনও রুদ্র বা শিব ছিলেন না। কিন্তু শৈব ধর্মের উৎসবে শিবের মাথায় আজও জলদেবীর অবস্থান ঘটে, এবং এভাবে একটি বিপুল শৈব উৎসবের গোড়ায় আজও আদিম মাতৃকা উপাসনার স্মৃতির শেকড় রয়েছে।