আজ এমন একটি কালীমন্দিরের কথা বলব যার অবস্থান আমাদের মাতৃভূমি থেকে বহু দূরে, সুদূর গ্রেট ব্রিটেনে। সেটি হল ওয়ালসের কার্মার্থেনশায়ারের স্কন্দ ভ্যালির মহাশক্তি মন্দির। লিখেছেন- ডঃ রক্তিম মুখার্জ্জি
তন্ত্র ও মাতৃসাধনা প্রাচীন পৃথিবীর প্রথম বিশ্বজনীন ধর্ম। যিনি বাক্য মনের অতীত পরম তত্ত্ব, যিনি আদি জগতকারণ প্রকৃতি, তাঁকেই আমরা ধ্যানের সুবিধার্থে মা বলি। সুমের, মিশর, হরপ্পা, গ্রীস, কেল্টিক এই সমস্ত সভ্যতার প্রধান সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য মাতৃসাধনার ধারা। আজ আধুনিক বিশ্বে আমরাই সেই মাতৃপূজার ধারার শেষ উত্তরসূরি।
পাশ্চাত্যের সভ্যতা বহুদিন ধরেই তন্ত্রের বিষয়ে আকৃষ্ট হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনকাল শুরু হওয়ার আগে থেকেই কলকাতায় মা ফিরিঙ্গি কালী পূজিত হচ্ছেন। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্তাদের কালীঘাটে পুজো দেওয়ার নথিবদ্ধ বিবরণ আছে। এছাড়া শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণবের শিষ্য স্যার জন উড্রফের আর্থান অ্যাভালন ছদ্মনামে তন্ত্রের বহু গ্রন্থের সম্পাদনা এবং গবেষণা তো বিশ্ববিখ্যাত।
ইংল্যান্ডের এই স্কন্দ ভ্যালি ১৯৭৬ সালে স্বামী সুব্রহ্মনিয়ম প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে এখানে মুরুগন স্বামী অর্থাত কার্ত্তিকের পূজা শুরু হয়। ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠা হয় মহাশক্তি মন্দির। এখানে কেন্দ্রীয় বিগ্রহ মা কালী। তাঁর চারপাশে মণ্ডল রচনা করে আছেন লক্ষ্মী, পট্টিনী, সরস্বতী, মা মেরী এবং বিভিন্ন ধর্মের উপাস্য মাতৃকাগণ।
এখানে মা কালীর ছয় ফুট উচ্চতার মূর্তিটি দাক্ষিণাত্যের শৈলীতে নির্মিত। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার পালযুগের বাঙালিরা মা কালীর যে রূপ পূজা করতেন, সেই রূপই দাক্ষিণাত্যে পূজিত হয়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী সুব্রহ্মনিয়ম ১৯৮৫ সাল থেকে স্বপ্নে মা কালীর দর্শন পেয়ে এই মন্দির নির্মাণ করেছেন। এই মন্দিরে বলিদান হয় না। আমিষ খেলে পরের তিনদিন মন্দিরে ঢোকা যায় না। তবুও আমাদের মাতৃভূমি থেকে এত দূরে মায়ের এই মন্দির সত্যিই এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এখানে মায়ের মূল ভক্ত প্রবাসী বাঙালি ও গুজরাটিরা।
প্রতিদিন ভোর সাড়ে ছয়টা থেকে সন্ধ্যে ছয়টা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। মায়ের আরতি, অষ্টোত্তরশতনাম পাঠ করা হয়। ভক্তরা দর্শন করেন। প্রসাদ গ্রহণ করেন।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবং আমেরিকায় মাতৃধর্ম সম্পর্কে আগ্রহ দেখলে অবাক হতে হয়। তন্ত্র এবং শাক্ত ধর্মের ইতিহাস নিয়ে পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কাজ হয়েছে ও হচ্ছে, তার এক শতাংশ আমাদের দেশে হয় না, যা লজ্জার। কিছুদিন আগে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে তন্ত্র ইতিহাস বিষয়ক একটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল, যেখানে কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল উনিশ শতকের কৃষ্ণনগরে তৈরি এক মৃন্ময়ী কালীমূর্তি।
তন্ত্রের ইতিহাস অবৈদিক, যা পশ্চিমে স্বীকৃত। মাতৃকার আদি ধর্মের প্রত্নতত্ত্ব যেভাবে পশ্চিমে আলোচিত, পৌরাণিক গ্রন্থে এবং পরবর্তী যুগে তন্ত্রশাস্ত্রের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যেভাবে জগন্মাতার চিত্র বিবর্তিত হল, সেই গবেষণা পশ্চিমে হয়েছে যেভাবে, তার জুড়ি নেই।
পাশ্চাত্যে তন্ত্রের প্রতি এই আগ্রহের প্রেক্ষাপটেই স্কন্দ ভ্যালির মহাশক্তি মন্দির আমাদের মাতৃপূজক ধর্মের এক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। প্রবাসের এই কালীক্ষেত্র থেকেও আজকের শিকড়বিচ্ছিন্ন বাঙালির শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং তার নষ্ট অতীতের পুনরুদ্ধার করে মাতৃনামের ধ্বনি তোলা উচিত।