নারী মাত্রই সৃষ্টির প্রতীক। যুগে যুগে সন্তান কোলে মাতৃকারা পৃথিবীর সব সভ্যতাতেই উপাস্য ছিলেন। ষষ্ঠী মাতা, গণেশজননী কিংবা শিশু যিশুকে কোলে নিয়ে মাদার মেরি সবই এইসব প্রাচীন মূর্তির ধারাবাহিকতা। কিন্তু কালে কালে দেশে দেশে এই রক্ষাকারী দেবীরা হয়ে উঠেছেন ধ্বংসের প্রতীক। সন্তানকে রক্ষার জন্য সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে নেমে সংহার করেন। আজ তেমনি কয়েকজন মাতৃকাকে আমরা চিনব। লিখেছেন- ডঃ ঋতুপর্ণা কোলে
মা কালী
সবার প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় মা কালীর কথা। কারণ সংহার মাতৃকা নানা সভ্যতা নানা জাতির মধ্যে থাকলেও এই একবিংশ শতাব্দীতে মানব জাতি দ্বারা উপাসিত হচ্ছেন যে একমাত্র দেবী তিনি হলেন মা কালী। অশুভ শক্তি বিনাশকারী মা কালীর রূপ সম্পর্কে সকলেই অবগত। সেই অনুসারে নামকরণ হয় দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, মহাকালী, শ্মশান কালী ইত্যাদি।
শেখমেত
ইজিপ্টের প্রাচীন ধর্মমতে শেখমেত একজন খুবই শক্তিশালী ধ্বংসের দেবী। এই দেবীর শরীরটা মানুষের হলেও মুখটা সিংহের। তিনি একদিকে যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর সন্তানদের রক্ষা করেন তেমনই শত্রুদের বিনাশ করেন। কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, প্রাচীন ইজিপ্টের পুরাণ মতে, শেখমেত শত্রুশিবিরে বা শত্রুভূমিতে প্রাণঘাতী রোগ ছড়িয়েও শত্রুকে প্রতিহত করেন।
এরিস, এন্যও, আতে
গ্রীক পুরাণ মতে এরিস একজন রক্তপাতহীন ভয়ানক পরিণতি সৃষ্টিকারী দেবী। মানুষের চারিত্রিক অবক্ষয় যা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তাই দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের জীবনে বিপর্যয় এনে জীবনকে ধ্বংস করে দেন।
এন্যও একজন গ্রীক দেবী। মূলত ইনি যুদ্ধক্ষেত্রের দেবী। শত্রু পক্ষের দেশ, শহরকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে এই দেবীর ভূমিকা আছে বলেই প্রাচীন গ্রীসে মনে করা হত। হাতে ঢাল তলোয়ার আর সঙ্গী এক ভয়ঙ্কর বিষাক্ত সাপ।
ভারতীয় ধর্ম চেতনা এবং প্রাচীন গ্রীক চিন্তা ধারা কোথাও মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। গ্রীক পুরাণে এমন কয়েকজন দেবীর সন্ধান পাওয়া যায় যাদের কাহিনী একেবারে আমাদের মঙ্গল কাব্যের সঙ্গে মিলে যায়। মঙ্গলকাব্যে আমরা যেমন দেখি দেবী মনসা, দেবী চণ্ডী পূজা প্রচারের জন্য মানুষকে বিপদে ফেলছেন তারপর বিপদ থেকে উদ্ধার করে পূজা লাভ করছেন। এমনি একজন দেবী হলেন আতে।
তিয়ামাত
মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার ভয়াল দেবীর মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিয়ামাত। তিনি সৃষ্টির দেবী। ব্যবিলনের ‘এনিমা এলিশ’ মহাকাব্য অনুসারে তিনি দেবতাদের জন্ম দিয়েছেন। তিয়ামত সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা না যাওয়ার কারণে গালগল্পকেই ভরসা করতে হয়। সেসব গল্প স্বাভাবিকভাবেই মাতৃকাদূষণ ঘটিয়েছে। তাই সেই আলোচনায় না গিয়ে দেখা যাক দেবী তিয়ামতের রূপ। এই দেবীর সঙ্গী হলেন এক ভয়ঙ্কর ড্রাগন। তিনি কখনো ড্রাগনের রূপ নেন, কখনো ড্রাগনকে সঙ্গে নিয়ে শত্রুকে বিনাশ করেন।
লিলিথ
প্রাচীন মাতৃকাদের মধ্যে লিলিথ অন্যতম। খ্রীষ্টের জন্মের চার হাজার বছর আগে থেকেই সুমের প্রদেশে এই দেবীর দেখা মেলে। যিনি মানব সভ্যতায় রোগ, মৃত্যু নিয়ে আসেন। এই দেবী ভবিষ্যতে নানা কাহিনিতে নানাভাবে গৃহীত হয়েছেন। ইহুদি পুরাণ অনুযায়ী নারী স্বাধীনতা ঘোষণাকারী প্রথম দেবী হলেন লিলিথ। কখনো সাপ আবার কখনো পেঁচা হলো লিলিথের সঙ্গী। এই লিলিথ কিন্তু সমাজে ও সাহিত্যে যাদুবিদ্যা ও গুপ্তবিদ্যার মধ্যে এখনো বেঁচে আছেন।
পৃথিবীর সকল প্রাচীন সভ্যতাতেই ধ্বংসের দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্যতম প্রধান কারণ হলো ভারসাম্য রক্ষা করা। এই দেবীরা অশুভকে ধ্বংস করে শুভকে প্রতিষ্ঠা করেন, নতুনকে স্থান দিতে পুরাতনকে সরিয়ে দেন। পাশাপাশি মাতৃকারা প্রমাণ করতেন তাঁরা সৃষ্টির প্রতীক হয়ে কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র মাত্র নন, তাঁরা সভ্যতার উষা কাল থেকেই জন্ম মৃত্যু উভয়েরই কারণ। মাতৃকাদের কারো স্ত্রী, কারো কন্যা হিসাবে দেখাটা পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসনের প্রতীক।
মাতৃকারা সৃষ্টি করেন তাই বোঝার সুবিধার জন্য মা হিসাবে দেখি এবং পাশে একটা বাবার মুর্তি খাড়া করার চেষ্টা করি সেসময় ইতিহাসকে অস্বীকার করি, তাঁদের সংহার রূপকে হয় অস্বীকার করি নয়তো নানা গল্পগাছা দিয়ে ঢেকে দিই। আব্রাহামিক ধর্মগুলি সভ্যতার স্মৃতি থেকে মাতৃকাদের মুছে দিয়েছে। হিন্দু ধর্ম যদিওবা আছে তবে তা আপোষ করে। বাংলায় এখনো মাতৃকা উপাসনা এখনো প্রবলভাবে টিকে আছে তার অন্যতম কারণ আর্যাবর্তের আগ্রাসনকে আমরা অনেক অংশেই আটকাতে সক্ষম হয়েছি। বিষ্ণুর পায়ের তলায় থাকা লক্ষ্মী নয় বরং একক মাতৃকা হিসাবে আমরা মা লক্ষ্মীর উপাসনা করি।
ধ্বংসের দেবী মা কালীর নামেই আমরা আমাদের মহানগরীর নামকরণ করেছি কোলকাতা।