বাঙালির সূর্য আরাধনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো ইতু পূজা। অগ্রহায়ণ মাসজুড়ে এই পূজা পালিত হয়, যা মূলত সূর্যের শক্তি ও শস্যের উর্বরতার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ। লিখেছেন- ডঃ ঋতুপর্ণা কোলে
ভারতবর্ষের পূর্বদিকে বসবাসকারী বাঙালি জাতি সম্পর্কে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হলো, “বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ।” বাস্তবে কিন্তু তেরো নয়, বাঙালির আছে অসংখ্য পার্বণ ও উৎসব। এ সব পার্বণ ও উৎসবের মধ্যে নিহিত রয়েছে একটি জাতির ঐতিহ্য, বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা। কালের প্রবাহে এবং আধুনিকতার চাপে অনেক প্রাচীন উৎসব হারিয়ে গেলেও, কিছু রয়ে গেছে এখনও, যা আমাদের শিকড়ের পরিচয় দেয়।
সূর্য আরাধনার প্রাচীনতা
যে কোনো জাতির বিশ্বাস ও আচরণ যদি সূর্য কেন্দ্রিক হয়, তবে বোঝা যায় সেই জাতির শিকড় ছড়িয়ে আছে অনেক গভীরে। ইতিহাসে দেখা যায়, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি প্রাচীন সভ্যতায় সূর্যকে দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়েছে। মিশরের রা (Ra), সুমেরীয় সভ্যতার উতু (Utu), গ্রীকদের হেলিয়াস (Helios), রোমানদের মিত্র (Mitra)—সূর্যের আরাধনার প্রমাণ।
বাঙালির ইতু পূজা: সূর্য পূজার ঐতিহ্য
বাঙালির সূর্য আরাধনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো ইতু পূজা। অগ্রহায়ণ মাসজুড়ে নারীরা এই পূজা করে থাকেন, যা মূলত সূর্যের শক্তি ও শস্যের উর্বরতার প্রতি কৃতজ্ঞতাপ্রকাশ। ‘ইতু’ শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে মনে করা হয় এটি সূর্যের আরেক নাম ‘মিত্র’-এর বিবর্তিত রূপ। ‘মিত্র’ থেকে ‘মিতু’, সেখান থেকে ‘ইতু’—এভাবেই এই শব্দটি এসেছে।
ইতু পূজা মূলত একটি ব্রত, কার্তিক সংক্রান্তি থেকে শুরু হয়ে অগ্রহায়ণের সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতি রবিবার পালিত হয়। এসময় নারীরা ব্রতকথা পাঠের মধ্যে দিয়ে পূজা সম্পন্ন করেন এবং ইতুর সাধ দেওয়ার সময় নানা মন্ত্র উচ্চারণ করেন। তার মধ্যে একটি হলো–
চালকটা দিয়ে রাঁধল সখী
ভাতকটা দিই খাই
কড়ির চুপড়ি মাথায় করে
গয়লা বাড়ি যাই
গয়লাভাই, গয়লাভাই
ঘরে আছো ভাই?
আমার ইতু সাধ খাবে
ভালো দুধ চাই।
এইভাবে ময়রাভাই, কুমোরভাই, ছুতোরভাই বলে বলে ছড়াটি লম্বা হয়। এতে সমস্ত পেশার মানুষকে স্মরণ করে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের কামনা করা হয়।
ইতু পূজার আচার-অনুষ্ঠান
ইতু পূজার বিশেষ আচার-অনুষ্ঠানগুলো প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সমাজের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পূজার জন্য প্রয়োজন হয় একটি মাটির সরা, যেখানে পাঁচ ধরনের শস্যের বীজ—ধান, হলুদ, কলমী, কচু, এবং মটর বা ছোলা—বপন করা হয়। সারার ওপর একটি মাটির ঘট স্থাপন করা হয়, যা পূজার কেন্দ্রবিন্দু।
অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির দিন হল পূজার শেষ দিন। সেদিন সেই ঘটটিকে দই, দুধ, মিষ্টি প্রভৃতি দিয়ে পূর্ণ করা হয়। এই দিনটিকে বলা হয় ‘ইতুর সাধ’, যেখানে গর্ভবতী নারীর মতোই ইতুকে নানান উপাদান দিয়ে তুষ্ট করা হয়। এরপর, সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের সময় পূজার সমাপ্তি হয় মাটির সরা ও ঘট জলে ভাসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে।
সূর্যের প্রতি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের কৃতজ্ঞতা
ইতু পূজার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো এটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধারণ করে। কৃষি সভ্যতার শুরুর দিকে নারীরাই শস্য উৎপাদনের সঙ্গে বেশি যুক্ত ছিলেন। বীজ থেকে ফসল উৎপাদন এবং তা সংরক্ষণ করার জ্ঞান মূলত নারীদের হাতে ছিল। পুরুষেরা তখন প্রধানত শিকারের দায়িত্ব পালন করতেন। এই ঐতিহ্য এখনও ইতু পূজায় প্রতিফলিত হয়।
ইতু পূজার উপকরণ হিসেবে মাটির পাত্রের ব্যবহারও এর প্রাচীনতার প্রমাণ। আগুন আবিষ্কারের পরে মানুষ মাটির পাত্র তৈরি শুরু করে। ইতু পুজোর আধার হলো মাটির সরা।
ইতু পূজা ও ছট পূজার তুলনা
কিছুদিন আগেই বিহারের মানুষজন ছট পূজায় মেতে উঠেছিলেন। ছট পূজা এবং ইতু পূজা উভয়ই সূর্য আরাধনার উদাহরণ, তবে এদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। তা সত্বেও ছট ও ইতু পূজা দুটোই বেশ সরল এবং নারীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। সূর্যের শক্তিকে মাতৃরূপে কল্পনা করার ধারাটি এই দুটি পূজাতেই স্পষ্ট।
বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা
ইতু পূজা আজকের আধুনিক সমাজে তার মৌলিক রূপ অনেকটাই হারিয়েছে। অনেক পরিবারে এখন ব্রাহ্মণ এসে পূজা পরিচালনা করেন, যা এই উৎসবের আদি মাতৃতান্ত্রিক ঐতিহ্য থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিতকেই স্পষ্ট করে। তবে এখনও অনেক বাঙালি পরিবারে নারীরা নিজেরাই এই পূজা সম্পন্ন করেন এবং সূর্যের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
উপসংহার
আজ থেকে অগ্রহায়ণ মাসের সূচনা। গতকাল বাঙালি নারীরা ঘরে ঘরে ইতু সরা স্থাপন করেছেন। এখন সারা মাস ধরে তা লালন করবেন। বাঙালির সূর্য আরাধনার এই ঐতিহ্য শুধু ধর্মীয় নয়, এটি আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।