বাঙালি জাতির বয়স চার হাজার বছর, কারণ আমাদের স্বকীয় পরিচয়, আমাদের তন্ত্রধর্মী সভ্যতা, আমাদের কালীধর্ম, আমাদের বৃহৎ সম্প্রদায়ের নির্মাণ পূর্ব ভারতের এই ভূখণ্ডে চার হাজার বছর আগেই ঘটেছে। লিখেছেন- অধ্যাপক তমাল দাশগুপ্ত
বাংলা বর্ণমালার উৎপত্তি সেনযুগে হলেও বাঙালি জাতির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। বাঙালি জাতির শেকড় শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় নয়, বরং এই অঞ্চলের প্রাচীন মাতৃকা উপাসনা এবং তন্ত্রধর্মের পালনে নিহিত।
১. বর্তমান বাংলা বর্ণমালা মোটামুটি হাজার বছর আগে সেনযুগে উৎপন্ন। কিন্তু জাতি আর বর্ণমালা এক নয়। বাঙালি জাতির উৎপত্তি কি তাহলে বাংলা ভাষায়? বর্তমান বাংলা ভাষা এসেছে পাল যুগে, আমরা একাধিক প্রমাণ দিয়েছি। তাহলে বর্তমান বাংলা ভাষার আগে কি বাঙালি ছিল না? হ্যাঁ, তার আগেও বাঙালি ছিল, তারা যে ভাষায় কথা বলতেন তা পূর্ব ভারতীয় ব্রাত্য আর্যভাষা।
২. বর্ণমালা আর ভাষা এক জিনিস নয়। বাংলা বর্ণমালা সরাসরি ব্রাহ্মী থেকে আসেনি, ব্রাহ্মী থেকে আগে গুপ্ত ও শশাঙ্কযুগের ইস্টার্ন ব্রাহ্মী, এবং সেখান থেকে পালযুগের সিদ্ধমাতৃকা, এবং সেখান থেকে সেনযুগে প্রথম বর্তমান আকারে বঙ্গলিপি। এজন্যই বলে কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী। বাংলা বর্ণমালা তন্ত্রাশ্রয়ী, এবং প্রথম অক্ষর ক বর্ণ মা কালীর প্রতীক।
৩. কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে বর্তমান বাংলা বর্ণমালা সেনযুগে তৈরি হওয়ার আগে বাংলা ভাষা ছিল না। এমনকি বুদ্ধদেব বঙ্গলিপি শিক্ষা করেছিলেন বলে তাঁর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে। সেনযুগের দেড় হাজার বছর আগে, অশোকান বা মৌর্য ব্রাহ্মীর চারশ বছর আগে, বুদ্ধদেবের সময় বঙ্গদেশে নিজস্ব লিপি প্ৰচলিত ছিল। এখানে উন্নত সভ্যতা ছিল, লিপি তো অনেক প্রাচীন কাল থেকেই থাকবে। সেই লিপি কেমন ছিল, এখন জানার উপায় নেই, কিন্তু ব্রাহ্মী লিপির থেকেও তা প্রাচীন, তাতে সন্দেহ নেই।
৪. কিন্তু কথাটা এমনকি লিপি নিয়ে নয়। যাকে আজকে বাংলাভাষা বলে চিনি, সেই পরিচিত মাতৃভাষা এসে গেছিল পালযুগেই, আমরা সেদিনই এই গ্রূপে প্রমাণ দিয়েছি। অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে যাওয়ার সময় নিজের মাতৃভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন, অতি ভাল অতি ভাল অতি ভাল হএ, একটি তিব্বতী গ্রন্থে জানাচ্ছে। একই সময় পালযুগে একজন বজ্রযানী পুরোহিত মন্ত্র পড়ে মন্দিরের দ্বারপালের মূর্তিদের চলন্ত করে তুলছেন, এমন কাহিনী পাওয়া যাচ্ছে,সেখানে পুরোহিত বলছেন, আইস, আইস। পালযুগের কথ্য বাংলা সম্পর্কে এই দুটি তথ্য এখনও বেশিরভাগ বাঙালি জানে না। কিন্তু সবাই জানে, পালযুগে চর্যা লেখা হচ্ছে, যা বর্তমান বাংলার একটি আদি, স্টাইলাইজড লেখ্য রূপ।
৫. কিন্তু সেটাও কথা নয়। কথা হচ্চে বাঙালির সংজ্ঞায়ন শুধুমাত্র ভাষায় নয়। ভাষা তো এখানে অনেক আগে থেকেই ব্রাত্য আর্য বা আউটার এরিয়ান। বিজয় সিংহের সময় সিংহলে যে ভাষা প্ৰচলিত হয় সেটা দেখেই বোঝা যায়, এখানে তখন আমাদের ভাষার একটি প্রাচীন কিন্তু সুগঠিত রূপ এসে গেছে।
৬. কিন্তু সব কথার শেষ কথা যা শেকড়বিচ্ছিন্ন বিশ্বমানব এ জন্মে বুঝবে না। বাঙালি জাতির সংজ্ঞায়ন হয় এই ভূখণ্ডের আবহমান মাতৃকা উপাসক তন্ত্রধর্মের পালনে। এবং সেই cirterion আমরা হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকে, পাণ্ডু রাজার ঢিবির সময় থেকে পালন করি। অর্থাৎ চার হাজার বছর আগে থেকে আমরা আমাদের জাতি বা বৃহৎ সম্প্রদায় বা ইম্যাজিন্ড কমিউনিটি নির্মাণের শর্ত হিসেবে মাতৃধর্মকে আমাদের সত্ত্বার কেন্দ্রে স্থাপন করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র তৈরি করেছি ভারতের পূর্ব প্রান্তে। ধর্ম হল বৃহৎ সম্প্রদায় বা জাতি তৈরির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত।
৭. বৈদিক আর্যদের ঐতরেয় আরণ্যকে বয়াংসি বঙ্গবগধাশ্চেরপাদা শ্লোকটি পাওয়া যায়। অর্থাৎ বঙ্গ, বগধ ও চের জনগোষ্ঠী বলাকাবৎ। বগধ হয়ত মগধের বর্ণবিপর্যয়, নতুবা বাংলার প্রাচীন বাগদি জনগোষ্ঠীর দিকে ইঙ্গিত। চের হল কেরল জাতির প্রাচীন নাম, সেযুগে পূর্ব ভারতে এঁদের দ্রাবিড় উপাদান উপস্থিত থাকতে পারে।
কিন্তু বলাকা? অতুল সুর অনুমান করেছিলেন যে বলাকা টোটেম উপাসক ছিলেন প্রাচীন বাঙালি। খুবই চিত্তাকর্ষক বিষয় হল, পাণ্ডু রাজার ঢিবি এবং সমকালীন বাংলায়, আজ থেকে চার হাজার বছর আগে , অন্তিম হরপ্পা সভ্যতার সমকালে বলাকা মাতৃকা প্রভূত জনপ্রিয় ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
এই বলাকা মাতৃকা মা কালীর আদি রূপ, আমি গবেষণা করে দেখিয়েছি। ১. মা কালীর উত্থান ২. মা কালীর উৎসরণ
অর্থাৎ, বাঙালি জাতির বয়স চার হাজার বছর, কারণ আমাদের স্বকীয় পরিচয়, আমাদের তন্ত্রধর্মী সভ্যতা, আমাদের কালীধর্ম, আমাদের বৃহৎ সম্প্রদায়ের নির্মাণ পূর্ব ভারতের এই ভূখণ্ডে চার হাজার বছর আগেই ঘটেছে, যা ঐতরেয় আরণ্যকের বয়াংসি শ্লোকের পাশাপাশি পাণ্ডু রাজার ঢিবির বলাকা মাতৃকার উপস্থিতির সাক্ষ্য থেকে জানা যাচ্ছে।