গঙ্গারিডি সভ্যতা ও পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে পাওয়া মাতৃমূর্তিগুলি পরবর্তী তন্ত্রধর্মের বীজস্বরূপ। এখানে বাঙালির প্রকৃতিপূজার অকৃত্রিম রূপ ও তার ক্রমান্বয়ে পরিবর্তনের যে ধারা লক্ষ্য করা যায় তার থেকে বাঙালির ধর্মের বিবর্তনের একটি রূপরেখা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন নয়। লিখেছেন- রক্তিম মুখার্জি
বৈশিষ্ট্যসমূহের তুলনামূলক আলোচনা
এক: প্রকৃতি বা আদিমাতৃকার সার্বভৌমত্ব
পুরুষতত্ত্ব তাঁর পদতলে অথবা শিশুরূপে তাঁর কোলে অবস্থিত। ইঙ্গিতটি স্পষ্ট। বঙ্গের আদিমাতৃকার সাথে কোনো পরমপিতা বা পরমেশ্বরের অস্তিত্ব কল্পিত হয়নি। এখানে সাঙ্খ্যবর্ণিত নির্বিকার নিষ্ক্রিয় পুরুষ একান্তভাবেই দেবীর শরণাগত।
দুই: আদিমাতৃকার সাথে তাঁর দুই বা চার সহচরীর সমাবেশ
তাঁরা তিনজন বা পাঁচজন তন্ত্রের দেহতত্ত্বের আদি দ্যোতক। দেহতত্ত্বে ঈড়া পিঙ্গলা সুষুম্না এই তিন নাড়িই ঐ তিন দেবীর রূপকে প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে সংখ্যাটা পাঁচ সেখানে দেখা যায় তিনজন দেবী একসাথে বিরাজিতা। দুইজন তাঁদের পদতলে সেবারত। এখানে কেন্দ্রে যিনি আছেন তিনিই সূষুম্নাপথে অবস্থিতা কুলকুণ্ডলিনী। পাশের দুই দেবী এবং পদতলের দুইজন ঈড়া ও পিঙ্গলার যথাক্রমে নিবৃত্ত্যাত্মক(ঊর্ধ্বমুখী) ও প্রবৃত্ত্যাত্মক(নিম্নমুখী) গতির প্রতীক।
তিন: পক্ষীমাতৃকার বিশেষ গুরুত্ব
পাণ্ডুরাজার ঢিবি, চন্দ্রকেতুগড়, বাণগড় সর্বত্র পক্ষীমাতৃকার মূর্তি পাওয়া যায়। এই মূর্তিতে দেবীর মুখ পক্ষীর, দেহ মানবীর। উন্নত স্তনযুগল মাতৃস্নেহের এবং উন্মুক্ত যোনি জগতপ্রসবিনীর চিরন্তন মাতৃত্বের দ্যোতক। আশ্চর্যের বিষয় হল তন্ত্রে ও পুরাণে বহুস্থানে এই পক্ষীমাতৃকার প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আমরা পাই। পুরাণে হরপার্বতীর বিবাহ প্রসঙ্গে শিবের বরযাত্রীদের মধ্যে দেবী কালিকার রূপ প্রসঙ্গে নীলাকাশে বলাকার ন্যায় এই উপমা প্রযুক্ত হয়েছে। কালীর পঞ্চদশ নিত্যাশক্তির মধ্যে আমরা অস্থিমালিনী দেবী বলাকার নাম পাই। রামপ্রসাদ তাঁর গানে বলেছেন:
কালী পদ্মবনে হংস সনে হংসীরূপে করেন রমণ।
তন্ত্র ও যোগশাস্ত্রে সহস্রারের নিরালম্বক্ষেত্রের নিচে অজপা হংসের ধারণা করা হয়। সম্ভবত এই ধারণা পক্ষীরূপিণী দেবীর কল্পনা থেকেই অনুপ্রাণিত। দশমহাবিদ্যার অন্যতমা বগলামুখীর নামের মধ্যে সম্ভবত সেই পক্ষীমাতৃকার স্মৃতি রক্ষিত আছে। এমনকি অষ্টাদশ শতাব্দীর কলকাতার কালীপূজার একটি চিত্রে দেখা যাচ্ছে দেবী কালিকার বামপাশে সপ্তমাতৃকার মূর্তি। তাঁদের মধ্যে গজারূঢ়া দেবীর(সম্ভবত ঐন্দ্রী) মুখ পক্ষীর মতো। সম্ভবত বঙ্গের আদিমাতৃকা কিছু বিশেষ পশু পাখির সাযুজ্যে বর্ণিতা হতেন। কিছু বিশেষ উদ্ভিদ ও প্রাণীর আকৃতির মধ্যে দেহতত্ত্বের রূপ কল্পনা করেছিলেন আদি বাঙালিরা। তাই তাদের কথা বারবার উল্লিখিত হয়েছে। যেমন মাছ, শকুন, পেঁচা, বানর, হাঁস, শেয়াল প্রমুখ বাস্তবের প্রাণী ও পক্ষীরাজ ঘোড়া নামক কাল্পনিক প্রাণী। রোদ আর বৃষ্টির বিরল সমাবেশ ঘটলে আজও বাঙালি রহস্য করে বলে:
রোদ হয় জল হয় খেঁকশেয়ালের বিয়ে হয়।
এই খেঁকশেয়ালকে যদি সুষুম্নাকাণ্ডের রূপক ভাবি, তবে রোদ আর জল হল সহস্রারের জ্যোতিরূপ পরমতত্ত্ব ও সুধারূপ মহাসুখের একত্র সমন্বয়। তন্ত্রে শিবাভোগ দেওয়ার বিধি সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে সেখানে স্বয়ং দেবীই শৃগাল রূপে কল্পিত হন। সপ্তমাতৃকার বারাহী ও নারসিংহীর মূর্তি কিম্বা শিবাশতনিনাদিনী অর্থাৎ শত শৃগালের ন্যায় নিনাদকারিণী চণ্ডিকাশক্তির তাৎপর্যও একই।
আমরা বৈগ্রাম তাম্রশাসনে দেখেছি বিষ্ণুদেবকে কোকামুখস্বামী নামে অভিহিত করা হয়েছে। দেবী চণ্ডী কোকামুখী নামে পরিচিত ছিলেন। সম্ভবত এই সমস্ত পশুমুখী বা পক্ষীমুখী দেবীগণের মধ্যে পক্ষীমাতৃকাই সর্বাধিক পূজিতা হতেন। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে আরো একটি সিদ্ধান্তে আসা যায়। ঐতরীয় আরণ্যকে বঙ্গবগধ চের প্রমুখ দেশের অধিবাসীদের ভাষাকে পক্ষীভাষার সাথে তুলনা করা হয়েছে। আদিমাতৃকার পূজক বাঙালি কোন্ ভাষায় কথা বলত তা আমরা এখনও জানি না। তবে বেদের মধ্যে তার একটি পরোক্ষ সূত্র আমরা পাই। ঋগ্বেদে ইন্দ্র আর বসুক্রের কথোপকথনের মাধ্যমে আমরা তিনটি গাথার সন্ধান পাই। আমি একটির বাংলা অনুবাদ বলছি।
নদীর ধারা উজানে বয়ে চলেছে। খেঁকশেয়াল বরাহকে নাশ করছে। ভুঁড়োশেয়াল সিংহকে ঝোপ থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে।
ইন্দ্র বসুক্রের কথোপকথন থেকে বোঝা যায় এই গাথার তাৎপর্য তাঁদের অজানা ছিল এবং অনেকটা এখনকার দিনে লোকে যেমন চর্যাপদকে হেঁয়ালির চোখে দেখে; তাঁরাও এই গাথাকে সেইরকম কিছু মনে করতেন। এই গাথাটির তান্ত্রিক তাৎপর্য নিরূপণ খুব কঠিন নয় এবং সম্ভবত আদিতন্ত্রের রচয়িতাদের একটি প্রবণতা ছিল এরকম হেঁয়ালিপূর্ণ পদ রচনা করা। বৈদিক আর্যগণ এইধরণের গাথার সাথে একেবারেই অপরিচিত ছিলেন। যেহেতু বঙ্গের আদি মাতৃপূজক জাতি বহুলাংশে পক্ষীমাতৃকার উপাসনা করতেন; সম্ভবত সেই কারণেই অজ্ঞতাবশত এই হেঁয়ালিপূর্ণ তন্ত্রের ভাষাকে বৈদিক সংস্কৃতির ধারকগণ পক্ষীর ভাষা বলেছেন।
চার: বৃক্ষমাতৃকার উপাসনা
শুধু পক্ষীমাতৃকা নয়; বৃক্ষমাতৃকাও সমধিক পূজিতা হতেন। শাল অশ্বত্থ তাল প্রভৃতি ঋজুকাণ্ডের বৃক্ষ এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে এই আদিতন্ত্রে। রূপকথার গল্পে তিনতালগাছ উপরে রাক্ষসের মরণ ভোমরার উদাহরণটি এই প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আবার দণ্ডাকৃতি সুষুম্নার আজ্ঞাচক্রে এসে সর্পের মতো বক্র হয়ে যাওয়ার যে দেহতাত্ত্বিক তাৎপর্য সেটাই বাঙালির মন্দিরগাত্রে সুপরিচিত শালভঞ্জিকা মূর্তির রূপ পেয়েছে। বেশ বোঝা যায় আদিতন্ত্রের তত্ত্বচিন্তা প্রকৃতির জীবজগত উদ্ভিদজগত প্রজননের ধারণা প্রভৃতির চিরপরিচিত আঙ্গিকের মধ্যেই রচিত হয়েছিল। আমরা চন্দ্রকেতুগড়ে এমন একাধিক মূর্তি দেখেছি যেখানে দেবী নিজে বৃক্ষের কাণ্ড, তাঁর যোনি থেকে বৃক্ষের মূল নির্গত হয়েছে, তাঁর মস্তক ঘিরে বৃক্ষের পত্রসমূহ বিস্তৃত। প্রকৃতিমাতৃকার শস্যদায়িনী বৃক্ষমাতৃকা রূপের সবথেকে বড় দৃষ্টান্ত দুর্গাপূজার নবপত্রিকা। সেখানে বিল্ব, অশোক, জয়ন্তী, কদলী, দাড়িম্ব, ধান্য, হরিদ্রা, মান, এবং কচু এই নয়টি উদ্ভিদ যথাক্রমে শিবা, শোকরহিতা, কার্ত্তিকী, ব্রহ্মাণী, রক্তদন্তিকা, মহালক্ষ্মী, দুর্গা, চামুণ্ডা ও কালীর প্রতীক। এখানে প্রকৃতিভাবনার সাথে আয়ুর্বেদের ধারণাও গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এবং সেই কারণেই এমন অনুমান করা খুব অসঙ্গত নয় যে এই বৃক্ষমাতৃকার উপাসকগণ ভেষজচিকিৎসা সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন এবং তাঁদের বিশেষ কিছু ঔষধি গুণাবলির জ্ঞান ছিল।
পাঁচ: নগরমাতৃকার আরাধনা
পাশাপাশি নগরমাতৃকার আরাধনার কথাও আমরা শুনেছি। আর্য সংস্কৃতিতে তাঁরও প্রবেশ ঘটেছে যেমন আমরা বেদে শুনি ‘অর্বারী ইযং নগরী’ বা অর্বারীরূপিণী নগরমাতা। বঙ্গের আদিমাতৃকারা নগর বা গ্রামপ্রধান দেবীরূপেও পূজিতা হতেন। আজও আমরা দেখেছি হিন্দু গৃহস্থরা বাসগৃহের পূজা করার সময় গৃহমাতা, শীতলাদেবী ইত্যাদি দেবীর পূজা করে থাকেন। আবার বিশেষ কিছু পুরাণ ও লোককথা থেকে বোঝা যায় রাণীমাতা, দুর্গা, চণ্ডীপ্রভৃতি দেবীদের কোন বিশেষ অঞ্চলের প্রধান দেবী হিসেবে সম্মান জানানো হত। যেমন পুরাণে বর্ধমানের রাণীমাতা সিংহবাহিনী, বিষ্ণুপুরের দুর্গা, শীতলাতন্ত্রে মুর্শিদাবাদের কুলুটচণ্ডী বা কোলকাতা ও মেদিনীপুরের একাদশচণ্ডী। এই নগরমাতৃকার পূজা বাংলায় যুগ যুগান্ত ধরে চলে আসছে এবং এখনও বিংশ শতাব্দীতে যে পূজা ও মেলা গৃহমাতৃকা, ধানমাতৃকা, শীতলাদেবী, চণ্ডীদেবী ও মনসামঙ্গলের প্রতিপত্তি প্রত্যক্ষ করা যায়। এখানেও গঙ্গারিডি সভ্যতার আদিম প্রথার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।
এই প্রসঙ্গে গঙ্গারিডি সভ্যতায় বুদ্ধবন্দনা বিষয়ক মূর্তিগুলি গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃপূজক বাঙালি কেন বুদ্ধের স্থবিরযান গ্রহণ করেছিল এ প্রশ্নের উত্তর বেশ জটিল। দুই থেকে আড়াই হাজার বছর আগের আর্যাবর্তে বৈদিক ও শ্রামণ্য এই দুই ধারা প্রচণ্ড প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। মগধ সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক প্রভাব ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছিল গৌড়বঙ্গে। নন্দবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপদ্ম বা উগ্রসেন গঙ্গারিডি জাতিরই মানুষ ছিলেন। ফলে নন্দবংশের রাজত্বকালে গঙ্গারিডি জাতির প্রভাব ও স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ ছিল। কিন্তু মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থানের সাথে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। অশোকের কলিঙ্গ জয়ের সময় প্রধান প্রতিরোধ এসেছিল সম্ভবত দক্ষিণ বঙ্গের গঙ্গারিডি জাতির মাধ্যমেই। হয়তো অশোকের বিজয়ের ফলেই গঙ্গারিডি জাতি স্থবিরযানের প্রতি কিছু পরিমাণে আনুগত্য প্রদর্শন করেছিল। আবার এটাও ঠিক তৎকালীন বৈদিক ও বৌদ্ধমতের মধ্যে বৌদ্ধমত তুলনামূলকভাবে বাঙালির মনোজগতের বেশি নিকটবর্তী ছিল। বুদ্ধের চিন্তাধারা কপিলের সাঙ্খ্যমতের দ্বারা গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল। তাঁর শাক্যবংশও কপিলের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ছিল। রাজধানী কপিলাবস্তুর নাম তারই সাক্ষ্য। বুদ্ধের পূর্ববর্তী সাধক আলাড় কালাম ও রুদ্রক রামপুত্র সাঙ্খ্যযোগের চর্চা করতেন। কাজেই সেই মুহূর্তে বাঙালির পক্ষে বৌদ্ধমত গ্রহণ অপেক্ষাকৃত সহজ ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক ছিল।
তবে এই বুদ্ধসাধনার মধ্যেও আমরা পরোক্ষভাবে মাতৃপূজার এক অদ্ভুত প্রভাব প্রচ্ছন্ন অবস্থায় দেখতে পাই।
বুদ্ধের মূর্তিগুলি সবই কল্পিত হয়েছে সুবিশাল বৃক্ষের ছত্রচ্ছায়ায়; কখনও দুটি বৃক্ষের মধ্যে। আমরা আগেই দেখেছি বৃক্ষ আর মাতৃকা বঙ্গের সংস্কৃতিতে প্রায় অভিন্নরূপে উপস্থাপিত হতেন। খুব সম্ভবত এই বৃক্ষের ছায়ায় বুদ্ধের অবস্থান দিয়ে বাঙালি ইঙ্গিত দিয়েছে বহিরঙ্গে সে যে মতেরই অনুগামী হোক না কেন; অন্তরঙ্গে সে চিরকাল প্রকৃতিমাতৃকারই পদাশ্রয়ী। বুদ্ধের মূর্তিগুলিতে বন্দনারত অবস্থায় কখনও পাঁচ কখনও নয়জন নারীকে দেখা যায়। এখানে একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো একটিও মূর্তিতে কোনো পুরুষের উপস্থিতি নেই। সম্ভবত বাঙালির সংস্কৃতির মুখপাত্র সে যুগে ছিলেন তান্ত্রিক নারীগণ; অথবা বলা যায় তন্ত্রের মাতৃসাধনার কাল্টগুলিকে বুদ্ধের বন্দনা করতে বাধ্য করা হয়েছিল সেই সময়। কিন্তু অলক্ষিতে মাতৃসাধনার ধারা সম্ভবত অক্ষুণ্ণই ছিল। এরই বিশেষ প্রমাণ পাওয়া যায় একটি মূর্তিতে যেখানে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের চিত্র স্থান পেয়েছে। সেখানেও বৃক্ষতলে বুদ্ধ শায়িত; নয়জন নারী তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। কিন্তু বৃক্ষের অন্তরাল থেকে একজন নারী বুদ্ধের দিকে সকৌতুকে চেয়ে আছেন। আমরা বলতেই পারি এ হল প্রকৃতিবিমুখ উচ্ছৃতি বা নির্বাণের সাধক বুদ্ধের শবের ন্যায় নিষ্ক্রিয় অবস্থা দর্শনে প্রকৃতিপূজক বাঙালির গূঢ় হাস্য। শববৎ শায়িত বুদ্ধের মাথায় বৃক্ষরূপিণী মাতৃকা আর শবশিবের বক্ষে হাস্যযুক্তা কালিকা একই ভাবনার দ্যোতক। এই বৃক্ষমাতৃকার ধারণা পরবর্তী সময়েও বারবার ফিরে এসেছে। পালযুগে পুরুষ প্রকৃতির সংশ্লেষে উৎপন্ন তন্ত্রের মধ্যে আদিতন্ত্রের ভাব যখন পুনরায় জাগ্রত হচ্ছে মনসা চর্চিকা চুন্দা প্রভৃতি দেবীর উপাসনার মাধ্যমে; তখনও বৃক্ষতলে তাঁদের মূর্তি কল্পিত হচ্ছে। বৃক্ষতলে অবস্থিতা চর্চিকার একাধিক মূর্তি; বিল্ববৃক্ষতলে দুর্গার বোধন প্রভৃতি সেই আদি প্রকৃতিসাধনার ধারাকেই গুপ্তভাবে বহন করেছে।
বাঙালির ধর্মে বৌদ্ধপ্রভাব প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে বুদ্ধ পূর্ব ভারতের অঙ্গ মগধ বৃজি মল্ল প্রমুখ রাজ্যে গেলেও জীবদ্দশায় কখনও কপিলের জন্মভূমি বঙ্গের মাটিতে পদার্পণ করেন নি। অথচ তাঁর বঙ্গলিপি বিষয়ে জ্ঞান এবং বিজয়সিংহের লঙ্কাজয়ের সাথে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর কিংবদন্তি থেকে বোঝা যায় বঙ্গের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগত তাঁর অপরিচিত ছিল না। বোধহয় তিনি জানতেন তাঁর প্রকৃতিবিমুখ নির্বাণের ধারণা প্রকৃতিপূজক বাঙালি গ্রহণ করবে না। আদি সাংখ্য থেকে ধ্রুপদী সাংখ্য এসেছে আর ধ্রুপদী সাংখ্য থেকেই থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্ম। কাজেই তন্ত্রের সাথে বৌদ্ধ থেরবাদের সম্পর্ক বেশ জটিল ছিল।
এবং আমরা দেখছি পরবর্তী সময়ে এই ধারণাকে সত্য করে বাঙালি হীনযানকে পরিত্যাগ করে শশাঙ্কের সময়ে মহাযানের সাথে শৈবতন্ত্রের সমন্বয় ঘটিয়েছিল, পাল যুগে তন্ত্রপ্রভাবিত বজ্রযান ও সহজযানের জন্ম দিয়েছিল।
উপসংহার
গঙ্গারিডি সভ্যতা ও পাণ্ডুরাজার ঢিবির মাতৃমূর্তিগুলি বাংলার প্রাচীন তান্ত্রিক ও লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলন হিসেবে দেখা যায়। এখানে মাতৃমূর্তিগুলির বৈশিষ্ট্যসমূহ যেমন প্রকৃতি, পশু ও পক্ষীমাতৃকার উপাসনা, বৃক্ষমাতৃকার পূজা এবং নগরমাতৃকার আরাধনা বাংলার তন্ত্রধর্মের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বঙ্গের আদিমাতৃকার সাথে প্রাচীন প্রাকৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের সংমিশ্রণ তন্ত্রধর্মের বিবর্তনের একটি গভীর রূপরেখা প্রদান করে।