আজ নাগপঞ্চমী। সমগ্র বাংলায় মা মনসার পূজার সুদীর্ঘ পরম্পরার সূচনার তিথি। সর্পমাতৃকার উপাসনার রীতি হরপ্পার সময় থেকে আজ পর্যন্ত বাঙালির সংস্কৃতির এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। লিখেছেন – ডঃ রক্তিম মুখার্জি
সর্পমাতৃকা একদিকে যোগসাধনা ও দেহতত্ত্বে কুণ্ডলিনীর তত্ত্বের প্রতীক। অন্যদিকে বিষবিদ্যা অর্থাত বিভিন্ন প্রাণঘাতী বিষ ও রোগের চিকিৎসার এক দেশজ পরম্পরার ধারকও বটে। আবার জগতগৌরী রূপে তিনিই জলময়ী মাতৃকা। তিনিই অক্ষর ও ছন্দের জননী। পালযুগে একক মাতৃকা হিসেবে সবথেকে বেশি মূর্তি পাওয়া গিয়েছে সর্পমাতৃকা মনসার। শুধু তাইই নয়। নাগমাতার উপাসনার ধারার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল; এটি মাতৃপূজার অন্যান্য ধারাগুলির মধ্যে এক অপূর্ব সমন্বয়ের কাজ করেছে। বাঙালির তিনটি মাতৃপীঠের উদাহরণ দিয়ে বিষয়টির পর্যালোচনা করব।
এক; তারাপীঠ।
এখানে মা তারা বশিষ্ঠের আরাধিতা। তিনি দ্বিভুজা। সমস্ত অঙ্গে সাপের আভরণ। পুত্ররূপে শিশু শিবকে কোলে নিয়ে তাঁকে বিষের জ্বালা থেকে পরিত্রাণ দিতে মাতৃস্নেহে স্তন্যদান করছেন। একদিকে সাপের আভরণ। অন্যদিকে বিষ থেকে পরিত্রাণ। নাগমাতার দুই প্রধান বৈশিষ্ট্যই মা নীলসরস্বতী একজটা তারার মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
দুই; আকালিপুরের মা গুহ্যকালী।
গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়; তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা; গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা; কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র; স্কন্ধে সাপের উপবীত।মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র। কর্ণে শবদেহের অলংকার। হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা; বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ; বামে বৎসরূপী শিব; তিনি নবরত্নভূষিতা; নারদাদিঋষিগণ তাঁর সেবা করেন; তিনি অট্টহাস্যকারিণী, মহাভীমা ও সাধকের অভিষ্ট ফলপ্রদায়িনী। কিংবদন্তি অনুযায়ী তিনি মগধরাজ জরাসন্ধের ইষ্টদেবী। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে গঙ্গার তীরে কুসুমপুরে ( মগধের রাজগীর পাটলিপুত্র অঞ্চলের প্রাচীন নাম) কালীর করালা ও বেতালা রূপের পূজার বিবরণ আছে। রাজগিরের মণিয়ার মঠ ( মণিনাগের নামে) মহাযানের মধ্যে তন্ত্রের আত্মপ্রকাশের এক প্রাচীন পীঠ। বেশ বোঝা যায় গাঙ্গেয় অববাহিকায় কালী ও সর্পমাতৃকার একীভূত সাধনার এক অত্যন্ত প্রাচীন ধারা আছে। গুহ্যকালীর মধ্যে সেই ধারাই অপূর্ব রূপ লাভ করেছে।
তিন; বর্ধমানের নারিকেলডাঙ্গার জগৎগৌরী বিগ্রহ।
পালযুগের এই মূর্তি জগদ্ধাত্রী ও মনসার মিশ্রিত রূপকল্পনায় বিধৃত। কষ্টিপাথরে তৈরী। দেবী সিংহের উপর উপবিষ্টা। সিংহের পৃষ্ঠে পদ্ম। পদ্মের উপর দেবী দেবী শিরদাঁড়া সোজা করে উপবিষ্টা। ডান পা ঝোলান, বাঁ পায়ের হাটু মোড়া। বামক্রোড়ে একটি শিশু। শিশুটিকে গণেশ বলে মনে করা হয়। এখানে গণেশজননী দুর্গার রূপ-কল্পনা। সিংহবাহিনী মূর্তির মধ্যে দুর্গার বা জগদ্ধাত্রীর রূপকল্পনা বিধৃত। দেবীর মাথার ওপর অষ্টনাগ ফণা বিস্তার করে ছত্রধারীরূপে ক্ষোদিত। দেবীর পদতলে ছিন্নমুণ্ডটি কলির ছিন্নমুণ্ড বলে প্রবাদ।”
এখানে গণেশজননী উমা; সিংহবাহিনী দুর্গা/জগদ্ধাত্রী এবং মনসা তিন রূপ একাকার হয়ে গিয়েছে।
সুতরাং কালীক্ষেত্রের পর্যালোচনায় সর্পমাতৃকার উপাসনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজ তাই বর্ধমানের এমন চারটি গ্রামের কথা জানব; যে গ্রামগুলি নিজেই মনসাপূজা ও সাপের সাথে মানুষের সহাবস্থানের এক অনন্য ক্ষেত্র। পূর্ব বর্ধমানের ভাতার ও মঙ্গলকোট থানার এই চারটি গ্রাম হল মুসুরি (কেউ বলেন মুশারু), ছোটপোষলা, পলসোনা ও বড়পোষলা। এখানেই পূজিত হন ঝাঁকলাই মা। বৌদ্ধতন্ত্রে নাগমাতা জাঙ্গুলি নামে পরিচিত। জাঙ্গুলি থেকে ঝাঁকলাই। পরে সংস্কৃত করে নাম ঝঙ্কেশ্বরী। এখানে মা মনসার সাক্ষাত প্রতীক রূপে পূজিত হয় কেউটে সাপের একটি বিশেষ প্রজাতি। গ্রামবাসীরা কালনাগিনী বা ঝাঁকলাই মা নামে পূজা করে এই সাপের। তাঁদের মতে সর্পমাতৃকার এই অভিনব উপাসনার সাথে যুক্ত আছে বেহুলার কিংবদন্তি। এবং এই সাপ নাকি বিষধর হয়েও গ্রামবাসীদের কোনো অনিষ্ট করে না। এই চারটি গ্রাম তাই বিষধর সাপের সাথে মানুষের সহজাত শত্রুতার বিপরীতে সহাবস্থানের অপূর্ব উদাহরণ। প্রকৃতিপূজক বাঙালির সংস্কৃতির এও এক বিশেষ দিক। আমাদের মাতৃকা জগতকারণ। তিনি প্রকৃতিরূপিণী। তাই অরণ্যপ্রকৃতি ও সমস্ত জীবজগতকে নিয়েই আমাদের মাতৃপূজার পরিমণ্ডল রচিত হয়েছে। রাঢ়ের এই ঝাঁকলাই মায়ের উপাসনাও তারই দৃষ্টান্ত।