অজন্তা। খ্রীষ্টপূর্ব যুগের অন্যতম স্থাপত্য যা আজও জীবন্ত হয়ে সেই নির্দিষ্ট স্থানেই বিরাজমান। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হাতে বানানো তিরিশটি গুহা। সেই গুহার দেওয়ালে অপূর্ব সব চিত্র ও মূর্তি। কোথাও বা বৌদ্ধস্তুপ। লিখছেন- ডঃ ঋতুপর্ণা কোলে।
প্রথম পর্ব
ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানোর নেশা একবার পেয়ে বসলে ঘরে বসে থাকা দুষ্কর হয়ে যায়। কিন্তু ছুটি বড়ো বালাই। হঠাৎ-ই সুযোগ হয়ে গেলো শনি ও রবিবারের আগে ও পরে স্বাধীনতা দিবস ও রাখি বন্ধন। যাত্রার অভিমুখ সম্ভাজি নগর তথা ঔরঙ্গাবাদ। ছোটো থেকে ইতিহাস বই-য়ের পাতায় পড়া, স্বপ্ন কল্পনায় দেখা সেই অজন্তা ইলোরার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। এ যেনো অবিশ্বাস্য। বাকিটা পড়তে নীচের লিঙ্কে যান-
দ্বিতীয় পর্ব
ইতিহাসের বইটা খোলার আগে অজন্তা, ইলোরা দেখার জন্য কীভাবে আসবেন, কোথায় থাকবেন, ট্যুর প্ল্যানটাকে কীভাবে সাজাবেন এসব তথ্যগুলি আগে জেনে নেওয়া যাক। যাত্রার শুরুটা সবসময়ই অজন্তা থেকেই করা ভালো। সময় প্রবাহের অভিমুখটা ধরা সম্ভব হয়। অজন্তার যাত্রা শুরু হয়েছিলো খ্রীষ্ট পূর্ব যুগে আর সমাপ্ত হয় পঞ্চম খ্রীষ্টাব্দে, ইলোরার সময় কাল পঞ্চম থেকে একাদশ শতকে এবং ঔরঙ্গাবাদ গুহার সময়কাল ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে।
অজন্তায় আসার জন্য সবচেয়ে কাছের বড়ো স্টেশন হল জলগাঁও। কোলকাতা ও ভারতের নানাপ্রান্ত থেকে জলগাঁও অবধি আসার ট্রেন সহজলভ্য। এছাড়া জলগাঁও-এ ছোট্ট বিমানবন্দরও আছে। তবে ঔরঙ্গাবাদ বিমানবন্দরটিই সবাই ব্যবহার করেন অজন্তা ইলোরার জন্য। ভারতের বেশিরভাগ প্রধান শহর থেকে ঔরঙ্গাবাদ এয়ারপোর্টের বিমান পাওয়া যায়।
জলগাঁও থেকে অজন্তার দূরত্ব ৫৫ কিমির কাছাকাছি। অন্যদিকে ঔরঙ্গাবাদ থেকে দুরত্ব ১০২ কিমি। আমরা ঔরঙ্গাবাদ থেকে অজন্তায় গিয়েছিলাম।
স্টেশন, এয়ারপোর্ট দুজায়গাতেই সরকার অনুমোদিত প্রিপেড ট্যাক্সি কাউন্টার আছে। তাছাড়া মহারাষ্ট্র বাস সার্ভিস-ও খুব ভালো। অজন্তা যাত্রা হোক কিংবা ইলোরা কিংবা ঔরঙ্গাবাদের যেকোনো জায়গায় যাওয়ার জন্য বাস পাওয়া যায় সহজেই।
এবার আসি থাকার প্রশ্নে। এখানেও ভরসা করা যায় মহারাষ্ট্র সরকারকে। প্রতিটা জায়গাতেই গেস্ট হাউস আছে। MTDC গেস্টহাউস সহজেই অনলাইনে বুক করা যায়। তবে আমরা সরকারি জায়গায় থাকিনি। দুই রাত ছিলাম অজন্তায় এবং এক রাত ছিলাম ইলোরায়। দুটোই ছিলো প্রাইভেট রিসর্ট।
অজন্তা গ্রীন হোটেলটি অজন্তা গুহার খুব কাছেই। এদের খাবারের স্বাদ অনবদ্য। সাধারণত এদের রেস্টুরেন্টটিতে ভেজ খাবার দেওয়া হলেও বোর্ডাররা ননভেজ খাবার খেতে পারে। থালির পাশাপাশি এখানকার চিকেন কোলাপুরীর স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। লিখতে লিখতে জিভে জল আসছে। রুম ভীষণ পরিষ্কার।
অজন্তায় যখন পৌঁছে ছিলাম তখন সন্ধ্যে। অজন্তার গুহা ঘুরেছিলাম পরের দিন, সারা দিন। তারপরের দিন সকালেই যাত্রা শুরু করলাম ইলোরার পথে। অজন্তা থেকে ইলোরার দূরত্ব ১০৬ কিমি। এই সফরের সারথী অজন্তার পাশেই গ্রামের বাসিন্দা। সে হিন্দি, ইংরেজি, মারাঠী, ফ্রেঞ্চ, জাপানি ভাষায় তুখোড়, কিন্তু স্কুলে যায়নি কখনও। ছোটবেলা থেকে অজন্তার টুরিস্টদের সঙ্গে, গবেষকদের সঙ্গে, ইতিহাস অনুসন্ধিৎসুদের সঙ্গে জীবন কাটিয়েছে। ইতিহাস চেতনার এমন জ্যান্ত উদাহরণ বদ্ধ ক্লাসরুমের বাইরেই মেলে। অজন্তার কিছু বন্ধ গুহার সুলুক সন্ধান সে জানে, যেগুলো সাধারণ ভ্রমণকারীরা দেখতে পান না। ওর মোবাইলে সেই ছবি দেখার অভিজ্ঞতা হল। ২ঘন্টার যাত্রা পথ ছিলো ইতিহাস ও ভুগোলের এক চলন্ত পাঠ।
ইলোরাতে আমরা ছিলাম একেবারে ইলোরা গুহামালার পাশে কৈলাস নামের একটি হোটেলে। ছোট্ট কটেজ আমাদের। ঘর থেকেই দেখা যাচ্ছে ইলোরার গুহা, পাহাড়, ঝর্না ইত্যাদি। রুমটি সাদামাটা হলেও পরিবেশটি অবর্ণনীয়। সারাদিন পাহাড়ের মাথায় চলছে মেঘের লুটোপুটি। হোটেলে যখন পৌঁছালাম ঘড়িতে তখন দুপুর বারোটা। ব্যাগ রেখেই দৌড় দিলাম গুহার দিকে। সন্ধ্যাটা কাটালাম কটেজেই। রাতে অন্ধকার ইলোরার পাহাড়, হোটেলের আলো-আঁধারি লন, ঝিঁজির ডাক, মায়াবী পরিবেশ।
পরেরদিন সকালে ঔরঙ্গাবাদের পথে। Blossoms নামে এক ট্যুর কোম্পানির থেকে গাড়ি নিয়েছিলাম অজন্তা যাবার দিন। ফেরার দিন তাদেরকেই দায়িত্ব দিয়েছিলাম ঔরঙ্গাবাদ গুহামালা ঘোরানোর। আমাদের প্ল্যান সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যার ফ্লাইট ধরে দিল্লি ফেরা। ঔরঙ্গাবাদ গুহামালার খবর অনেকেই জানেন না, অজন্তা ইলোরার মত এত বিখ্যাত নয়। কিন্তু অজন্তা ও ইলোরার ভাস্কর্যের মধ্যে মিসিং লিঙ্ক হল এই ঔরঙ্গাবাদ গুহামালা। এখানে ঘোরার কথা শেষ পর্বে আলোচনা করব।
তৃতীয় পর্ব
শুরু করা যাক নারায়ণ সান্যালের বক্তব্য দিয়ে। “ছেলেবেলায় সোনার কাঠির ছোঁওয়া পেয়ে শতাব্দীর নিদ্রা ভেঙে রাজকুমারী চোখ মেলে চেয়েছিলেন। অজন্তা যেন সেই রূপকথার রাজকুমারী। সহস্রাব্দীর নিদ্রা-অন্তে সভ্যজগতের দিকে চোখ মেলে হঠাৎ সে তাকিয়েছিল ১৮১৭ খ্রীষ্টব্দে।” (অপরূপা অজন্তা- নারায়ণ সান্যাল) তার আগে অবধি পাহাড়ের কোলে, গুহামালায়, গভীর জঙ্গল দিয়ে প্রকৃতি মা সুরক্ষিত রেখেছিলেন ভারতের প্রাচীনতম চিত্রকলাকে এবং অন্যতম শিল্পকলাকে। নারায়ণ সান্যালের বক্তব্য অনুযায়ী, এক ইংরেজ সৈন্যদল এক দূরের পাহাড় চূড়া থেকে গুহাগুলি দেখতে পান এবং বাঘোর নদী পেরিয়ে হাজার বছর পর ‘আবার পড়ল মানুষের পদচিহ্ন’। যদিও স্থানীয় মানুষজন এই গুহা সম্পর্কে অবগত ছিলেন।
তবে সময়টা নারায়ণ সান্যাল ভুল করেছেন, ১৮১৭ নয়। দিনটা ছিল ২৮শে এপ্রিল ১৮১৯। জন স্মিথ নামে এক ব্রিটিশ অফিসার বাঘ শিকারের উদ্দ্যেশে জঙ্গলে প্রবেশ করেছিলেন। এই গুহামালার একটি গুহাকে পাহাড়ের ওপর থেকে এক ছিদ্রপথে আবিষ্কার করেন এবং বিস্মিত হয়ে যান। তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছিলো পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক বালক। সেখান থেকেই আবার অজন্তার কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া শুরু হলো।
অজন্তা। খ্রীষ্টপূর্ব যুগের অন্যতম স্থাপত্য যা আজও জীবন্ত হয়ে সেই নির্দিষ্ট স্থানেই বিরাজমান। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হাতে বানানো তিরিশটি গুহা। সেই গুহার দেওয়ালে অপূর্ব সব চিত্র ও মূর্তি। কোথাও বা বৌদ্ধস্তুপ। এই গুহাগুলি মোটামুটি দুটি পর্বে তৈরী হয়েছে। প্রথম পর্বের সূচনা খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক এবং দ্বিতীয় পর্বের সূচনা ৪০০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ। প্রথম পর্বের গুহামালাগুলি সাতবাহন/শালিবাহন রাজাদের আমলে তৈরী হয়েছিলো। দ্বিতীয় পর্বের গুহামালা সেজে ওঠে বকাতক আমলে।
গুহাগুলির কোনোটি বিহার আবার কোনোটি চৈত্য।
বিহার বলতে মূলত একটি হলঘরকে বোঝায় যাকে ঘিরে অনেকসময় ছোট ছোট ঘর থাকে। হলঘরটি আধ্যাত্মিক আলোচনার কেন্দ্রস্থল। মাঝখানে থাকে বৌদ্ধমূর্তি এবং চারিদিকের দেওয়াল জুড়ে নানা মূর্তি ও চিত্রকলা থাকে। ছোট ঘরগুলি মূলত ঘুমানোর জায়গা। অনেকক্ষেত্রে এই বিহারগুলি কয়েক তল বিশিষ্টও হত।
অন্যদিকে চৈত্য হলো প্রার্থনাগৃহ। এগুলির মাঝের দিকে একটি স্তুপ থাকে। বিহার এবং চৈত্য নির্মাণের ব্যাপারে সময় ও ধর্মীয় চেতনার খানিক ফারাক বর্তমান। চৈত্যগুলি সময়ের বিচারে আগে নির্মিত এবং তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হীনযানীদের হাতে তৈরী।
চলবে……