Wednesday, December 18, 2024
Homeবাঙালির ইতিহাসবঙ্গনারীর সেকাল একাল

বঙ্গনারীর সেকাল একাল

‘নারী’ বিষয়টা এমনই যে প্রকৃতপক্ষে তার কোনো জাত হয় না। তার কোনো কালও হয়না। সারা বিশ্বব্যাপী সর্বত্র আজও নারীরা কম বেশি শোষিত, লাঞ্ছিত, নিপিড়িত। কারণ সে নারী। তবু বাঙালি নারীর অবস্থান চিরকাল আর অন্য নারীদের মত ছিলো না। কোথাও একটা স্বাধীনতা, দৃঢ়তা, বুদ্ধিমত্তার ফল্গুস্রোত বহমান ছিলো। ফলে নির্মিত হয়েছিলো বঙ্গনারীর নিজস্ব এক পরিচয়। আসলে নিজস্ব পরিচয় থাকাটাই স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও বর্তমানে নারীর ক্ষেত্রে তা একটা যথেষ্ট বড় ব্যতিক্রমী ব্যাপার। আজও একজন নারী কারো মেয়ে, কারো স্ত্রী, কারো মা হয়েই সমাজে পরিচিত হয়। তার নিজস্বসত্তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের যৌথ অবদান বিশেষভাবে প্রয়োজন। প্রয়োজন পূরণের কৃতজ্ঞতা বাকি সকলের প্রাপ্য হলেও, কেবল নারীরই তাতে বিশেষ অধিকার থাকে না। তবু নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, নারীর প্রতি সম্মানের মত ভারি ভারি কথাগুলো যথেষ্টই প্রচলিত। আসলে প্রচলন আর প্রয়োগের মধ্যে বিস্তর ফারাক। নারীর প্রতি সমাজের আচরণে সেই ফারাকটাই উঠে আসে। সমাজ বলতে এখানে কেবল পুরুষকে বোঝানো হচ্ছে, তা নয়। এখানে পুরুষে তৈরি করা সমাজের ধারক বাহক যারা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সেই সবার কথাই বলা হচ্ছে। তাই প্রথমেই শিরোনামে ব্যবহৃত শব্দগুলির সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। নারী আসলে কী বস্তু? বঙ্গ বলতে কী বোঝায়? আলাদা করে বঙ্গনারীর বিশেষত্ব কোথায়? এবং সেকাল কোনটা, আর একালই বা কী?

প্রতিটা শব্দেরই একটা উৎস আছে। ‘নারী’ শব্দের জন্ম ‘নৃ’ ধাতু থেকে। যে ধাতু থেকেই ‘নর’ শব্দের জন্ম। যার অর্থ মানুষ। আশ্চর্যভাবে এই ‘মানুষ/নর’ বললে পুরুষ মানুষকেই বোঝায়। তাই ‘নর’ শব্দের একটা স্ত্রী লিঙ্গবাচক শব্দ বর্তমান, আর সেটিই হলো নারী। সুতরাং শব্দের উৎপত্তিতেই একটি বৈষম্যমূলক অসংগতি। মানুষ আর পুরুষমানুষ একই বিষয়। মেয়েমানুষ আর মানুষ এক যে নয় তা প্রমাণ করার তাগিদ তখন থেকেই ছিলো। তবে এইটুকুতেই আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কারণ ‘নারী’ শব্দের প্রতিশব্দের দিকে তাকানো এখনও বাকি আছে। ‘বাংলা অভিধান’ (সাহিত্য সংসদ)- রমণী, স্ত্রীলোক, পত্নী। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ (হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্য আকাদেমি)- নৃজাতির বা নর জাতির স্ত্রী, নরের ধর্ম্ম্যা, স্ত্রীলোক, সীমন্তিনী, পত্নী। এছাড়াও নানা স্থলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে শব্দগুলি আছে তা হলো- কামিনী, প্রমদা, মহিলা, অবলা ইত্যাদি।

এবার এই প্রতিশব্দগুলিকে ধরে ধরে একটু আলোচনা করা যাক। সবার প্রথমে পাওয়া যাচ্ছে ‘রমণী’ এই শব্দ দ্বারা প্রকাশ পায় যে নারী রমণের উপযুক্ত। সমাজের চোখে চিরকালই নারীর কাজ রমণ ক্রীড়ার দ্বারা পুরুষকে আনন্দ দেওয়া। এরপর আসছে ‘স্ত্রীলোক’। লোক অর্থেই পুরুষ ফলে স্ত্রীলোক শব্দটাই যথেষ্ট যা বলতে চাওয়া হচ্ছে তার পক্ষে একটা যুক্তি হিসাবে দাঁড় করাতে। নারী মানেই পত্নী এই আশ্চর্য সমীকরণ চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। নারীর প্রধান যা কাজ সমাজ নির্ধারণ করেছে তা সমাজের চোখে পত্নী ছাড়া করা অসম্ভব তাই নারী মানেই পত্নী। বিবাহ থেকে দূরে থাকা নারী আসলে নারী নয়। বাকি ‘বঙ্গীয় শব্দকোষে’ প্রাপ্ত শব্দগুলির প্রতিটায় প্রমাণ করে পুরুষ ব্যতীত নারী অর্থহীন। এবার তাকানো যাক আরও প্রচলিত শব্দগুলির দিকে। ‘কামিনী’- কামনায় থাকে যে নারী। ‘কামনা’ শব্দটিই আসছে কামের ইচ্ছা থেকে। ‘প্রমদা’- প্রমোদ দান করেন যিনি। এই দানটা অবশ্যই পুরুষকে করেন। আর পুরুষের প্রমোদ লাভের কারণের মধ্যেও লুকিয়ে আছে রমণ প্রসঙ্গ। ‘মহিলা’-যিনি মহলে থাকেন। অর্থাৎ অন্তঃপুরবাসিনী। ‘অবলা’- দূর্বল অর্থে। সুতরাং পুরুষ ছাড়া যে শক্তিহীন। এখানে একটা আশ্চর্য দ্বিচারিতা লক্ষ্য করার মত। এই সমাজেই শক্তির রূপ কল্পিত হয় নারী মূর্তির আধারে। আজকের আলোচনা সে প্রসঙ্গেই। অভিধানে, সমাজে প্রচলিত নারীর সংজ্ঞা খুব বেশি পুরোনো নয়। বাঙালির বহমান ঐতিহ্য কিন্তু অন্য কথা বলে। সেই আলোচনায় ক্রমে আসা যাবে।

এবার আসা যাক বঙ্গের প্রসঙ্গে। কিন্তু বাংলা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দৃষ্টিকে করতে হবে আরও বিস্তৃত, আরও প্রসারিত। পৌঁছে যেতে হবে সেই হরপ্পা সভ্যতার যুগে, সেই সিন্ধু- সরস্বতীর যুগে। বেশিরভাগ ঐতিহাসিকগণ একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে ভারতবর্ষে বৈদিক-আর্য আগমন সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার কিঞ্চিৎ পরবর্তী বিষয়, তবে অবৈদিক আর্য (গ্রিয়ার্সনের আউটার এরিয়ান বা রমাপ্রসাদ চন্দের অ্যালপাইন আর্য, যাদের কথা হাল আমলে টোনি জোসেফের বিখ্যাত বই আর্লি ইন্ডিয়ানসও গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছে) যারা আমাদের বাঙালিদের পূর্বসূরী তারা সম্ভবত বৈদিক আর্যের কিছু আগেই এসেছিলেন। সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার দিকে তাকালে একটা ব্যাপার নিশ্চিত যে এই সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ছিলো মাতৃতান্ত্রিক শক্তি উপাসনা। এখানে প্রাপ্ত অসংখ্য নারীমূর্তি থেকে একথা অনুমান করাই যায়। সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হলে সে অনুমান ভিত্তিভূমি লাভ করবে তা বলাই বাহুল্য। বৈদিক আর্য জাতির আগমনের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক বলে মনে করা যেতে পারে পুরুষতান্ত্রিকতার আগমন। বর্তমান বঙ্গ (পশ্চিম ও পূর্ব মিলিয়ে) যে ভূখন্ড অধিকার করে রয়েছে সেই ভূখন্ডে আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে থেকে সভ্যতা বর্তমান, তা সিন্ধু সরস্বতী সভ্যতার সমসাময়িক। পরেশচন্দ্র দাশগুপ্তের খননকার্য পাণ্ডুরাজার ঢিবি অঞ্চলে তাইই প্রমাণ করেছে। এর পরবর্তী যে বাঙালি সভ্যতার কথা জানা যায় তা হলো চন্দ্রকেতুগড়। আনুমানিক ২৫০০ বছর আগে গড়ে উঠেছিলো যার ধারাবাহিকতা সেনযুগের শেষ পর্যন্ত ছিলো। নন্দবংশের সময়কালে চন্দ্রকেতুগড়ের (গঙ্গারিডাই) সাম্রাজ্য হিসেবে উত্থান বলে মনে করা হয়। বাংলার ধারাবাহিক রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে গুরুত্বপূর্ণ ক্রমটা দাঁড়ায় নন্দ সাম্রাজ্য, মৌর্য সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য, জয়নাগ-শশাঙ্ক যুগ, এবং এরপর প্রায় ১০০ বছরের অরাজকতা যাকে মাৎস্যন্যায় বলা হয়। সেই স্তর অতিক্রম করে আসে পাল যুগ, সেন যুগ এবং এরপরেই ইসলাম শাসনের শুরু যা ইতিহাসের পাতায় প্রাচীনযুগের অবসান, মধ্যযুগের সূচনা হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত উপাদানের মধ্যে সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার একটা ধারাবাহিকতা দেখতে পাওয়া যায়; মূলত অজস্র নারীমূর্তি এবং মাতৃকা উপাসনা। কিন্তু আজকের বঙ্গীয় সমাজের আচরণের দিকে তাকালে বৈদিক আর্যের মূলভিত্তি পুরুষতান্ত্রিকতার প্রাধান্যই চোখে পড়ার মত। অথচ বৈদিক আর্যের বঙ্গবিজয়ের কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। ইতিহাসকারগণ শক্তি উপাসক বাংলায় নারীর অবদমিত অবস্থান – এই anomaly-র জন্য সরাসরিভাবেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রকেই দায়ী করেছেন, তাই কিছু প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

বাংলাভাষার প্রথম টেক্সট চর্যাপদ (এখনও অবধি যা পাওয়া যাচ্ছে)। তার রচনা কাল সম্পর্কে বলা হয় ৯০০ থেকে ১২০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। তারপূর্বে রচিত সংস্কৃত, প্রাকৃত ইত্যাদি ভাষায় লেখা নানা সাহিত্য, নানা গ্রন্থ থেকে ৯০০ খ্রীষ্টাব্দের আগেকার সমাজজীবনে নারীর অবস্থান নির্ণয় সম্ভব কারণ সাহিত্য সমাজেরই দর্পণ। সাহিত্যিক চান বা না চান সমকালীন সমাজের প্রতিফলন পড়তে বাধ্য। সে নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার অবকাশ অবশ্যই রইলো। এই প্রবন্ধে মূলত ৯০০ খ্রীষ্টাব্দ পূর্ববর্তী কিছু ঐতিহাসিক তথ্য ও কিছু লোককথার উপর ভিত্তি করে সেকালের নারীজীবনের একটা রূপরেখা নির্মাণ করব আমরা। পাণ্ডুরাজার ঢিবি থেকে সেভাবে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। কিন্তু চন্দ্রকেতুগড়ের অসংখ্য মূর্তি (বিশেষত পঞ্চচূড়া) নারীর অবস্থানকে সামনে নিয়ে আসে। পৌরাণিক যুগে চিত্রলেখা নামে একজন মিথিক্যাল বাঙালি নারীর সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। দীনেশ সেন ‘বৃহৎ বঙ্গে’ লিখছেন:

“বাঙ্গলার চিত্রশিল্প বহু প্রাচীন। হরিবংশের চিত্রলেখা বাঙ্গলার আদি যুগের চিত্রকরী। প্রাগজ্যোতিষপুরের বাণ রাজার কন্যা ঊষা স্বপ্নে শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র … অনিরুদ্ধকে দেখিয়া-প্রেমে পতিত হন। এই স্বপ্ন-দৃষ্ট তরুণ সুদর্শন রাজকুমার কে তাহা তিনি কিছুতেই জানিতে না পারিয়া আহার-নিদ্রা ত্যাগ করেন। তাঁহার সখী চিত্রলেখা তখন ভারতীয় তৎকাল-প্রসিদ্ধ যাবতীয় তরুণ রাজকুমারের চিত্র অঙ্কন করিয়া কুমারী ঊষার নিকটে উপস্থিত করেন, তন্মধ্য হইতে ঊষা সহজেই অনিরুদ্ধকে চিনিয়া লইয়াছিলেন। হরিবংশের পূর্ব্বে মনুষ্যমুর্ত্তির অবিকল প্রতিকৃতি অঙ্কনের কথা বোধ হয় আর কেহ বলেন নাই। চিত্রলেখার সময়ে এবং তাহার পূর্ব্ব হইতে যে এদেশে চিত্রবিদ্যার বিশেষ উৎকর্ষ সাধিত হইয়াছিল-এই বিবরণ হইতে তাহা অনুমিত হয়। … নানা কারণে আমরা অনুমান করিয়াছি, বাঙ্গলাদেশই মগধের প্রধান চিত্র-শালা ছিল।” (দীনেশ চন্দ্র সেন, ‘বৃহৎ বঙ্গ’)

প্রসঙ্গত উত্তরবঙ্গে এই বাণ রাজার রাজধানী ছিল। একজন বাঙালি নারী এমন দক্ষ চিত্রশিল্পী ছিলেন, ফলে প্রাচীনযুগে বাঙালি নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছিল বলা যায়। চিত্রলেখার পর দীর্ঘদিন পুরাণ সাহিত্যে সেভাবে কোনও বাঙালি নারীচরিত্রের নাম নেই। এরপর কথাসরিৎসাগরে পুণ্ড্রের রাজা দেবসেনের মেয়ে রাজকন্যা দুঃখলব্ধিকার স্বয়ংবরের উল্লেখ পাই (রজনীকান্ত চক্রবর্তী, গৌড়ের ইতিহাস)। কিন্তু এঁরা মিথিক্যাল চরিত্র। ইতিহাসে প্রথম বঙ্গনারীর উল্লেখ আর একটু পরে এসে পাচ্ছি।

৪৫০-৬৬০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেকার সময়ের বিখ্যাত গ্রামারিয়ান আদি চন্দ্রগোমিনের না-হওয়া-স্ত্রী রাজকন্যা তারার প্রসঙ্গ দিয়েই সেকালের বঙ্গনারীর ঐতিহাসিক আলোচনা শুরু করা যাক। চন্দ্রগোমিন্‌ সম্পর্কে জানা যায়, “অল্প বয়েসে সাহিত্য, ব্যাকরণ, ন্যায়, কলাশাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। রাজশাহীতে জন্ম। বরেন্দ্রর রাজকন্যা তারার সঙ্গে এঁর বিবাহের প্রস্তাব আসে, কিন্তু ইনি তারার উপাসনা করতেন বলে রাজকন্যা তারাকে বিবাহ করতে রাজি হন নি, আরাধ্যা দেবীর নামের সঙ্গে প্রেয়সীর নাম একই হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। ফলে রাজা রেগে গিয়ে এঁকে নির্বাসন দেন বাংলার দক্ষিণপ্রান্তে জলাজায়গায়। যেখানে নির্বাসন দেওয়া হয়, সেই স্থানের নাম তাঁর নামে হয় চন্দ্রদ্বীপ। বহু পরে যা বরিশাল। সেখান থেকে পরে সিংহলে চলে যান”। (Bengaliwiki) এই তথ্য থেকে যে বিষয়গুলি অনুমান করা যায় তা হলো ১) নারী মানেই রমণ সঙ্গী তা কিন্তু নয়। আরাধ্য দেবীর নামের সঙ্গে মিল থাকার কারণে রাজকন্যা তারাকে প্রত্যাখ্যান করেন। নামের মধ্যে দিয়ে সম্মান প্রদর্শনের রীতি আজকের নয়। এখনও গ্রামের মহিলারা বাড়ির পুরুষদের নাম মুখে আনেন না। কিন্তু চন্দ্রগোমিনের কাহিনি থেকে স্পষ্ট নাম থেকে সম্মান মেয়েদেরও প্রাপ্য ছিলো। ২) বিয়েতে না করার অধিকার পুরুষেরও ছিলো না। এখন একটা প্রচলিত কথা আছে, “মেয়েদের বিয়ে হয় আর ছেলেরা বিয়ে করে”। এই কথার মধ্যে দিয়েই সামাজিক বৈষম্য স্পষ্ট হয়। কিন্তু নারী-পুরুষের এই বৈষম্য সে যুগে ছিলো না। ছেলেদেরও সে সময় বিয়ে হত। আশ্চর্যের বিষয় হল, বিয়েতে মত না দেওয়ার জন্য এত বড় পণ্ডিতকেও শাস্তি পেতে হল।

এবার আসা যাক খনার প্রসঙ্গে। নানা প্রবাদের উদ্ভাবক খনার নাম বাঙালি মাত্রই জানেন। অজস্র কিংবদন্তী থাকা সত্বেও খনার ঐতিহাসিক সত্যতা অস্বীকার করা যায় না। খনার বচনের ভাষা আর প্রাচীন নয়, ভাষাগত হিসেবে ৮০০ থেকে ১২০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়কেই ধরা হয়। সে তো ভাষা মুখে মুখে বিবর্তিত হতেই থাকে, বিশেষত প্রবচনের ভাষা। কিন্তু বর্তমানে বারাসাতের দেগঙ্গায় চন্দ্রকেতুগড় হিসাবে যে জায়গাটি চিহ্নিত করা হয়েছে সেখানে খনা-মিহিরের নামে একটি ঢিবি আছে। খনার বচনে উল্লিখিত কৃষি, বৃক্ষরোপন ইত্যাদি বিষয়গুলি বঙ্গদেশের মূলত দক্ষিণবঙ্গে তথা এই যে অঞ্চলে খনা মিহিরের ঢিবি আছে তারই পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে মিলে যায়। অপরদিকে সেই চন্দ্রকেতুগড়ে আবিষ্কৃত খনা-মিহিরের যে ঢিবি তার বিচার বিশ্লেষণ করে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ জানিয়েছেন তা একটি মন্দির ছিল, এবং গুপ্তযুগের সমসাময়িক (সর্বশেষ স্তরটি পালযুগে পুনর্নির্মিত)। গুপ্ত-রাজসভায় বরাহ-মিহিরের উপস্থিতি জানা যায়। যিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী, দার্শনিক, গণিতবিদ হিসাবে খ্যাত ছিলেন। খনার পরিচয় হিসাবেও উক্তবিষয়ে পারদর্শিতার কথা জানা যায় এবং আরও জানা যায় তিনি মিহিরের স্ত্রী। এই মিহিরই আসলে চন্দ্রগুপ্তের রাজসভার বরাহমিহির (অথবা বরাহপুত্র মিহির) সেটা অনুমান করলে আশ্চর্যের কিছু নেই কারণ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ও একই সঙ্গে খনা-মিহিরের নামোচ্চারণ এবং তাদের দাম্পত্যের কিংবদন্তী সেদিকেই ইঙ্গিত করে। এই খনা যে অসম্ভব শিক্ষিত ছিলেন এবং তাঁর পাণ্ডিত্য যে অপরিসীম সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিমত থাকার কথা নেই। নানা বিষয়ে খনার বচন থেকে বলা যায় সেসময় নারীশিক্ষার প্রচলন যেমন ছিলো তেমনি ছিলো নারীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা। বিরুদ্ধবাদী এস্থলে বলতেই পারেন তাহলে খনার জিভ কেনো কেটে নেওয়া হয়েছিলো? সেক্ষেত্রে এটাই ভাবা যেতেই পারে কিংবদন্তীসম পণ্ডিত খনার জিভ কাটার এই গল্প পরবর্তী কালের ব্রাহ্মণ্য-বৈদিক-পুরুষতান্ত্রিক সংযোজন। মাকালীর মূর্তিতে জিভের সংযোজন যদি করানো যেতে পারে, কিংবদন্তীর মধ্যে খনার জিভ কেটে নেওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। সম্ভবত মেয়েদের পাণ্ডিত্যকে ডিসকারেজ করার জন্য কাহিনীটি পরবর্তীকালে তৈরি। যে সভ্যতায় খনার উত্থান হয়েছিল, সেই চন্দ্রকেতুগড় স্পষ্টত নারী স্বাধীনতায় তীব্র বিশ্বাসী ছিল, সেটা চন্দ্রকেতুগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক স্টাডি যারা করেছেন সবাই একমত হবেন, সেখানে খনার জিভ কাটা পড়া সম্ভব নয়।

গুপ্তযুগের পর আসছে জয়নাগ-শশাঙ্ক, বাঙালির প্রথম ঐতিহাসিক সাম্রাজ্য (গঙ্গারিডাই/নন্দ সাম্রাজ্য যদি না ধরি, অবশ্য প্রথম গুপ্তসম্রাট শ্রীগুপ্ত বাঙালি ছিলেন, পুণ্ড্রবর্ধনের মানুষ)। এরপর ১০০ বছরের মাৎস্যন্যায় পর্ব। ইতিহাসের পাতায় চরম অরাজকতার কাল। কিন্তু জানা যাচ্ছে, “এই মাৎস্যন্যায়ের সময়ে একজন রাণী বেশ অনেকদিন রাজত্ব করেছিলেন, তারানাথ জানাচ্ছেন। অবশ্য এঁর নাম বলেন নি তারানাথ। এই রাণী নাকি যে-ই তাঁকে বিবাহ করে রাজা হত, তাকে রাতের বেলায় হত্যা করতেন। পরপর এইভাবে কয়েকজন নিহত হওয়ার পরে কেউ আর ভয়ে রাজা হতে সাহস করেনি”। (বাঙালির সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ইতিহাস, তমাল দাশগুপ্ত) এঘটনা থেকে এটা অন্তত স্পষ্ট, এমনকি সেই ঘোর মাৎস্যন্যায় যুগেও বঙ্গনারীর রাজপদে অধিকার ছিলো। এবং বঙ্গনারী বিবাহ করতেন নিজস্ব সিদ্ধান্তে। এবং পছন্দ না হলে এমনকি বরটিকে পাল্টেও ফেলতেন। অবশ্য পালটে ফেলার এই পদ্ধতিটি বর্বরোচিত সন্দেহ নেই, তবে বর্বর পদ্ধতিটি এক অর্থে সেযুগের বঙ্গনারীর ক্ষমতা প্রমাণ করে।

পালযুগের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও খ্যাতনামা ক্ষমতাসম্পন্ন নারী হিসাবে নিগুমার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। চর্যাপদের আবিষ্কারকর্তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নাঢ়া এবং তাঁর স্ত্রী নাঢ়ীর কথা বলেছেন যাঁরা বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। নাঢ়ী তথা নিগুমা বা নিগুডাকিনী নাঢ়ার থেকেও বড় পণ্ডিত ছিলেন বলে খ্যাতি আছে। সেকারণে তাঁর জ্ঞান-ডাকিনী উপাধি ছিলো। অতীশ দীপঙ্কর নাঢ়ার শিষ্যর শিষ্য ছিলেন। নিগুমা বেশ কিছু বই রচনা করেছিলেন। তিব্বতে যে চর্যার পুঁথি পাওয়া গেছে সেখানে নিগুমার পদ সংকলিত আছে। আশ্চর্যজনকভাবে এই নাঢ়া-নাঢ়ীর কথা একেবারেই ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছিলো। নিগুডাকিনীকে আমরা বিস্মৃত হলাম, এজন্য তুর্কী আক্রমণের থেকে বড় অভিশাপ বাঙালির জন্য বাঙালি মেয়েদের জন্য আর কিছুই হতে পারে না। বিক্রমশীলাসহ সবকটি বিশ্ববিদ্যালয় বিধ্বস্ত হয়ে গেছিল, বিরাট লাইব্রেরিগুলো পুড়েছিলো। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় নেপাল রাজদরবারে বারবার না গেলে, কিংবা তিব্বতী পুঁথিগুলিও সামনে না এলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হিসাবে যা গেলাতে বাধ্য করা হচ্ছিল, তাকেই অন্ধের দৃষ্টি দিয়ে প্রকৃত দেখা বলেই বাঙালি ভেবে নিত। আলোচনার শুরুতে ‘নারী’ শব্দের যে যে প্রতিশব্দগুলি পাওয়া যাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হচ্ছিল, তা বঙ্গনারীর জন্য যে একেবারেই উপযুক্ত নয় সেটি স্পষ্ট। বাঙালির ইতিহাসকে বর্বরভাবে ধ্বংস না করা হলে, বাঙালি মেয়েদের প্রতি বর্বরোচিত আচরণ না করা হলে, একজন নিগুমা নয়, আরও অনেক নিগুমার সন্ধান যে পাওয়া যেত, তা যেমন নিশ্চিত, তেমন নারী মানেই রমণী, কামিনী, মহিলা, প্রমদা ইত্যাদি শব্দগুলোর পরিবর্তে অভিধানে কিছু শব্দ অন্তত থাকতো যা দিয়ে নারীরও বুদ্ধি, মেধা ইত্যাদিও যে আছে তা প্রকাশ পেতো।

এবার একটা প্রশ্ন উঠতে বাধ্য বর্তমানে ‘ডাকিনী’ শব্দটির এভাবে অর্থের অপকর্ষ হলো কেনো। এর উত্তর একটাই যে যে শব্দ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত নারীকে বিশেষিত করত সেগুলি সবই আজ অর্থের অপকর্ষের স্বীকার। আজকের বাঙালি ‘বেশ্যা’ শব্দ দিয়ে সবচেয়ে নোংরা কর্মে লিপ্ত নারীকে বোঝে। অথচ ‘বেশ্যা’ শব্দটি এসেছে ‘বিশ’ ধাতু থেকে। এই ধাতু থেকেই বৈশ্য শব্দের জন্ম। বৈশ্য শব্দটি সকলেরই চেনা। ব্যবসা বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। ‘The Veshya, The Ganika and The Tawaif’ গ্রন্থে বেশ্যা শব্দের যে অর্থ যেভাবে করা হচ্ছে, “Veshya is someone with whom men from economic rather than social relationships” সুতরাং এটা বলাই যায় ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক থাকা বাধ্যতামূলক নয়। ব্যবসা অর্থাৎ নানা জিনিসপত্র বিক্রির সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের কথা চর্যায় পাওয়াই যাই। স্বনির্ভর মহিলা, যিনি পিতা, স্বামী, পুত্র দ্বারা প্রতিপালিত না হয়ে নিজের জীবনের পালন কর্তা নিজেই, আসলে তাঁকেই বলা হত বেশ্যা। নারীর বিশেষণ যদি তার দাসত্ববৃত্তিকে স্বীকার না করে তবে সেই অর্থের অপকর্ষ যে ঘটবেই তা তো এই বৈদিক-পুরুষতান্ত্রিক/ইসলামিক সমাজব্যবস্থার প্রক্ষিতে অত্যন্ত স্বাভাবিক। নারীর ক্ষেত্রে ব্যবসা ও দেহ ব্যবসা সমার্থক হয়ে যদি দাঁড়ায় তবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আর শিক্ষাকে এই পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা চিরকালই ভয় পেয়েছে। এমনিতেই কথায় আছে, “যত বেশি জানবে, তত কম মানবে”। তার উপর শিক্ষিত নারী, যা প্রকৃতপক্ষেই তো সমাজের চোখে ভয়ঙ্কর। নারীকে বশে রাখতে চায় এই সমাজ। সেখানে শিক্ষিত নারীর উদাহরণ মোটেই ভালো আদর্শ নয়। তাই ‘ডাকিনী’ শব্দের অর্থ ভয়ঙ্করী হতে বাধ্য। এই প্রসঙ্গে একটা কথা উল্লেখ করতেই হয়। ডাকিনী বা ডাইনি নিয়ে যে মতগুলি এখনও সমাজে প্রচলিত আছে, তা হল ডাইনী যার দিকে তাকাবে সে নাকি মারা যাবে। অবাক হবার মত বিষয় এই যে, মধ্যযুগ থেকে প্রায় বিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত প্রচলিত কথা ছিলো নারী যদি পড়াশুনা শেখে, তবে তার স্বামী মারা যাবে। এবার একটু হিসেব মেলানো যাক। ডাইনির দৃষ্টিতে ঘটে মৃত্যু। পড়াশুনা শিখলে মারা যায় স্বামী। উচ্চ শিক্ষিত নারীর উপাধি ডাকিনী। সুতরাং অর্থের বিভ্রাট যতই ঘটুক, শিক্ষিত নারী চেতনায় না হলেও অবচেতনে ডাকিনী ছাড়া কিছুই নয় বিশ শতকেও। তা নারীর পক্ষে লজ্জার নয়। বরং খানিক হলেও স্বস্তির, সম্মানের।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসই হোক বা বাংলার ইতিহাস, সেনযুগ আর চর্যার গুহ্য তান্ত্রিকতা ও সহজিয়া ধর্ম অদ্ভুতভাবে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও একটা অদ্ভুত যুক্তিহীন প্রবাদ নির্মিত হয়েছে সেনযুগ সম্পর্কে। তাদের হাত ধরে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের আগমন। যার কারণেই নাকি যাবতীয় দুর্দশার সূত্রপাত। এবং তাদের ভয়েই বৌদ্ধ সহজিয়ারা গোপন ভাষায় সাধন পদ্ধতি লিখতেন, এবং তাঁরাই পলায়ন করেন নেপালে। তাই চর্যার পুঁথি পাওয়া যায় নেপালে। কিন্তু তথ্য প্রমাণ? আশ্চর্যভাবে উত্তর আসে “মনে করা যেতে পারে”। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় যখন ইতিহাস লেখা হচ্ছিল, তখন তথ্য প্রমাণের অভাব ছিলো (যদিও সেটা সত্য নয়, কারণ এই বিশেষ ইতিহাস লেখা শুরু হয়েছে ভারতের একটি বিশেষ সেকুলার প্রবণতায়, যেখানে তুর্কি আক্রমণকে আড়াল করার অপপ্রয়াস আছে)। কিন্তু এখন তো বরং বিপরীতে যথেষ্ট প্রমাণ আছে, যে সেনেরা বৌদ্ধ নির্যাতন করেন নি। বল্লাল নিজে তান্ত্রিক সাধনা করতেন। বৌদ্ধ তান্ত্রিকতার এক রূপ হল পদ্মিনীর সঙ্গে তাঁর সাধনা। লক্ষ্মণের রাজসভায় জয়দেব তো সহজিয়াদের আদি রসিক, ‘গীতগোবিন্দ’ একটি আদ্যোপান্ত সহজধর্মী টেক্সট, এবং বুদ্ধ তো বিষ্ণুর অবতার হয়ে গেছেন এই সময়। শেষ যে সেনসম্রাটের উল্লেখ পাই আমরা গৌড়েশ্বর হিসেবে, সেই মধুসেন তো পরমসৌগত, অর্থাৎ সরাসরি বৌদ্ধ হয়ে গেছেন। তবু এক অজানা অমোঘ কারণে দিনের পর দিন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভুল শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। তাই কয়েকটা কথা স্পষ্ট করা দরকার। প্রথমত, চর্যা লেখা সেনযুগে নয়, পাল যুগেই লেখা শুরু হয়ে গেছিলো, এবং পালযুগেই বেশিরভাগ চর্যা রচনা শেষ। চর্যার ভাষা যদি বাংলা বলে দ্বিমত না হন কেউ তবে বাংলা ভাষার প্রাচীনতা আরও ১৫০ বছর এগিয়ে দেওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সেন রাজাদের ভয়েই যদি বৌদ্ধ সহজিয়ারা পালিয়ে যাবেন তবে অন্ধকার যুগ সেন রাজাদের সমসাময়িক কালকেই তো ধরা যেতে পারতো। ঐতিহাসিকরা তা না করে তুর্কী আক্রমণ পরবর্তী ১৫০ বছরকে কেনো অন্ধকার যুগ বললেন? তৃতীয়ত, সেন রাজারা প্রকৃত অর্থেই বৌদ্ধ বিদ্বেষী হলে বৌদ্ধ বিহারগুলো তাঁদের হাতে ধ্বংস হলো না কেনো? চর্যা লেখা বেশিরভাগই পালযুগে, সেক্ষেত্রে কি পালরাজাদের ভয়ে তাঁরা সন্ধ্যাভাষার আবিষ্কার করেছিলেন? কেউ বিশ্বাস করবে? চতুর্থত, সেনরাজাদের ভয়ে সন্ধ্যা ভাষায় যদি লেখা হয়, তবে মধ্যযুগের বাউল সঙ্গীতগুলিও সেই ভাষাতেই কেনো লেখা? তখন তো সেন রাজত্ব নেই!

অবশ্যই এগুলো এ প্রবন্ধের আলোচনার বিষয় নয়, আমাদের আলোচ্য বিষয় নারী। কিন্তু এই প্রশ্নগুলো অবশ্যভাবেই প্রাসঙ্গিক। কারণ এটাই বলা যে চর্যা সংক্রান্ত এত প্রশ্নের উত্তরে যদি ঐতিহাসিকরা নিশ্চুপ থাকেন, তবে নারীপ্রসঙ্গে যে কথাগুলো ছড়িয়েছে তার সত্যতা দেখার দায় কারই বা আছে। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎবঙ্গে’ সেন রাজসভার একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন, “লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় মাধবী নাম্নী বণিক-বধূ আসিয়া নালিশ করিলেন, “রাজশ্যালক কুমার দত্ত তাঁর প্রতি অত্যাচার করিয়াছে।” উমাপতি ধর প্রভৃতি বিচারকগণের নিকট এই অভিযোগ। স্বয়ং লক্ষ্মণ সেন সেই অভিযোগ শুনলেন।” এবং এই অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণ করতে রাজসভায় রাজমহিষী অর্থাৎ লক্ষ্মণ সেনের স্ত্রী তর্কে প্রবৃত্ত হলেন। এ ঘটনা থেকে এটা কি প্রমাণ হয় না খোলা রাজসভায় তখনও মেয়েদের অবাধ যাতয়াত ছিলো এবং ছিলো অবাধে মত প্রকাশের অধিকার?

সেনযুগেরই আর একটি ঘটনা না উল্লেখ করলেই নয়। তা হলো জয়দেব পদ্মাবতীর প্রেম, ও তাঁদের সাধনা। এবিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা আছে ‘সেক শুভদয়া’ গ্রন্থে। অলৌকিক ঘটনার সমাবেশ থাকলেও মূল নির্যাসটুকু পেতে অসুবিধা হয় না। সেখানে বূঢ়ন মিশ্রকে সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথমে পদ্মাবতী হারিয়েছিলেন এবং পরে জয়দেব। সমকালে স্ত্রীলোক যে বহুগুণের আকর ছিলেন, তা এই প্রতিযোগিতা চলাকালীন বূঢ়ন মিশ্রের পরাজয় থেকে স্পষ্ট। জয়দেব পদ্মাবতী একসঙ্গে শাস্ত্রচর্চা, তন্ত্রবিদ্যাচর্চা করতেন সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁরা নৃত্যগীত দ্বারা লক্ষ্মণ সেনের রাজসভা অলঙ্কৃত করে রাখতেন তেমন তথ্য পাওয়া যায়। সুতরাং সেন আমলেও “নারী শুধু কয়েক প্রহরের বিলাস-সঙ্গিনী” মাত্র ছিলেন না। পাশাপাশি একবার ‘গীতগোবিন্দ’ পাঠ করে তাকানো যাক “দেহি পদপল্লবমুদারম” পদটির দিকে। গ্রাম বাংলায় এখনও একটি প্রথা প্রচলিত আছে, স্বামী থেকে মেয়েদের জীবনে বড় কেউ হয় না। তাই সকালে ঘুম থেকে উঠে , মাথায় কাপড় দিয়ে স্বামীর পায়ে প্রণাম করে দিন শুরু করতে হয়। কারণটি বড়ই আশ্চর্যের। রাত্রে একসাথে শোওয়ার সময় হতেও পারে মহিলার পা পুরুষের গায়ে লেগে গেছে তাই। বর্তমান সমাজে প্রেমের কোনো মূল্য নেই। প্রেমে কোনো বড় ছোট হয় না। তাই রাধিকা যেমন পারে নিজের জীবন দিয়ে, নিজের শরীরের অনুপরমাণু দিয়ে কৃষ্ণের আরাধনা করতে, কৃষ্ণও তেমনি রাধার পদপল্লব ধারণ করতে প্রস্তুত। এই চেতনা বঙ্গনারীর প্রাচীন যুগেই দেখতে পাওয়া সম্ভব। মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীতেও কৃষ্ণেরও এই সমর্পণের দর্শন খুবই কম মেলে।

বঙ্গনারীর সেকাল নিয়ে এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে আমাদের চোখে পড়ল পার্থক্যটাঃ আমাদের এই তান্ত্রিক/শক্তি-উপাসক ভূখণ্ডে বহিরাগত বৈদিক ও ইসলামিক সংস্কৃতি ক্রমশ নারীকে অবদমিত করেছে। প্রাচীনা বঙ্গনারী তাঁর মেধা-স্বাধীনতা-গৌরবে সমুজ্জ্বল ছিলেন। আজ অবদমনের সময়ঃ এই একালটা সকলের কাছেই পরিচিত। অভিধানে প্রাপ্ত শব্দগুলিতেই একালের নারী যথেষ্ট বর্ণিত। নানা সংক্ষিপ্ত চরিত্রর মধ্যে দিয়ে আমাদের গৌরবের সেকালটা বোঝা গেলো আশা করা যায়। নারীর পোশাক, হাঁটা চলা, কথা বার্তা প্রসঙ্গে যাঁরা ঐতিহ্যের কথা বলেন, যাঁরা মনে করেন তর্ক করা নারীদের শোভা পায় না কারণ তা ঐতিহ্যের পরিপন্থী, যাঁরা মনে করেন মেয়েরা স্বনির্ভর হতে চাওয়া পারিবারিক ও জাতীয় সম্মানকে ক্ষুন্ন করা, পোশাকেই লুকিয়ে আছে পরিবারের শিক্ষা তাঁদের কাছে প্রশ্ন তাঁরা কোনটাকে শিক্ষা বলে জানেন? ঐতিহ্য বলতেই বা কী বোঝেন? বাঙালির শিকড়কে চিনুন, বাঙালির শিকড়কে জানুন। অন্ধের মত কখনও উত্তর ভারত কখনও আরবের অনুকরণ অনেক হয়েছে। নারী সম্পর্কে যে পুরুষতান্ত্রিক মতামত পোষণ করছেন তা আদৌ বঙ্গসংস্কৃতি কিনা, বাংলার ঐতিহ্য কিনা সেটা আগে জানুন।

 

তথ্যসূত্র

১) বৃহৎ বঙ্গ (১ম ও দ্বিতীয় খন্ড)- দীনেশচন্দ্র সেন।

২) বাঙ্গালার ইতিহাস- রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

৩) বঙ্গ ভূমিকা- সুকুমার সেন।

৪) বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব)- নীহাররঞ্জন রায়।

৫) গৌড়ের ইতিহাস – রজনীকান্ত চক্রবর্তী।

৬) http://bengaliwiki.org/doku.php?id=%E0%A6%86%E0%A6%A6%E0%A6%BF_%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%97%E0%A7%8B%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%A8&fbclid=IwAR3f9gkLRNzX3SO2cT6zN93ASkpjz82OFFAT9e4fHbBfkdD9RUZCrcusbz0

৭) বাঙালির সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ইতিহাস – তমাল দাশগুপ্ত

 

৮) The Veshya, The Ganika and The Tawaif- Gayatri Chatterjee

ড: ঋতুপর্ণা কোলে
ড: ঋতুপর্ণা কোলে
সম্পাদক, সপ্তডিঙা পত্রিকা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Advertisingspot_img

Popular posts

My favorites