বাঙালির ধর্মচেতনার একটি নিজস্ব ধারা আছে, যাকে কালে কালে চেপে রাখার চেষ্টা করেছে নানা ধর্মের ধ্বজাধারীরা। প্রতিটি ধর্মের নিজস্ব গঠন সম্পর্কে সেই ধর্মের অনুসারীদের স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। ইসলামী বাঙালি কিংবা সনাতনী বাঙালি কথাটি অনেকটাই সোনার পাথরবাটি কিংবা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো ব্যাপার। ইসলামের আসমানী কেতাব আসার পূর্বে একটি বাঙালির ধর্ম ছিলো, অকাল বোধনের মতো গোবলয়ের গাঁজা ঢোকার আগে একটি বাঙালির ধর্ম ছিলো, এমনকি বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠার আগেও একটি বাঙালির ধর্ম ছিলো। কীভাবে বুঝবেন? তার জন্য কোনো ধর্মগ্রন্থের নয়, ইতিহাসের হাত ধরতে হবে। কারণ বাঙালির আদিধর্ম গ্রন্থ বিলুপ্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত।
ইতিহাসের আলোচনায় যাওয়ার আগে একবার জেনে নেওয়া যাক ধর্মের প্রয়োজন কেনো। কোনো জাতিকে একত্রিত করতে প্রয়োজন আদর্শের ও আইকনের। প্রাচীন কাল থেকে ধর্ম মানুষকে তাই দিয়ে এসেছে। ধর্মগ্রন্থের কাজ আদর্শের প্রচার করা, মূর্তির কাজ আইকনের অভাব পূরণ করা। মানুষ চিরকালই অসহায় বোধ করলে কোনো না কোনো আইকনের উপর আস্থা রেখেছে এবং এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। বিজ্ঞান হোমিওপ্যাথি ওষুধের কার্যকারিতাকে শিকার করে না, কিন্তু সাধারণ মানুষ করে এবং সেরে ওঠে। ঈশ্বরের ধারণাটাও অনেকটা সেরকমই। মানুষের মনে জোরের জায়গা তৈরি করে এবং মানুষ অসাধ্য সাধন করে ফেলে। কোনো জাতিই ধর্মবিচ্যুত হয়ে জাতিগতভাবে টিকতে পারে না। বাঙালির এই জাতিগত চেতনাটাই আজ বিলুপ্ত হয়েছে, তার কারণ তার নিজস্ব ধর্মবোধ নানা আগ্রাসনের শিকার।
জাতিচেতনার গুরুত্ব
এবার প্রশ্ন আসতেই পারে, জাতিগত চেতনা থাকলেই কী? আর না থাকলেই কী? জাতিচেতনা সবার প্রথমে আমাদের একটা পরিচয় নির্মাণ করে। যে পরিচয়ের সবাই একটা নির্দিষ্ট বিশ্বাস ও সংস্কৃতি মেনে চলি। এই সংস্কৃতি পরম্পরা মেনে চলা কেবল ঐতিহাসিকভাবে নয় বৈজ্ঞানিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। একটা সংস্কৃতি বহু হাজার বছর ধরে একটা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ যখন মেনে আসছে, তার জেনেটিক সেট-আপ সেই সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে। জাতিচেতনা হারিয়ে গেলে ঐতিহ্য সূত্রে পাওয়া শিক্ষাও হারিয়ে যাবে। উদাহরণ দেওয়া যাক খাদ্য থেকে।
ইতিহাস ও বর্তমানের মিল
আগেই বলেছি, বিচার করতে হবে ইতিহাসের হাত ধরে। আমাদের কাছে কিছু কিছু প্রত্ন প্রমাণ যেটুকু টিকে আছে, তার ভিত্তিতেই দেখবো। পাণ্ডুরাজার ঢিবি খননে চাল পাওয়া গেছে (গম নয়), বেহালা মিউজিয়ামে তা দেখতে পাবেন। চন্দ্রকেতুগড়ে ধানের শীষ ও মাছ হাতে নারী মূর্তি পাওয়া গেছে, ছাগবলির ফলক পাওয়া গেছে কিন্তু দুগ্ধদোহনের ফলক পাওয়া যায়নি।
খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক সুস্থতা
চলুন এবার ইতিহাস আর বর্তমানকে মিলিয়ে দেওয়া যাক। সেখান থেকেই বেরিয়ে আসবে কেনো পাণ্ডুরাজার ঢিবি কিংবা গঙ্গারিডাইকে বাঙালির নিজস্ব বলে মনে করবো। আমরা বাঙালিরা হলাম মাছে ভাতে বাঙালি এবং রবিবার হলেই খাসির দোকানে লাইন দিই। বিজ্ঞান বলছে বাঙালির মধ্যে দুধে অ্যালার্জির প্রবণতা খুব বেশি। কিন্তু আমাদের জেনেটিক সেট-আপে মাছ, ভাত, খাসির ঝোল নর্মাল ব্যাপার। বাঙালির মাতৃকা উপাসনায় প্রসাদ হিসাবে কিন্তু এগুলোই থাকে। ভাত, মাছ, নিরামিষ পাঁঠার ঝোল। অন্যদিকে ইতিহাস বলছে পেঁয়াজ রসুনের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি চতুর্দশ পঞ্চদশ শতকে, মোঘলরা আসার পরপরই। মুসলমান শাসকের দান ভেবে বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় মুড়ি মুড়কির মতো পেঁয়াজ রসুন খাচ্ছে, অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদের প্রচারে হিন্দু বাঙালি শিখেছে নিরামিষ খেতে। দুটোর কারণেই বাঙালির শরীর হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। অত্যধিক পেঁয়াজ রসুন তৈরি করছে আলসার, হার্টের অসুখ ইত্যাদি। অন্যদিকে ২০১৪ সালের পর থেকে বাঙালি তথা ভারতীয়দের মধ্যে চরম হারে বেড়েছে অ্যানিমিয়া, অর্থাৎ রক্তাল্পতা। কারণ হলো শরীরে প্রাণীজ প্রোটিনের যোগান কমেছে। ধর্মের নাম নিয়ে নিজস্বতা ত্যাগ করে বাঙালি এই যে পরের ধর্ম নিয়ে মাতামাতি শুরু করেছে, তার প্রভাব কেবল এই প্রজন্মের উপর নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্মের উপর পড়তে চলেছে।
বাঙালির নিজস্ব ধর্ম প্রসঙ্গে
এবার আসি শুরুর কথায়। বাঙালির নিজস্ব ধর্ম প্রসঙ্গে। জাতিকে বাঁচাতে সেই ধর্মের শেকড়ে পৌঁছে নিজস্বতা নির্মাণের প্রসঙ্গে। বাঙালির নিজস্ব ধর্মের অনেকটাই আছে মৌখিক রূপে, আর আছে আচার আচরণের মধ্যে নিহিত। লিখিত রূপ একেবারে নেই বললেই চলে। প্রতিটি ধর্ম আধিপত্য বিস্তার করে তার ধর্মগ্রন্থকে হাতিয়ার করে। বাঙালির উপরও আধিপত্য কায়েম করা হয়েছে এভাবেই। হিন্দুদের যত ধর্মগ্রন্থ বর্তমানে বাংলায় প্রচলিত, সবই মধ্যযুগে লেখা বৈদিক সাহিত্যের সঙ্গে বাংলায় প্রচলিত ধর্মের সঙ্গে তালগোল পাকিয়ে লেখা। পার্বতী শিবের বৌ কিংবা লক্ষ্মী নারায়ণের পা টেপা দাসি এসব তত্ত্বের যদি সত্যিই বাস্তবতা থাকতো, তাহলে প্রাচীন বাংলায় এই তত্ত্বের ভিত্তিতে কোনো প্রত্ন প্রমাণ পাওয়া গেলো না কেনো? অথচ বর্তমানে বাংলায় শিব ছাড়া দুর্গা মূর্তি কল্পনার অতীত।
পরের ধর্ম গ্রহণের ক্ষতিকর প্রভাব
এত কথা বলার কারণ একটাই, গোবলয়ের অনুকরণে বাঙালি আজ নিরামিষ খাচ্ছে, সবুজ চুড়ি পরছে, বর্ণভেদ প্রথাকে মেনে চলছে, অন্যদিকে মরুবলয়ের অনুকরণে একদল শহি ইসলাম হবার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বাস্তব এটাই যে, বাঙালি ব্রাহ্মণ সন্তান কখনোই রাম মন্দিরের হেড পুরোহিত হতে পারবে না যত বড়োই টিকি রাখুক না কেনো, আর বাংলার ইমাম যত বড়োই দাড়ি রাখুক আরবে গিয়ে শেখ হতে কোনোদিনই পারবে না। সারাজীবন এরা পরের পা চেটে পরের স্বার্থপূরণ করে যাবে।
নিজের জাতির স্বার্থে ধর্মের নিজস্বতা রক্ষা
একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই, আজকাল প্রায়ই খবরে আসে জিমে গিয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গেছে। আজ পর্যন্ত যোগা করতে গিয়ে মারা যাওয়ার খবর কি এসেছে? আমাদের জেনেটিক মেমোরিতে বহু যুগের যোগার ঐতিহ্য আছে। তা শুরু করা মাত্রই আমরা ভালো ফল পেতে শুরু করি। ক্যারাটে কিংবা জিম এগুলোকে মানিয়ে হয়তো শরীর নেবে, তার আগে জমা হবে অসংখ্য লাশ। দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষত ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ডায়াবেটিস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রায় সকল বিশেষজ্ঞই একমত হয়েছেন, প্রাচীন অভ্যাসকে ফিরিয়ে না আনলে বিপদ আরও মারাত্মক হতে চলেছে। সেই অভ্যাসের মধ্যে প্রোটিনের ঘাটতি মেটানোর পাশাপাশি যোগার উপরেও গুরুত্ব দিচ্ছেন। গুগল করলেই এই সংক্রান্ত বেশ কিছু রিসার্চ পেপার পেয়ে যাবেন।
সমাপনী কথা
ধর্মের নিজস্বতাকে রক্ষা করা নিজের জাতির স্বার্থেই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বমানব আপনাকে বোঝাতে চাইবে ধর্ম খারাপ জিনিস, গোবলয়, মরুবলয় বোঝাতে চাইবে তোমার ধর্ম খারাপ, আমারটা ভালো। যত এসব কথায় ভুলবেন তত নিজেকে জানা থেকে ভুলবেন। আপনার নিজস্ব ধর্ম জানে আপনার জন্য কোনটা উপযুক্ত, নিজেকে প্রশ্ন করুন, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিন। সবশেষে মিলিয়ে দেখুন আপনার ধর্মের কোন অংশটা আপনি আজও নিজের অজান্তেই হোক বা জানা মতেই হোক মেনে চলেন, যা ইতিহাসের সঙ্গে একেবারে মিলে যাচ্ছে।
ধর্মের অর্থ
ধর্মের অর্থ যা ধারণ করে। ধর্ম প্রকৃত অর্থে আপনার আইডেনটিটিকে ধারণ করে, আপনার ইতিহাসকে ধারণ করে, আপনার খাদ্যাভ্যাস, আচার, আচরণকে ধারণ করে, আপনার সংস্কৃতিকে ধারণ করে। যার মধ্যে রক্ষিত আছে পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচানোর প্রাণ ভ্রমরা। সুতরাং যত বেশি বাঙালি না থেকে ইসলামি বাঙালি, সনাতনী বাঙালি হবেন তত বেশি করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কাঁঠালের আমসত্ত্ব খাওয়ার জন্য সোনার পাথরবাটি উপহার দিয়ে যেতে পারবেন।